Quantcast
Channel: QuranerAlo.com – কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 385 articles
Browse latest View live

দাম্পত্য সম্পর্কের ৫০ টি বিষয় যা আপনার জেনে রাখা প্রয়োজন

$
0
0

ভাষান্তর : শাহোরিনা ইয়াসমিন |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

Pics 4

১. সুন্দর সম্পর্ক নিজে থেকেই তৈরি হয় না, সেটি তৈরি করতে হয়। তাই আপনাকেও সেটি তৈরি করতে হবে।

২. কর্মক্ষেত্রেই যদি আপনার সবটুকু কর্মক্ষমতা নিঃশেষ করে ফেলেন, তাহলে   আপনার দাম্পত্য জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

৩. আপনার উৎফুল্ল আচরণ হতে পারে আপনার জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনীর জন্য খুব দামি একটি উপহার।

৪. কাউকে একইসাথে ভালোবাসা এবং ঘৃণা করা আপনার জন্য অসম্ভব নয়।

৫. আপনার জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনীর ব্যাপারে বন্ধুদের কাছে অভিযোগ করা থেকে বিরত থাকুন। মনে রাখবেন বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া আপনার দাম্পত্য সম্পর্কে  বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

৬. দাম্পত্য জীবনে তা-ই নিয়ম যা দুইজনের পছন্দের ভিত্তিতে ঘটে।

৭. সাময়িক ঝগড়া বিবাদের কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায় না। মনের মধ্যে জমে থাকা চাপা ক্ষোভ আর যন্ত্রণাই দাম্পত্য জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংস করে দেয়।

৮. দাম্পত্য সম্পর্ক, “কী পেলাম?” –এর হিসেবে মেলানোর জন্য নয়। বরং সঙ্গী বা সঙ্গিনীকে “কী দিতে পেরেছি,” তা-ই দাম্পত্য সম্পর্কের মূলকথা।

৯. “জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনী হিসেবে আমি সর্বোত্তম”-এমনটি মনে হওয়া অতি আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ। এমনটি মনে হলে নিজেকে যাচাই করুন।

১০. সংসারের ক্রমাগত আর্থিক সচ্ছলতা অর্থ এই নয় যে, দাম্পত্য জীবনও সুখের মধ্য দিয়ে কাটছে।

১১. যদি বিশ্বাস ভেঙ্গে গিয়ে থাকে, তাহলে সেই বিশ্বাস জোড়া দেওয়ার সময় এখনও পার হয়ে যায়নি। এজন্য যেকোনো সময়ই উপযুক্ত সময়।

১২. অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যা নিয়ে তর্ক হয় তা আসল বিষয় থাকে না।

১৩. ভালোবাসা কেবল অনুভুতি নয়; বরং আমাদের কাজের মাধ্যমেই ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

১৪. বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের হতাশা ও অতৃপ্তিকে বাড়িয়ে দেয়।

১৫. দাম্পত্য জীবনের অনেক তর্কই হয়ত এড়িয়ে যাওয়া যায় না। তবে ক্ষতিকর বিতর্ককে এড়িয়ে যেতেই হবে।

১৬. জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনীর প্রতি আপনার গভীর মনোযোগ পরস্পরের জন্য হতে পারে অমূল্য উপহার।

১৭. অনেক সময় সুখী দম্পতিরাও ভাবেন যে, তারা ভুল মানুষটিকে বিয়ে করেছেন।

১৮. আপনার জীবনসঙ্গী/জীবনসঙ্গিনী আপনাকে সুখী করার শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে না পারলেও তিনি আপনার সুখী হওয়ার ব্যাপারে অবশ্যই সাহায্য করতে পারেন।

১৯. মিথ্যা বলে হয়ত সামান্য কিছু সুবিধা পান। কিন্তু পরিমাণে মিথ্যা বলার জন্য সুবিধার চেয়ে অনেক বেশি চড়া মূল্য দিতে হয়। অতএব, মিথ্যা বলা বর্জন করুন।

২০. আপনার মতামত যে সবসময় সঠিক, এমনটি ভাববেন না।

২১. বছরের পর বছর ধরে যে বিশ্বাস আপনি গড়ে তুলেছেন, তা এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

২২. সঙ্গী বা সঙ্গিনীর অপরাধবোধকে দীর্ঘায়িত করে তার অনুভূতি নিয়ে খেলা করে আপনি যা পেতে চান, তা কখনোই পাবেন না।

২৩. আপনার বন্ধুদেরকে অবহেলা করবেন না।

২৪. আপনার যদি মনে হয়, ‘তুমিই আমার জন্য সঠিক মানুষটি, যাকে আমি বিয়ে করেছি’, তাহলে আপনি ঠিক পথেই আছেন।

২৫. কোনোকিছু প্রমাণ করতে যাওয়ার প্রলোভনকে দমন করতে পারলে, বস্তুত আপনি অনেক কিছুই প্রমাণ করতে পারলেন।

২৬. আত্মিক উদারতা একটি সুখী দাম্পত্য জীবনের প্রধান ভিত্তি।

২৭. সঙ্গী বা সঙ্গিনী যদি কোনো রক্ষণাত্মক আচরণ করে, তাহলে তার রক্ষণাত্মক হওয়ার পক্ষে আপনিও কিছু কারন দেখাতে পারেন।

২৮. বিয়ে কোন ৫০/৫০ সম্ভাবনা না; বরং এটি হলো ১০০/১০০।

২৯. দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপনি কোনোকিছু এখনও পরিশোধ করতে পারেন আবার পরেও পারেন। তবে যতদেরিতে তা করবেন, ততবেশি জরিমানা আপনাকে দিতে হতে পারে।

৩০. সুন্দর বৈবাহিক সম্পর্কের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা প্রয়োজন। এমনটি করতে পারলে, আপনি আপনার ত্যাগের চেয়ে ভোগই বেশি করতে পারবেন।

৩১. ক্ষমা কোন সাময়িক গুণ নয়; বরং ক্ষমা একটি চলমান প্রক্রিয়ার নাম।

৩২. দাম্পত্য জীবনের কঠিন সময়গুলো আপনাকে একজন ভালো মানুষ করে তুলবে।

৩৩. বিয়ে অনেকটা রকেট উৎক্ষেপণের মতো। যখন তাতে মাধ্যাকর্ষণ টান পূর্ণ থাকে, তখন ফ্লাইট চলতে খুব সামান্য জ্বালানীর প্রয়োজন হয়।

৩৪. দাম্পত্য জীবনে সাফল্য পেতে হলে, অতীতে কী হয়েছে তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে, ভবিষ্যতের করণীয় নিয়ে পরিকল্পনা করতে হবে।

৩৫. আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। কৃতজ্ঞতা বোধকে নিজের ভেতর চেপে রাখবেন না।

৩৬. বাস্তবতার খাতিরে মাঝে মাঝে নীরবতা পালন করা একটি অসাধারন উপায়।

৩৭. আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে আপনার সর্বোত্তম প্রশ্নগুলোর একটি হতে পারে, “আমি কীভাবে তোমাকে আরও বেশি ভালোবাসতে পারি?

৩৮. চাইলেই দাম্পত্য জীবনকে চিরসবুজ করে রাখা যায়।

৩৯. যৌক্তিক অনুমানের ভিত্তিতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। তবে পদক্ষেপ নেওয়ার পূর্বে অনুমানকে যাচাই করে নেওয়াই আবশ্যক।

৪০. মনের ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যই সবকিছু নয়, কিন্তু তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটি।

৪১. সার্থক যৌন সম্পর্ক সার্থক দাম্পত্য সম্পর্কের নিশ্চয়তা দেয় না। তবে তা সার্থক দাম্পত্য সম্পর্ক নির্মাণে সহায়তা করে।

৪২. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করলে তা দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষতি করবে না। তবে সন্দেহজনক বিষয় নিয়ে লুকোচুরি করলে তা দাম্পত্য সম্পর্কের ক্ষতি করবে।

৪৩. সঙ্গী/সঙ্গিনীকে আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা এবং ঈর্ষাপরায়ণতার জন্ম হয় ভয় থেকে, ভালোবাসা থেকে নয়।

৪৪. বিশ্বাসযোগ্যতা বিশ্বাসযোগ্যতার জন্ম দেয় এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে তোলে।

৪৫. আপনার স্বামী বা স্ত্রী যদি কোনোকিছুকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে, তাহলে তা আপানর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৪৬. দাম্পত্য সম্পর্কে প্রেমাবেগের প্রয়োজন কখনোই ফুরিয়ে যায় না।

৪৭. নতুন সম্পর্কের ঔজ্জ্বল্য সবসময়ই ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে।

৪৮. নীরবতাও আক্রমণাত্মক হতে পারে যখন তা অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

৪৯. অধিক উত্তম হলো নিজে কীভাবে সঠিক কাজটি করতে পারেন সেদিনে মনোযোগ দেওয়া। তারপর আপনার সঙ্গী বা সঙ্গিনী কী ভুল করেছে সেদিকে মনোযোগ দেওয়া।

৫০. দাম্পত্য সম্পর্ককে মানিয়ে নেওয়া একেবারেই অসম্ভব মনে হলে, কেবল তখনই বিচ্ছেদের দিকে পা বাড়াতে পারেন।

Source: Excerpted from Al Maghrib Institute’s “Fiqh of Love” seminar with Shaykh Waleed Basyouni.

English Version

 Exclusive post for Pure Matrimony Bangladesh

শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্‌ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন  - http://www.quraneralo.com/purematrimony/

Facebook: http://www.facebook.com/purematrimonybd


স্থায়ী দাম্পত্যের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন

$
0
0

মূল : আমাল কিল্লাওয়ি | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

প্রকাশনায় : PureMatrimony Bangladesh

muslim-man-putting-shoes-on-woman

সম্প্রতি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে মানুষের দাম্পত্য নিয়ে নানা সমস্যার কথা শুনলাম। অতিথিরা যখন নেচে গেয়ে অনুষ্ঠান মাত করছিল, হলের একদম পেছনের দিকে বসে বসে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আর অপূর্ণ প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল। গানবাজনার উচ্চ শব্দের কারণে পরস্পরের কথা শোনার জন্য মাঝে মাঝে আমাদেরকে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছিল। একজন কমবয়সী নারী বললেন, তার স্বামী তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেবেন না। উপস্থিত আরেক বান্ধবী শশুরবাড়ির লোকজনের সাথে কীভাবে চলতে হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। এক মা কাঁদতে কাঁদতে তার মেয়ের সম্ভব্য বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বললেন। তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে ঘরে তুলতে কেমন লাগবে সেই অনুভূতির কথাও বললেন।

অন্যরকম একটা রাত! নবদম্পতির জন্য অনেক অনেক দো‘আ আর শুভকামনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের ইতি হলো। মনে আছে, বর-কনে, উভয়ের জন্য আমি আরও বেশি দো‘আ করেছিলাম : ‘হে আল্লাহ! ওদের তুমি একটা স্থায়ী এবং সুস্থ-সুন্দর সম্পর্ক দিয়ে ধন্য করো। আমীন।’ অনুষ্ঠান থেকে গভীর চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ফলে ঘুমিয়ে পড়তে বেশ সমস্যা হলো। ওইরাতে অভিজ্ঞতার পরিহাস আমাকে ভালো মতোই নাড়া দিল।

গত কয়েকমাসের মধ্যেই আমার আশেপাশের অনেক কয়টা সংসার ভেঙ্গে গেছে। আমার জানা মতে, এমন আরও অনেক দম্পতি চূড়ান্ত বিচ্ছদের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিবাহ বিচ্ছেদ একটি সঠিক এবং অনেক ক্ষেত্রে একটা অপরিহার্য পছন্দ। কিন্তু কী কারনে এত বিপুল সংখ্যক দাম্পত্য জীবনের এত দ্রুত অবসান ঘটছে? প্রতিশ্রুতি এবং দায়িত্ববোধের একটি সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য কী ধরণের পরিবর্তন দরকার?

সেদিন রাতে যতগুলো ঘটনা আমি শুনেছিলাম, তার সবগুলোর সারকথা ছিল একটাই : বিয়ের আগে ওইসব দম্পতির কেউই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তাদের কেউই বিয়ের মতো জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি এবং তাদের অধিকাংশ সমস্যাগুলো এমন সব বিষয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, বিয়ের পূর্বে যেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। মুসলিম সমাজগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের উপর একটি সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে, গবেষণায় অংশ নেওয়া তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষদের কেউই মসজিদের ইমামের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ছাড়া, অন্যকোনো বিবাহপূর্ব পরামর্শই গ্রহন করেননি। তাদের অনেকেই বলেছেন, আরও ব্যাপক বিবাহপূর্ব পরামর্শ পেলে এবং বিয়ের পরে সমস্যায় পড়ার সাথে সাথে এধরনের সহজ পরামর্শ পেলে তারা অনেক উপকৃত হতেন। আমাদের সমাজগুলোতে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের অভাব একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

যখনই কোনো দম্পতির বাগদানের খবর শুনি, আমরা অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের জন্য দৌড়ে যায়। কখনও কি আমরা সময় করে ভেবেছি, সারাজীবনের জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিতে ওই নবদম্পতির কী পরিমাণ প্রস্তুতি এবং সহযোগিতার প্রয়োজন? বিয়ের অনুষ্ঠানে হাসিখুশি চেহারায় ছবি তুলতে ব্যস্ত কয়জন নবদম্পতি আসলেই জানে, তারা কোন পথে পা বাড়াচ্ছে? নতুন সম্পর্কের প্রেমোত্তেজনা তাদেরকে প্রায়ই এই বাস্তবতা উপলব্ধিতে অন্ধ করে দেয় যে, তাদের বিয়ে হলো স্রষ্টার সাথে একটি পবিত্র অঙ্গীকার। এই আত্মিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয়?

বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমরা কত সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করি! অথচ খোদ বিয়ের জন্যই কিছু করি না। এমন কেন হয়? বিয়ে অনুষ্ঠানের সামান্য বিষয়টা নিয়েও আমাদের জল্পনা-কল্পনার কমতি থাকে না। অথচ সেই অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের অপরিহার্য উদ্দেশ্য, অন্য একজন মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার “অঙ্গীকার”কে আমরা উপেক্ষা করে যায়। একজন মহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে ভাবার জন্য দু’মাস মাত্র সময় পেয়েছিলাম। প্রেমে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, তাই অন্যকিছু নিয়ে ভাববার সময় পায়নি।’

অনেক যুগল ভূলবশত মনে করেন, বিয়ের আগে তাদের কোন পরামর্শ গ্রহনের প্রয়োজন নেই, দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে পারলেই সব ঠিক থাকবে। তবে কথা হলো, একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত দ্বন্দ্ব থাকা সুস্থ দাম্পত্যের জন্য জরুরি এবং বিবাহপূর্ব পরামর্শ সম্ভব্য সমস্যা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দেয়।

বিয়ের ব্যাপারে পাকাকথা দেওয়ার আগেই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন।

পরিবার ও বিবাহ বিষয়ক গবেষক, লিসা কিফ্‌ট এর মতে, বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ আপনাকে নিন্মোক্ত ক্ষেত্রে সাহায্য করবে:

১) পারস্পরিক ভূমিকার ব্যাপারে প্রত্যাশাগুলো কেমন, তা আলোচনা করা। একটি দাম্পত্য সম্পর্কে প্রত্যেকের নিজনিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্যগুলো নিয়ে কথা বলা জরুরি। যেমন : কে আর্থিক দিকটা সামলাবেন আবার কে বাড়ির কাজগুলো দেখাশোনা করবেন ইত্যাদি। আগেভাগেই প্রত্যেকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা হলে, পরস্পরের কাছে ভবিষ্যত প্রত্যাশাগুলো সচ্ছ এবং পরিষ্কার হয়ে যায়।

২) পরস্পরের ব্যক্তিগত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া। গানবাজনা, হিজাব, জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া, কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা ইত্যাদি বিষয়ে দুজনের কার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা জেনে নিন। সময় থাকতেই এসব বিষয়ে আলোচনা করলে আপনারা পরস্পরের জন্য কতটুকু মানানসই, তা বুঝতে পারবেন। এতে করে কীভাবে ভিন্ন মতের মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে হবে তা জানা যাবে।

৩) পরস্পরের বংশ এবং পরিবার সম্পর্কে কথা বলা। একটি সম্পর্কের সাথে যতগুলো বিষয় জড়িত থাকে, তার অধিকাংশ সম্পর্কে আমরা আমাদের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের থেকে শিখে থাকি। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রভাবগুলো চিহ্নিত করলে এবং সেসব থেকে অর্জিত আচার-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলে বুঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে সেগুলো কোন ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।

৪) পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ান। যে দম্পতির মাঝে যত উন্নতমানের বোঝাপড়া বিদ্যমান, তারা তত কার্যকরভাবে নিজেদের সমস্যার নিরসন করতে পারেন। এতে করে খুব সামান্য সময়ই আপনি তর্কে জড়াবেন এবং অধিকাংশ সময় পরস্পরকে বুঝতে পারবেন।

৫) ব্যাক্তি জীনবের জন্য, দাম্পত্য জীবনের জন্য এবং পারিবারিক জীবনের জন্য লক্ষ্য স্থির করুন। মনে রাখবেন, আপনি অন্য একটা মানুষের সাথে নিজের জীবনটাকে ভাগাভাগি করার অঙ্গীকার করতে যাচ্ছেন। একসাথে থাকা অবস্থায় নিজেদের ভবিষ্যতটা কেমন দেখতে চান, তা আলোচনা করা কি জরুরি নয়? বিয়ে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? কয়টি সন্তান প্রত্যাশা করেন? ভবিষ্যত জীবনের একটা রূপরেখা তৈরি করা পরস্পরকে বুঝার একটা অসাধারণ উপায়। এতে পারস্পরিক অঙ্গীকারগুলো আরও দৃঢ় হয়ে যায়।

বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে দম্পতিরা অনেক মানসিক যন্ত্রণা এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সমস্যার সমাধান খোঁজার চেয়ে সমস্যা যেন তৈরিই না হয়, তা নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম মূল বিষয়। কাজেই আমাদের ইমামগণ এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিবাহপূর্ব পরামর্শ এবং শিক্ষা দানের জন্য প্রশিক্ষন গ্রহণ করা দরকার। এটি হবে সুখী দম্পতি এবং সুস্থ দাম্পত্যের ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিত লাভজনক বিনিয়োগ।

আপনার অভিমত জানান :

১) আপনি কি সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করাকে উপকারী বলে মনে করেন?

২) বিবাহপূর্ব পরামর্শ দানের ক্ষেত্রে আর কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

৩) কীভাবে সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদেরকে বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়?

আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়ে মন্তব্য করুন।

 

Join Pure Matrimony!

শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্‌ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন  - http://www.quraneralo.com/purematrimony/

Facebook: http://www.facebook.com/purematrimonybd

মানুষ কষ্ট দিলে মনের ক্ষত সারাবেন যেভাবে

$
0
0

colorful-flowers-wallpaper_422_84115

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয় হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময় অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক, না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক, অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময় ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।

তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না। কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো, আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি? অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো জিনিস আছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয় করা।

আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন। কুরআন আমাদের বলে :

“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]

নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা হয়েছিল যে:

“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-কামার; ৫৪ : ১০]

নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্‌ যখন বললেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্‌ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ ” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ৩০]

মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে। আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে। তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।

আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো সম্ভব।

উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা, বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্‌ বলেন :

“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ২৫৬]

“আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকেই বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে না। অন্তরে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।

তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি? কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?

আবূ বাক্‌র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন, এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্‌তাহ্‌ নামে তারই এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্‌র অপবাদ আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্‌ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ্‌ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-নূর; ২৪:২২]

এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্‌র (রা) বুঝতে পারলেন যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্‌র ক্ষমা চান। তাই তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে লাগলেন।

মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন :

“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]

‘আমি নিজেও  ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ — নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে, আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্‌র সাথে তুলনা করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা যদি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি, তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :

“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্‌ও তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম; অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]

আল্লাহ্‌র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম, অতুলনীয়।

দৃষ্টি সংযত রাখার মাহাত্ম্য ও মর্যাদা

$
0
0

myosotis

ভাষান্তর : হামিদা মুবাশ্বেরা | সম্পাদনাআব্‌দ আল-আহাদ

আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন,

(হে নবী) আপনি  মু'মিন পুরুষদের বলুন, তারা তাদের দৃষ্টিকে সংযত রাখবে এবং তাদের  লজ্জাস্থানের হিফাযত করবে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই তারা যা করে, সে সম্পর্কে আল্লাহ্‌  সম্যক অবহিত

(সূরা আন-নূর; ২৪ : ৩০)

অতএব, আল্লাহ্‌ পবিত্রতা ও আত্মিক উন্নয়নকে দৃষ্টি সংযত রাখার এবং লজ্জাস্থান হিফাযত করার প্রতিদান হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ নিষিদ্ধ বস্তু থেকে নিজের দৃষ্টি সংযত করার ফলে তিনটি উপকার হয় যেগুলো ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অত্যন্ত মূল্যবান।

প্রথমত : ঈমানের মধুরতা আস্বাদন করা

যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র ভয়ে দৃষ্টি সংযত রাখে, তার কাছে ঈমানের সুমিষ্ট মাধুর্য এবং তা থেকে পাওয়া আনন্দ, নিষিদ্ধ বস্তু দেখে পাওয়া আনন্দের চেয়ে অনেক বেশি মনোহর। বস্তুত, “কেউ যদি আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য কোনোকিছু পরিত্যাগ করে, তবে আল্লাহ্‌ আরও উত্তম কিছুর দ্বারা সেটির প্রতিস্থাপন করেন।”

প্রবৃত্তি হলো নিষিদ্ধকাজে প্রলুব্ধকারী এবং সুন্দর অবয়ব দেখতে ভালোবাসে। আর চোখ হলো হৃদয়ের দিশারী। হৃদয় তার দিশারীকে কোথায় কি আছে, তা খুঁজে দেখার দায়িত্ব দিয়ে বলে, ‘যাও! দেখো, কোথায় কী আছে।’ চোখ যখন সুন্দর কোনো দৃশ্যের খবর দেয়, হৃদয়ে তখন তা পাওয়ার জন্য ভালোবাসার শিহরণ এবং আকাঙ্ক্ষা জাগে। হৃদয় এবং চোখের এই অভ্যন্তরীণ দোলাচল উভয়কেই অনবরত ক্লান্ত করে থাকে। যেমনটি বলা হয়েছে :

চোখকে যেদিন দিশারী বানিয়ে করালে সন্ধান

তোমার চোখের লক্ষ্যবস্তু তোমায় করল হয়রান,

এমন কিছু দেখেলে যাতে ছিল না নিয়ন্ত্রণ,

আংশিকও নয়, নয় পুরোপুরিও;

বরং তোমার জন্য উত্তম ছিল ধৈর্যধারণ।

 কাজেই দৃষ্টিকে যখন কোনোকিছু দেখা এবং নিরীক্ষণ করা থেকে সংযত রাখা হয়, হৃদয়ও তখন নিরর্থক অনুসন্ধান আর কামনার মতো ক্লান্তিকর কাজ থেকে বিশ্রাম পায়।

যে ব্যক্তি নিজের দৃষ্টিকে অবাধে বিচরণের সুযোগ দেবেন, তিনি প্রতিনিয়ত নিজেকে অবিরাম ক্ষতি এবং নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণার মাঝে আবিষ্কার করবেন। কারণ দৃষ্টিপাত থেকেই ভালোবাসার (মুহাব্বাহ্‌) জন্ম হয়, যার সূচনা হয় চোখ যা দেখেছে তার প্রতি মোহাবিষ্ট ও নির্ভরশীল হয়ে পড়ার মাধ্যমে। এই ভালোবাসা ক্রমেই আকুল আকাঙ্ক্ষায় (সাবাবাহ্‌) পরিণত হয়, যার দ্বারা হৃদয় তার কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি বা বস্তুর প্রতি অসংশোধনীয় মাত্রায় মোহাবিষ্ট এবং নির্ভরশীল হয়ে যায়। এর মাত্রা বেড়ে ‘আসক্তি’র (গারামাহ্‌) রূপ নেয়। এই আসক্তি এমন এক শক্তি যা আসক্ত ব্যক্তির পেছনে তেমনিভাবে লেগে থাকে, যেভাবে কোনো পাওয়াদার ঋণ পরিশোধের জন্য ঋণীর পেছনে লেগে থাকে। এই আসক্তি আরও বাড়তে থাকে এবং ‘প্রেমাসক্তি’র (ইশ্‌ক) রূপ নেয় যা সকল প্রকার সীমা ছাড়িয়ে যায়। সবশেষে এর মাত্রা বেড়ে ‘প্রেমোন্মাদনা’র (শাগাফা) জন্ম হয় যা হৃদয়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশকেও বেষ্টন করে ফেলে। এই প্রেমোন্মাদনা ক্রমেই ‘আনুগত্যের ভালোবাসা’য় (তাতাইয়্যুমা) রূপ নেয়। তাতাইয়্যুমা’র অর্থই হলো ইবাদত। যখন বলা হয়, ‘তাইয়্যামা আল্লাহ্‌’, তখন তার অর্থ দাঁড়ায়, ‘সে আল্লাহ্‌র ইবাদত করেছে।’

 

এভাবেই হৃদয় এমন কিছুর উপাসনা করা শুরু করে, যার উপাসনা করা সমীচীন নয়। আর এসব কিছুর পেছনে একমাত্র কারণ একটি নিষিদ্ধ দৃষ্টিপাত। যে হৃদয় পূর্বে ছিল মনিব, তা এখন শিকলাবদ্ধ; যা ছিল মুক্ত ও স্বাধীন, তা এখন কারারুদ্ধ। এই হৃদয় চোখের দ্বারা নির্যাতিত এবং চোখের আছে অভিযোগ করলে, চোখ এখন বলে : ‘আমি তোমার দিশারী এবং আজ্ঞাবাহক। প্রথমে তুমিই আমাকে পাঠিয়েছিলে।’ এখানে যাকিছু বলা হলো, তার সবই এমন সব হৃদয়ের জন্যই সত্য, যেসব হৃদয় আল্লাহ্‌র প্রতি ভালোবাসা ও একনিষ্ঠতাকে পরিত্যাগ করেছে। কারণ ভালোবাসার জন্য হৃদয়ের এমনকিছু চায়, যার প্রতি হৃদয় নিজেকে নিবেদিত রাখতে পারে। সে কারণেই, হৃদয় যখন শুধুমাত্র আল্লাহ্‌কে ভালোবাসে না এবং শুধু তাঁকেই উপাস্য হিসেবে গ্রহণ করে না, তখন নিশ্চিতভাবে সে অন্যকিছুর উপাসনায় লিপ্ত থাকে। আল্লাহ্‌ ইউসুফ (আ) সম্পর্কে বলেন :

এভাবেই যাতে আমি তার থেকে অনিষ্ট অশ্লীলতা দুর করে দেই। নিশ্চয়ই সে আমার নিষ্ঠাবান বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত

(সূরা ইউসূফ; ১২ : ২৪)

আযীযের স্ত্রী একজন বিবাহতা নারী হওয়া সত্ত্বেও তার হৃদয়ে প্রেমাসক্তি প্রবেশ করেছিল। কারণ সে ছিল মুশরিকা। অন্যদিকে, ইউসুফ (আ) যুবক, অবিবাহিত এবং চাকর হওয়া সত্ত্বেও সেই অপকর্ম থেকে তাঁকে রক্ষা করা হয়েছিল। কারণ তিনি ছিলেন আল্লাহ্‌র একনিষ্ঠ গোলাম।

দ্বিতীয়ত : আলোকিত হৃদয়, স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি

ইবনু সুজা‘আ আল-কিরমানি বলেছেন, “যে ব্যক্তি নিজের বাহ্যিক অবয়বকে সুন্নাহ্‌র আদলে এবং অভ্যন্তরীণ সত্ত্বাকে সর্বদা আল্লাহ্‌র চিন্তা-গবেষণা এবং তাঁর সচেতনতার আলোকে গড়ে তোলে, নিজের আত্মাকে প্রবৃত্তির অনুসরণ করা থেকে এবং নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখে, সর্বদা হালাল রুজি ভক্ষণ করে, সেইব্যক্তির উপলব্ধি এবং অন্তর্দৃষ্টি কখনোই ভুল হবে না।”

আল্লাহ্‌ লূতের (আ) সম্প্রদায়কে কীভাবে শাস্তি দিয়েছিলেন, সে কথা উল্লেখ করে বলেছেন :

“নিশ্চয়ই এতে ‘মুতাওয়াস্‌সিমীন’দের (স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন) জন্য রয়েছে নিদর্শনমালা

(সূরা আল হিজ্‌র; ১৫:৭৫)

মুতাওয়াস্‌সিমীন হলেন তারাই যারা স্বচ্ছ উপলব্ধিবোধ এবং তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন। তারা হারাম বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না এবং অশ্লীল কর্ম সম্পাদন করা থেকে বিরত থাকেন।

দৃষ্টি সংযত করা সম্পর্কিত আয়াতের পরবর্তী আয়াতেই আল্লাহ্‌ বলেছেন:

আল্লাহ্‌ আসমানসমুহ যমীনের নূ।...” (সূরা আন-নূর; ২৪:৩৫)

এর কারণ হলো, কর্ম যেমন, কর্মের প্রতিদানও তেমন হয়। অতএব, যে কেউ আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টির জন্য নিষিদ্ধ বস্তু থেকে দৃষ্টিকে সংযত রাখবে, আল্লাহ্‌, আযযা ওয়া জাল্লা, সেইব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ বস্তুকে অনুরূপ অথচ তার চেয়ে অধিক উত্তম বস্তু দ্বারা প্রতিস্থাপন করবেন। তাই বান্দা যেহেতু তার চোখের আলোকে নিষিদ্ধ বস্তুর উপর পড়তে দেয়নি, আল্লাহ্‌ সেই বান্দার দৃষ্টি এবং অন্তরের আলোকে অনুগ্রহ দান করেন। ফলে ব্যক্তি সেইসব বিষয় বুঝতে এবং উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন, দৃষ্টি সংযত না করলে যেগুলো বুঝা এবং উপলব্ধি করা তার জন্য সম্ভব হতো না।

ব্যক্তি নিজের মধ্যে এই বিষয়টি আক্ষরিক অর্থেই উপলব্ধি করতে পারেন। কারণ হৃদয় একটা আয়নার মতো এবং পাশবিক প্রবৃত্তিগুলো সেই আয়নার উপর মরিচার মতো। এই আয়না যখন সচ্ছ এবং পরিষ্কার থাকে, তখন তাতে বাস্তবতার (হাকাইক) আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটে। কিন্তু যদি তাতে মরিচা পড়ে থাকে, তাহলে তাতে সুষম প্রতিফলন তৈরি হয় না। ফলে হৃদয়ে অনুমান এবং সন্দেহ নির্ভর জ্ঞান ও অভিব্যক্তির উন্মেষ ঘটবে।

তৃতীয়ত : হৃদয় হবে শক্তিশালী, দৃঢ় এবং সাহসী

 

দৃষ্টির আলোর জন্য আল্লাহ্‌ যেভাবে চোখকে সুস্পষ্ট প্রমাণের সহায়ক শক্তি দিয়েছেন, হৃদয়ের দৃঢ়তার জন্যও তিনি হৃদয়কে সহায়ক শক্তি দান করবেন। এভাবে হৃদয়ে দুধরণের উপাদনের সমন্বয় ঘটবে। ফলে হৃদয় থেকে শয়তান বিতাড়িত হবে। হাদীসে উল্লেখ আছে, “কেউ যদি নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির বিরোধিতা করে, ভয়ে শয়তান তার ছায়া থেকেও পালিয়ে বেড়ায়।”

একারণেই যে ব্যক্তি নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে, সে নিজের মাঝে গ্লানিময় আত্মাকে খুঁজে পায় — যে আত্মা দুর্বল, শক্তিহীন, ঘৃণার যোগ্য। বস্তুত, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌কে মান্য করেন, আল্লাহ্‌ তার জন্য উচ্চমর্যাদা নির্ধারণ করেন। আর তাঁকে অমান্যকারীর জন্য আল্লাহ্‌ লাঞ্ছনা নির্ধারণ করেন:

“আর তোমরা দুর্বল হয়ো না এবং দুঃখিত  হয়ো না, আর তোমরা বিজয়ী হবে, যদি মু’মিন হয়ে থাকো

(সূরা আল–ইমরান; ৩:১৩৯)

“কেউ যদি সম্মান চায় (তবে তা যেন আল্লাহ্‌র কাছেই চায়), কেননা সকল সম্মান আল্লাহ্‌রই।”

(সূরা ফাতির; ৩৫:১০)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র (আয্‌যা ওয়া জাল্লা) চেয়ে অবাধ্যতা এবং পাপকর্মকেই বেশি প্রাধান্য দেবে, আল্লাহ্‌ সেই বিরুদ্ধাচরণকারীকে লাঞ্ছিত করবেন। সালাফদের অনেকেই বলেছেন, “সম্মানের খোঁজে মানুষ রাজাদের দ্বারে যায়। অথচ আল্লাহ্‌র আনুগত্য ছাড়া কোনো সম্মান নেই।” কারণ যারা আল্লাহ্‌র আনুগত্য করে, তারা আল্লাহ্‌কে নিজেদের বন্ধু এবং রক্ষাকারী হিসেবে গ্রহণ করে। আর যারা আল্লাহ্‌কে তাদের রব এবং পৃষ্ঠপোষক হিসেবে গ্রহণ করে, আল্লাহ্‌ কখনোই তাদেরকে অসম্মানিত করেন না। একটি দো‘আ কুনূতে এ কথাগুলোই বলা হয়েছে: “যাকে আপনি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে অপমানিত হয় না আর যাকে আপনি শত্রু হিসেবে গ্রহণ করেন, সে সম্মানিত হয় না।”

(সূত্র : শায়েখ ইবনুল কায়্যিম, আল-মুন্‌তাকা মিন ইক্‌হাসাতুল লুফ্‌হান ফী মাসায়্যিদ আশ-শায়তান, পৃষ্ঠা ১০২-১০৫। পরিমার্জন : আলি হাসান।)

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা

$
0
0

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

keeping ties

আত্মীয়তা-সম্পর্ক ও এর মাহাত্ম্য

এটি এমন এক বিষয় যার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের ধন-সম্পদে বরকত দেন। এটি হলো আত্মীয়তা-সম্পর্ক। আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা যে জরুরী, আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্ন করা যে হারাম আর আত্মীয়দের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কুরআনে কারিমে এবং হাদীসে অনেক বাণী উল্লিখিত হয়েছে। আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে তাদের প্রশংসায় তিনি ইরশাদ করেন,

﴿وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ (21) ﴾

‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে।’[সূরা আর-রা‘দ : ২১]

পক্ষান্তরে যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না তীব্র ভাষায় তাদের ভৎর্সনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]

যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদেরকে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]

রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾

‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক।’[সূরা আন-নিসা : ০১]

এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আত্মীয়তা-সম্পর্ক অক্ষুণ্ন  রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন।

প্রিয় পাঠক, আমরা কি আল্লাহর বাণীর মর্ম অনুধাবন করেছি? আমরা কি রাব্বুল আলামিনের ডাকেন সাড়া দেব না? নাকি এরপরও আমরা আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো? নিজেদের গোমরাহিতে ডুবে থাকবো? আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবো? আর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালনে উদাসীন থাকবো?

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের সৃজন কাজ শুরু করেন। যখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর আশ্রয়স্থান’। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রব’। তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ :

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’[{আয়াত সূরা মুহাম্মদ : ২২} বুখারী : ৫৯৮৭]

আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

. إنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تُنَادِي بِلِسَانٍ لَهَا ذُلَقٍ : اللَّهُمَّ صِلْ مَنْ وَصَلَنِي ، وَاقْطَعْ مَنْ قَطَعَنِي.

‘নিশ্চয় আত্মীয়তা-সম্পর্ক আরশকে আকঁড়ে ধরা একটি কাণ্ড, যা জিহ্বার ডগা দিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সাথে জুড়ো যে আমার সাথে জুড়ে আর তুমি তাকে ছিন্ন করো যে আমাকে ছিন্ন করে।’ তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা বলেন, ‘রহীম রহমান (আমি দয়ালু, পরম করুণাময়) আর ‘রাহীম’ (الرحم)  তথা আত্মীয়তা-সম্পর্ক শব্দটিকে আমার নাম থেকে বের করেছি। সুতরাং যে এর সাথে সুসম্পর্ক রাখবে আমি তার সাথে সুম্পর্ক রাখবো আর যে এ সম্পর্ক ভঙ্গ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ করবো।’[ইবন আব্দির রাজজাক, মুসান্নফ : ২৫৯০১]

আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হেরাকল তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবরণ জানতে চান। জবাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে :

يَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ.

‘তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিত শুভ্রতা ও আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।’[বুখারী : ৫৯৮০]

আমরা এ থেকে জানতে পারি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সূচনাকালে যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি দু‌ভাবে। এক. কিছু কাজ করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের সঙ্গে সদাচার অব্যাহত রাখা। দুই. কিছু কাজ না করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের কষ্ট না দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট না করা। প্রথমটি আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ স্তর আর দ্বিতীয়টি সর্বনিম্ন স্তর।

উল্লেখ করা দরকার, আত্মীয়তা-সম্পর্ক আবার কয়েক ধরনের। প্রথম. সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক। এটি আসলে দীনদারির ভিত্তিতে সম্পর্ক, যা তাকওয়ার একটি শাখাও বটে। এটি অর্জিত হয় নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে :

একে অন্যের শুভ কামনা করা, পরামর্শ নেয়া, পরস্পরকে ভালোবাসা, ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা, ওয়াজিব বা জরুরী হক এবং যথাসাধ্য নফল বা ঐচ্ছিক হকসমূহ আদায় করা, মানুষকে সুশিক্ষা দেয়া, সুপথ দেখানো, দিক-নির্দেশনা দেয়া, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অন্যের দুখে সমব্যথী হওয়া এবং মানুষের জন্য কষ্ট দূর করা। আর আমরা তো জানিই যে, মুসলিম ভাইয়ের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা।

 

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত লম্বা হয় এবং ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এটি কিন্তু যার তার কথা নয়; মহা সত্যবাদী, চরম শত্রু  কাফেরদের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা বিশ্বস্ত উপাধী লাভকারী আল্লাহর নবীর ওয়াদা, যার সম্পর্কে কুরআনে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এভাবে,

﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4) ﴾

‘তিনি আর মনগড়া কথা বলেন না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়।’[সূরা আন-নাজম : ৩-৪]

তিনি ইরশাদ করেন,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ

‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখে।’[বুখারী : ৫৯৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৯]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলে গেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য যে অন্য পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও নিজের পক্ষ থেকে তা জোড়া লাগায়। পক্ষান্তরে যার সাথে সম্পর্ক বহাল রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করলে ব্যাস তা হবে সর্বোচ্চ ভালো সম্পর্কের প্রতিদানে ভালো সম্পর্ক। এটি যদিও আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যেই পড়ে কিন্তু যে ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক জুড়বে তার সওয়াব অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অনেক বড়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنْ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا

‘সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রাকারী সেই, যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরলে সে তা জোড়া দেয়।’[বুখারী : ৫৯৯১]

মহান এই দীনে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সাথে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي قَالَ نَعَمْ صِلِي أُمَّكِ

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো।’[বুখারী : ২৬২০; মুসলিম : ২৩৭২]

প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রিয় ধর্মে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মর্যাদা এমনই। আমরা কি আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত? আমরা পালন করি তাঁর নির্দেশ? বর্জন করি তার নিষেধকৃত বিষয়গুলো? ভেবে দেখুন, আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি? তাদের খোঁজ-খবর নেই? আমরা তাদের সাথে যোগাযোগহীনতা, তাদের ব্যাপারে অন্তরের অনুদারতাকে ক্ষমার যোগ্য ভাবছি?

হে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশী ভাই, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখুন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করবেন না কখনো। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখলে, তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখলে কত বেশি সওয়াব আর কত লাভ তা সবসময় মনে রাখবেন।

জানেন কি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখলে কত লাভ?এর লাভ দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে। সংক্ষেপে সেদিকে ইশারা করছি :

ক.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রকাশ।

খ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা রিজিক ও হায়াত বৃদ্ধির কারণ।

গ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।

 

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরী বুযুর্গদের উক্তি  

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশগতি বিদ্যা শিক্ষা করো অতপর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করো। আল্লাহর কসম! নিশ্চয় তোমাদের একজনের সাথে তার ভাইয়ের বিবাদ হবে, যদি সে জানতো তার ও এর মাঝে আত্মীয়তা-সম্পর্কের কী গুরুত্ব রয়েছে তাহলে তা তাদের এই সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখতো।’ (তাফসিরে তাবারী : ১/১৪৪)

আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন, ‘আমি আমার আত্মীয়র জন্য এক টাকা খরচ করাকে দরিদ্র ব্যক্তির জন্য এক হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে উত্তম মনে করি। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবু মুহাম্মদ, যদি আত্মীয়টি ধনাঢ্যতায় আমার মতো হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি সে তোমার চেয়েও বড় বিত্তশালী হয় তবুও।’ (ইবনে আবিদ্দুনিয়া, মাকারিমুল আখলাক : ৬২ পৃ.)

সাঈদ বিন মুসায়্যাব রহ. কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি টাকা কেবল নিজের দীন ও বংশকে নিরাপদ রাখার জন্য সঞ্চয় করেছি। যে ব্যক্তি অর্থ সঞ্চয় করল না আর তা দিয়ে অন্যের পাওনা পরিশোধ করল না এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারল আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না, তাতে কোনো কল্যাণ নেই।’ (ইবনে মুফলিহ, আদাবে শরইয়্যা : ৩/২৬২।)

আমর বিন দিনার রহ. বলেন, ‘নিশ্চিত জেনো, ফরজ আদায়ের জন্য কদম ফেলার সর্বোত্তম পদক্ষেপ সেটি, যা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রার জন্য ফেলা হয়।’

সুলাইমান বিন মুসা রহ. বলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, আত্মীয়তা-সম্পর্কের হক কী? তিনি বললেন, যখন সে এগিয়ে আসে তখন তাকে স্বাগত জানানো আর যখন সে পিছিয়ে যায় তখন তার পেছনে যাওয়া।’ (প্রাগুক্ত)

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে সতর্কিকরণ

এ আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যেমন অনেক সওয়াব ও বড় নেকি রয়েছে, তেমনি তা নষ্ট করার মধ্যে রয়েছে অনেক গুনাহ ও ক্ষতিকারিতা। যেমন : বলা হয়েছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারী জান্নাতে যাবে না। জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’[বুখারী : ৬৬৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৭]

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে এ সম্পর্ক ছিন্নকারী যেন উত্তপ্ত বালি ভক্ষণ করে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمْ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنْ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় রয়েছে- আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি আর তারা তা নষ্ট করে, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি আর তারা আমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে এবং তারা আমার সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে আর আমি তাদের আচরণে ধৈর্য্য ধরি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘটনা যদি তেমনই হয় যেমন তুমি বলছো, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত বালু খাওয়াচ্ছো আর যতক্ষণ তুমি তোমার এ অবস্থানে থাকবে, তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী থাকবে।’[বুখারী : ৬৬৮৯; মুসলিম : ৪৬৪০]

তাছাড়া আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর লানত ও শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদে কে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]

আর আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকরার সবচেয়ে বড় নমুনা হলো পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা। তারপর যে সবচেয়ে কাছের তার সাথে, তারপর যে সবচেয়ে নিকটতর তার সাথে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ

‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করবো না? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া।’[বুখারী : ২৬৫৪; মুসলিম : ২৭০]

হায় আল্লাহ! পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ যে আল্লাহর সাথে শিরকের সাথে সাথেই এর কথা বলা হয়েছে!

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করার আরেকটি হলো, আখিরাতের আগেই দুনিয়াতে এর শাস্তি প্রদান করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْعُقُوبَةَ لِصَاحِبِهِ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা ও জুলুমের চেয়ে অধিক উপয্ক্তু কোনো অপরাধ নেই যার শাস্তি সত্বরই দুনিয়াতে দেয়া হয়। অথচ আখিরাতের শাস্তি তার জন্য বরাদ্দই থাকে।’[মুসনাদে আহমদ : ২০৪১৪]

আল্লাহকে ভয় করার আহ্বান  

অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ, আল্লাহকে ভয় করুন এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখুন। আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করুন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে উপহার দেয়া, তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখুন ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নম্র কথা, হাসিমুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমাজে প্রচলিত সব ধরনের আত্মীয়তা রক্ষার উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে। কামিয়াব হোন এর দ্বারা দুনিয়াতে ও আখিরাতে।  আর অবশ্যই আপনারা এ সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। কারণ তা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

 

সৌভাগ্যময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপায় পর্ব –১

$
0
0
সংকলন: শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী | অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম | সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও মোঃ আব্দুল কাদের
পর্ব -১ | পর্ব - ২

الحمد لله وحده و الصلاة و السلام على من لا نبي بعده و على آله و صحبه أجمعين و من تبعه إلى يوم الدين

সমস্ত প্রশংসা এক আল্লাহর জন্য; আর সালাত (দুরূদ) ও সালাম নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি, যার পরে আর কোন নবী নেই এবং শান্তি বর্ষিত হউক তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীবৃন্দ ও যারা কিয়ামত পর্যন্ত নিষ্ঠার সাথে তাঁর আনুগত্য করবেন তাদের প্রতি।

১. ঈমান ও সৎকর্ম: সৌভাগ্যময় জীবন লাভের অন্যতম প্রধান ও আসল উপায় হল ঈমান ও সৎকর্ম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ مَنۡ عَمِلَ صَٰلِحٗا مِّن ذَكَرٍ أَوۡ أُنثَىٰ وَهُوَ مُؤۡمِنٞ فَلَنُحۡيِيَنَّهُۥ حَيَوٰةٗ طَيِّبَةٗۖ وَلَنَجۡزِيَنَّهُمۡ أَجۡرَهُم بِأَحۡسَنِ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ﴾ [النحل:97]

মুমিন হয়ে পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে কেউ সৎকাজ করবে, তাকে আমি নিশ্চয়ই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের কর্মের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার দান করব।”— [ সূরা আন-নাহল: ৯৭]

সুতরাং যে ব্যক্তি ঈমান ও সৎ আমলের সমন্বয় সাধন করতে পারবে, তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা ইহকালে পবিত্রময় জীবনের এবং ইহকালে ও পরকালে উত্তম প্রতিদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

আর এর কারণ সুস্পষ্ট। কেননা, মুমিনগণ আল্লাহর প্রতি বিশুদ্ধ ঈমানের ফলে সৎকাজ করে এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য মন-মানসিকতা ও নৈতিক চরিত্রকে সংশোধন করে। তাদের সাথে মৌলিক নীতিমালা রয়েছে, যার দ্বারা তারা তাদের নিকট উপস্থাপিত সকল প্রকার হাসি-আনন্দ, অস্থিরতা ও দুঃখ-বেদনার কারণসমূহ উপলব্ধি করতে পারে।Hapylife

এই নীতিমালা গ্রহণ, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও উপকারী ক্ষেত্রে তার যথাযথ ব্যবহার দ্বারা তারা রাগ-বিরাগ ও অন্যায়-অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারে। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকে তারা যখন তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করবে, তখন এর দ্বারা তাদের জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে, তার স্থায়িত্ব ও বরকতের ব্যাপারে আশা জাগবে এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারীদের সাওয়াবের প্রত্যাশা তৈরি হবে। এর ফলে সৃষ্ট এই আনন্দের কল্যাণ ও বরকতের দ্বারা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতিষ্ঠিত হবে।

আর তারা উপলব্ধি করতে পারবে দুঃখ-কষ্ট, ক্ষয়-ক্ষতি ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে। এ ক্ষেত্রে তাদের পক্ষে প্রতিরোধ করা সম্ভব হলে পরিপূর্ণ প্রতিরোধ করবে; তার কিছুটা লাঘব করা সম্ভব হলে লাঘব করবে এবং প্রতিরোধের কোন উপায় না থাকলে সর্বোত্তম ধৈর্য ধারণ করবে। আর এর দ্বারা তাদের দুঃখ-কষ্টের প্রভাব বলয় থেকে বের হয়ে আসার যথাযথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও শক্তি-সামর্থ সঞ্চয় হবে। ধৈর্য এবং প্রতিদান ও সওয়াবের আশা পোষণ করা বড় মর্যাদাপূর্ণ কাজ, যার সাথে দুঃখ-কষ্ট মিশে আছে। আর তার থেকে উত্তরণের উপায় হল আনন্দে থাকা, উত্তম আশা-আকাঙ্খা পোষণ করা এবং আল্লাহর অনুগ্রহ ও সওয়াবের প্রত্যাশা করা। যেমন বিশুদ্ধ হাদিসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ ».

“মুমিনের কর্ম-কাণ্ডে অবাক হওয়ার বিষয় হল তার সকল কাজই মঙ্গলজনক। সে সুখ-শান্তি লাভ করলে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর দুঃখ-কষ্টে পতিত হলে সে ধৈর্য ধারণ করে; ফলে তাও তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর এই সুযোগ মুমিন ব্যতীত অন্য কারও ভাগ্যে জুটে না।”— [মুসলিম, যুহুদ, বাব-১৪, হাদিস নং-৭৬৯২]

সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিলেন যে, মুমিনের প্রাপ্তি ও কল্যাণ দিগুণ। হাসি-আনন্দ ও দুঃখ-কষ্ট সকল অবস্থায়ই সে তার কর্ম-কাণ্ডের সুফল ভোগ করবে। এ জন্যই আপনি দু’টি জিনিস পাবেন, যেগুলো কল্যাণ বা অকল্যাণের প্রতিনিধিত্ব করে। আবার উভয়ের অর্জন পদ্ধতির মধ্যে ব্যবধানও অনেক। আর এই ব্যবধানটি হবে ঈমান ও সৎকর্মের ক্ষেত্রে উভয়ের পার্থক্য অনুযায়ী। এই গুণের অধিকারী ব্যক্তি এ দু’টি গুণ দ্বারা কল্যাণ ও অকল্যাণ লাভ করে, যা আমরা আলোচনা করেছি; যেমন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, ধৈর্য ধারণ ইত্যাদি। এতে করে তার জন্য আনন্দঘন পরিবেশ সৃষ্টি হবে; দূর হয়ে যাবে দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা, হৃদয়ের সংকীর্ণতা ও জীবনের দুঃখ-কষ্ট এবং ইহজগতে তার জীবন হয়ে উঠবে অর্থবহ ও সুখময়।

আর অপর ব্যক্তি অপকর্ম, দাম্ভিকতা ও স্বেচ্ছাচারিতা দ্বারা অপরাধ প্রবণ হয়ে উঠে। ফলে তার নৈতিকতা বিনষ্ট হয় এবং অধৈর্য ও অতি লোভের কারণে তার নৈতিক চরিত্র পশুর চরিত্রের মত গড়ে উঠে। এতদ্ব সত্ত্বেও সে মানসিকাবে অশান্ত ও অস্হির। তার এই অস্থিরতার পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে; যেমন তার প্রিয়াদেরকে হারানোর আশঙ্কা ও তাদের পক্ষ থেকে নতুন নতুন বহু দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা; আরও একটি কারণ হচ্ছে নফসের অস্থিরতা, যা অর্জন করুক আর নাই করুক সার্বক্ষণিক আরও কিছু পেতে আগ্রহবোধ করে। সে যদি নির্ধারিত অংশ পেয়েও যায়, তবুও সে উল্লেখিত কারণে (নতুন নতুন পেতে) অস্থির হয়ে উঠে। আর এসব উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও অসন্তুষ্টির কারণে সে দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে। সুতরাং তার দুর্ভাগ্যময় জীবন, স্বজনপ্রীতি ও চিন্তারোগ এবং ভয়-ভীতি যা তাকে খারাপ অবস্থা ও বীভৎস কষ্টের দিকে ঠেলে দিয়েছে; তার এমন পরিণতি নিয়ে প্রশ্ন করো না। কারণ, সে সওয়াবের আশা করে না। আর তার নিকট ধৈর্যের মত এমন সম্পদও নেই যা তাকে শান্তনা ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য দেবে।

আর এ ধরনের প্রত্যেকটি বর্ণনাই অভিজ্ঞতালব্ধ বাস্তব উদাহরণ। যেমন এই শ্রেণীর একটি বিষয়কে নিয়ে যখন আপনি চিন্তা-ভাবনা করবেনে এবং তাকে মানুষের বাস্তব অবস্থার সম্মুখে উপস্থাপন করবেন, তখন ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমলকারী মুমিন ব্যক্তি ও যে ব্যক্তি এমন কাজ করেনি তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক বড় ব্যবধান দেখতে পাবেন। আর সে বিষয়টি হল, আল্লাহ প্রদত্ত রিযিক ও তিনি তাঁর বান্দাদেরকে বিভিন্ন প্রকারের যেসব অনুগ্রহ ও সম্মান দান করেছেন, তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে দীন-শরীয়ত অনেক বেশি উৎসাহ প্রধান করেছে।

 সুতরাং মুমিন যখন অসুস্থতা অথবা দারিদ্র অথবা অনুরূপ কোন মান-সম্মান বিনষ্টকারী বিপদ-মুসিবত দ্বারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়, তখন তার ঈমান ও আল্লাহ প্রদত্ত রিযিকের প্রতি সন্তুষ্ট থাকার কারণে আপনি তার চোখে-মুখে আনন্দের ঝলক দেখতে পাবেন এবং সে আন্তরিকভাবে এমন কিছু চাইবে না, যা তার ভাগ্যে নেই। এ অবস্থায় সে তার চেয়ে খারাপ অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে শান্তনা অনুভব করে; তার চেয়ে ভাল অবস্থাশালী ব্যক্তির দিকে তাকায় না। কোন কোন সময় তার আনন্দ-ফুর্তি ও মনের প্রফুল্লতা আরও বৃদ্ধি পায় ঐ ব্যক্তির অবস্থা দেখে, যে ব্যক্তি দুনিয়াবী সকল উদ্দেশ্য হাসিল করেও পরিতৃপ্ত হতে পারেনি।

অনুরূপভাবে যে ব্যক্তির নিকট ঈমানের দাবি অনুযায়ী আমল নেই, তাকে যখন অভাব-অনটন দ্বারা অথবা দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়ার কিছু থেকে বঞ্চিত করার দ্বারা পরীক্ষায় ফেলা হয়, তখন তাকে আপনি দুঃখ-কষ্টে চরম বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে পাবেন।

অপর আরেকটি দৃষ্টন্ত হল: যখন ভয় ও আতঙ্কের কারণসমূহ প্রকাশ পায় এবং মানুষ নানান অসুবিধা দ্বারা কষ্ট অনুভব করে, তখন তার মধ্যে বিশুদ্ধ ঈমান, দৃঢ় মনোবল, মানসিক প্রশান্তি এবং উদ্ভূত এই সঙ্কট মোকাবিলায় চিন্তায়, কথায় ও কাজে সামর্থবান হওয়ার মত গুণাবলী বিদ্যমান থাকে, তবে সে নিজেকে এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতেও প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আর এই পরিস্থিতি মানুষকে আনন্দ দেবে এবং তার হৃদয়কে মজবুত করবে।

অনুরূপভাবে আপনি ঈমান হারা ব্যক্তিকে পাবেন সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থায়। যখন সে ভয় ও আতঙ্কের অবস্থায় পতিত হবে, তখন তার হৃদয় অস্বস্তি অনুভব করবে; স্নায়ুতন্ত্রগুলো দুশ্চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে উঠবে; তার অভ্যন্তরে বিরাজ করবে ভয় ও আতঙ্ক এবং তার মধ্যে বিরাজ করবে বাহ্যিক আতঙ্ক ও অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা। ফলে তার বাস্তব অবস্থা উদ্ঘাটন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। আর এ শ্রেণীর মানুষের যদি স্বভাবগত উপায়-উপকরণ বা উদ্দেশ্যসমূহ হাসিল না হয়, যা অর্জনে অনেক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন; তবে তাদের শক্তি-সামর্থ ভেঙ্গে পড়বে এবং স্নায়ুতন্ত্রগুলো উত্তেজিত হয়ে উঠবে। আর এরূপ হবে ঈমানের ঘাটতির কারণে, যা ধৈর্যধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রখে। বিশেষ করে সঙ্কটকালে ও দুঃখ-দুর্দশার সময়ে।

সুতরাং পুণ্যবান ও পাপী, মুমিন ও কাফির উভয়ে অর্জনীয় বীরত্ব অর্জনে অংশগ্রহণ করে। আরও অংশীদারিত্ব রয়েছে এমন স্বভাব-চরিত্রে, যা ভয়ানক পরিস্থিতিতে সদয় হয় এবং বষয়টিকে সহজ করে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মুমিন ব্যতিক্রম তার ঈমানী শক্তি, ধৈর্য, আল্লাহর উপড় ভরসা ও নির্ভরশীলতা এবং তার সওয়াবের প্রত্যাশার কারণে। এসব বিষয়ের কারণে তার সাহস ও বীরত্ব আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে, আতঙ্কের চাপ কমতে থাকে এবং তার নিকট কঠিন কাজগুলো সহজ হতে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ إِن تَكُونُواْ تَأۡلَمُونَ فَإِنَّهُمۡ يَأۡلَمُونَ كَمَا تَأۡلَمُونَۖ وَتَرۡجُونَ مِنَ ٱللَّهِ مَا لَا يَرۡجُونَۗ ﴾ [النساء:104]

“যদি তোমরা যন্ত্রণা পাও, তবে তারও তো তোমাদের মতই যন্ত্রণা পায় এবং আল্লাহর নিকট তোমরা যা আশা কর, তারা তা আশা করে না।” — [ সূরা আন-নিসা: ১০৪]

আর তারা আল্লাহর বিশেষ সাহায্য লাভ করে এবং তার সাহায্য সকল প্রকার ভয়-ভীতিকে ওলট-পালট করে দেয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ ﴾ [الأنفال:46]

“তোমরা ধৈর্যধারণ কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।”[সূরা আল-আনফাল: ৪৬]

 

২. সৃষ্টির প্রতি ইহসান: উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম উপায় হচ্ছে কথা, কাজ ও বিভিন্ন প্রকারের সদ্ব্যবহার দ্বার সৃষ্টির প্রতি ইহসান করা। উল্লেখিত প্রতিটি কাজই উত্তম ও ইহসান। এর দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা পুণ্যবান ও পাপীর কর্ম-কাণ্ড অনুসারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করেন। কিন্তু তার থেকে মুমিনের জন্যই পরিপূর্ণ অংশ রয়েছে। আর সে ব্যতিক্রম এই জন্য যে, তার ইহসানের কার্যক্রম পরিচালিত হয় ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায়। ফলে আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য সহজ করে দেন তার প্রত্যাশিত কল্যাণকর কাজের মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করতে। আর তিনি তার ইখলাস ও আন্তরিকতার কারণে সকল দুঃখ-কষ্ট দূর করে দেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ لَّا خَيۡرَ فِي كَثِيرٖ مِّن نَّجۡوَىٰهُمۡ إِلَّا مَنۡ أَمَرَ بِصَدَقَةٍ أَوۡ مَعۡرُوفٍ أَوۡ إِصۡلَٰحِۢ بَيۡنَ ٱلنَّاسِۚ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ ٱبۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ ٱللَّهِ فَسَوۡفَ نُؤۡتِيهِ أَجۡرًا عَظِيمٗا ﴾ [النساء:114]

“তাদের অধিকাংশ গোপন পরামর্শে কোন কল্যাণ নেই, তবে কল্যাণ আছে যে নির্দেশ দেয় দান-খয়রাত, সৎকাজ ও মানুষের মধ্যে শান্তি স্থাপনের; আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় কেউ তা করলে তাকে অবশ্যই আমি মহাপুরস্কার দান করব।” —[সূরা আন-নিসা: ১১৪]

সুতরাং তার থেকে সংঘটিত এ ধরনের সকল কর্মকাণ্ডকে আল্লাহ তা‘আলা কল্যাণময় বলে ঘোষণা করেছেন। আর কল্যাণ মানেই কল্যাণকে স্বাগত জানায় এবং অকল্যাণকে প্রতিরোধ করে। আর সওয়াবের প্রত্যাশী মুমিনকে আল্লাহ মহাপুরস্কার দান করবেন। আর সকল প্রকার বড় পুরস্কারের মধ্যে অন্যতম পুরস্কার হচ্ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, দুঃখ-কষ্ট ইত্যাদি দূর করে দেয়া।

 ৩. কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা: স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা জনিত অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতার মধ্যে ডুবে থাকা মনকে দূরে রাখার অন্যতম উপায় হচ্ছে কাজ-কর্ম ও উপকারী জ্ঞান অর্জনে ব্যস্ত থাকা। কেননা, তা মনকে ঐসব কর্ম-কাণ্ড থেকে বিরত রাখে, যা তাকে অস্থির করে তোলে। এ কারণে সে কোন কোন সময় ঐসব কারণকে ভুলে থাকবে, যা তাকে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে বাধ্য করে। ফলে সে মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করবে এবং তার মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু মুমিন অন্যান্যদের থেকে ব্যতিক্রম তার ঈমান ও ইখলাসের সাথে সওয়াবের প্রত্যাশায় জ্ঞান অর্জন ও শিক্ষাদান ব্যবস্থায় কর্মতৎপর হওয়ার পাশাপাশি উত্তম আমল করার কারণে। যদি তা ইবাদত কেন্দ্রিক হয়, তবে তা ইবাদত হিসেবেই গণ্য হবে। আর তা যদি দুনিয়াবী অথবা প্রকৃতিগত কোন কর্ম-কাণ্ড হয়ে থাকে, তবে তার ফলাফল নিয়তের বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করবে। আর সে যদি এর দ্বারা আল্লাহর আনুগত্যের ব্যাপারে সাহায্য কামনা করে, তবে তার এ কাজের প্রভাবে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর হবে। সুতরাং মনের অস্থিরতা ও পাপ-পঙ্কিলতা দ্বারা পরীক্ষা করা হয়; অতঃপর এর কারণে সে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার প্রতিষেধক ঔষধ হচ্ছে: “ঐ কারণটিকে ভুলে থাকা, যা তাকে পাপ-পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত রাখা।”

 ৪. সকল চিন্তাকে দৈনন্দিন কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করার অন্যতম আরও একটি উপায় হল সকল চিন্তাকে চলমান (বর্তমান) দিনের কাজের গুরুত্বের উপর ঐক্যবদ্ধ করা এবং ভবিষ্যতকালীন ও অতীতকালীন কর্ম-কাণ্ড নিয়ে বেশি চিন্তা-ভাবনা বন্ধ করা। এ জন্যই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর নিকট সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে আশ্রয় চেয়েছেন, যা ইমাম বুখারী ও মুসলিম র. বর্ণিত হাদিসে রয়েছে। সুতরাং অতীতের কোন বিষয় নিয়ে দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই, যা কোন দিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। আর ভবিষ্যতকালে কোন দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কায় দুশ্চিন্তায় মগ্ন থাকাও ক্ষতিকর। অতএব বান্দার দায়িত্ব ও কর্তব্য হল তার আজকের দিন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা এবং তার সকল চেষ্টা-প্রচেষ্টা ঐ দিন তথা বর্তমান সময়কে ভাল করার কাজে ব্যয় করা। কারণ, এই দিকে মনোযোগ দিলেই তার কর্ম-কাণ্ডসমূহ পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ হবে এবং তার দ্বারা বান্দা দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে শান্তি লাভ করতে পারবে। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোন দো‘আ করতেন অথবা তাঁর উম্মতকে দো‘আ করতে বলতেন, তখন তিনি আল্লাহর সাহায্য ও অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে যা পাওয়ার জন্য দো‘আ করা হয়, তা অর্জনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালানোর জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন। আর যা দূর করার জন্য দো‘আ করা হত, তা থেকে দূরে সরে থাকতে উৎসাহ দিতেন। কারণ, দো‘আ আমলের মতই। সুতরাং বান্দা দীন ও দুনিয়ার ক্ষেত্রে তার উপকারী বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে এবং তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার প্রতিপালকের নিকট প্রার্থনা করবে। আর এই ব্যাপারে তাঁর নিকট সাহায্য চাইবে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« الْمُؤْمِنُ الْقَوِىُّ خَيْرٌ وَأَحَبُّ إِلَى اللَّهِ مِنَ الْمُؤْمِنِ الضَّعِيفِ وَفِى كُلٍّ خَيْرٌ احْرِصْ عَلَى مَا يَنْفَعُكَ وَاسْتَعِنْ بِاللَّهِ وَلاَ تَعْجِزْ وَإِنْ أَصَابَكَ شَىْءٌ فَلاَ تَقُلْ لَوْ أَنِّى فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا. وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللَّهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ ».

“দূর্বল মুমিনের চেয়ে শক্তিশালী মুমিন উত্তম এবং আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। প্রত্যেক বস্তুর মধ্যেই কল্যাণ রয়েছে; যা তোমার জন্য উপকারী, তা তুমি কামনা কর এবং আল্লাহর নিকট সাহায্য প্রার্থনা কর। আর অক্ষমতা প্রকাশ করো না। কোন বস্তু অর্জন করার পর এ কথা বলো না যে, যদি আমি এরূপ এরূপ কাজ করতাম। বরং বল, আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত এবং তিনি যা ইচ্ছা তাই করেন; যদি তুমি শয়তানের কাজের উপর বিজয় লাভ করতে চাও।” —[মুসলিম, কদর, বাব-৮, হাদিস নং- ৬৯৪৫]

সুতরাং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক অবস্থায় উপকারী কর্মের কামনা করতে আদেশ করেছেন। তিনি আরও নির্দেশ দিয়েছেন আল্লাহর সাহায্য চাইতে এবং দূর্বলতা ও অক্ষমতার নিকট আত্মসমর্পন না করতে, যা ক্ষতিকারক অলসতা। তিনি আরও আদেশ করেছেন অতীতকালের বাস্তবায়িত বিষয় এবং আল্লাহর ফয়সালা ও তার নির্ধারিত ভাগ্যকে মেনে নেয়ার জন্য।

আর তিনি সকল কর্ম-কাণ্ডকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন: এক প্রকার কাজ হল বান্দা তা পুরাপুরি বা অংশবিশেষ অর্জনের চেষ্টা-প্রচেষ্টায় অথবা তা প্রতিরোধ করতে বা কিছুটা লাঘব করতে সক্ষম। সুতরাং এই ক্ষেত্রে বান্দা তার চেষ্টা-প্রচেষ্টার শুরু করবে এবং মাবুদের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করবে। আরেক প্রকারের কাজ হল, এই ব্যাপারে তার ক্ষমতা নেই। সতরাং তার ব্যাপারে শান্ত ও সন্তুষ্ট থাকবে এবং তা মেনে নেবে। আর কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বান্দা এই নীতি মেনে চললে, তা তার আনন্দ অনুভব করা ও দুশ্চিন্তা দূরের কারণ হবে।

৫. বেশি বেশি আল্লাহর যিকির: হৃদয়ের উদারতা ও মনের প্রশান্তির বড় উপায় হল বেশি বেশি আল্লাহর যিকির করা। কারণ, হৃদয়ের প্রশস্ততা ও মনের প্রশান্তি কায়েম করতে এবং তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করতে যিকিরের আশ্চর্য ধরনের প্রভাব রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ ﴾ [الرعد: 28]

“জেনে রাখ, আল্লাহর স্মরণেই চিত্ত প্রশান্ত হয়।” —[সূরা আর-রা‘দ: ২৮]

সুতরাং বান্দার স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের লক্ষ্য অর্জন ও তার প্রত্যাশিত সওয়াব ও প্রতিদান পেতে আল্লাহর যিকির বা স্মরণের বিরাট প্রভাব রয়েছে।

 ৬. আল্লাহর নিয়ামতের আলোচনা: অনুরূপভাবে (সৌভাগ্যময় জীবনের অন্যতম উপায় হল) আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নিয়ামতের আলোচনা করা। কারণ, তাঁর নিয়ামত সম্পর্কে জানা এবং তার আলোচনা দ্বারা তিনি বান্দার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করেন। আর তিনি বান্দাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য উৎসাহিত করেন; যেহেতু বান্দা সর্বোচ্চ মরতবা ও মর্যাদার অধিকারী, যদিও সে অভাব-অনটন, অসুস্থতা প্রভৃতি প্রকারের বালা-মুসিবতে থাকে। কারণ, বান্দা যখন তার উপর আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতের মুখোমুখি হয়, তখন তা গণনা বা হিসাব করা সম্ভব হবে না। আর তিনি সাধারণত বান্দা যেসব অপছন্দনীয় ও কষ্টকর কর্ম-কাণ্ডের শিকার হয়, তাও বর্ণনা করে দিয়েছেন; যে অপছন্দনীয় বস্তু বা বিষয়ের সাথে নিয়ামতের কোন সম্পর্ক নেই। বরং বিপদ-মুসিবত দ্বারা যখন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাকে পরীক্ষা করেন; বান্দও সেই ব্যাপারে ধৈর্য, সন্তুষ্টি ও মেনে নেয়ার মত দায়িত্ব পালন করে, তখন বিপদের সেই চাপটি সহ্য করা সহজ হয়ে যায়। আর বান্দার সওয়াব ও প্রতিদানের আশা এবং ধৈর্য ও সন্তুষ্টির কর্তব্য পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করার দ্বারা সে তিক্ত বস্তুকে মিষ্টি বস্তু মনে করে। ফলে প্রতিদানের স্বাদ তাকে ধৈর্যের তিক্ততার কথা ভুলিয়ে দেয়।

চলবে.............

সৌভাগ্যময় জীবনের পূর্ণাঙ্গ উপায় পর্ব –২

$
0
0

সংকলন: শাইখ আব্দুর রহমান বিন নাসের আস-সাদী | অনুবাদক: মোঃ আমিনুল ইসলাম | সম্পাদক: আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া ও মোঃ আব্দুল কাদের

পর্ব -১ | পর্ব - ২

৭. জীবন উপকরেণর ক্ষেত্রে নিম্নমানের ব্যক্তির প্রতি লক্ষ্য করা: এই বিষয়ে সবচেয়ে উপকারী বস্তু হল বিশুদ্ধ হাদিসে বর্ণিত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিক নির্দেশনার বাস্তবায়ন করা। তিনি বলেন:

« انْظُرُوا إِلَى مَنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلاَ تَنْظُرُوا إِلَى مَنْ هُوَ فَوْقَكُمْ فَهُوَ أَجْدَرُ أَنْ لاَ تَزْدَرُوا نِعْمَةَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ ».

“তোমরা তোমাদের চেয়ে নিম্নমানের ব্যক্তির দিকে তাকাও। আর তোমাদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির দিকে তাকিও না। কারণ, সে উপযুক্ত ও যোগ্যব্যক্তি। আর তোমরা তোমাদের প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নিয়ামতকে তুচ্ছ মনে করো না।” —(বুখারী ও মুসলিম)

সুতরাং বান্দার কপালে যখন গৌরবময় ভাগ্যরেখা অঙ্কিত হয়, তখন সে নিজেকে সুস্থতা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট আনুসাঙ্গিক বিষয়ে এবং রিজিক ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট আনুসাঙ্গিক বিষয়ের ক্ষেত্রে আল্লাহর সৃষ্ট বান্দাদের অনেকের চেয়ে উন্নত মনে করে। ফলে তার অস্থিরতা ও দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনা দূর হয় এবং তার আনন্দ ও আল্লাহর নিয়ামতের প্রতি তার সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পেতে থাকে।

যখনই আল্লাহর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, দীনী ও দুনিয়াবী নিয়ামতের প্রতি বান্দার আশা-আকাঙ্খা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে, তখনই সে তার রবকে দেখে যে, তিনি তাকে অনেক কল্যাণ দান করেছেন এবং তারে থেকে বহু অকল্যাণ দূর করেছেন। কোন সন্দেহ নেই যে, তার এই আশা-আকাঙ্খা দুশ্চিন্তা-দুর্ভাবনাসমূহ দূর করবে এবং হাসি-খুশি ও আনন্দকে আবশ্যক করে তুলবে।

৮. দুশ্চিন্তার কারণ দূরকরণে ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া: দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনা দূর করার এবং সুখ-শান্তি অর্জন করার অন্যতম উপায় হচ্ছে দুশ্চিন্তার কারণ দূরকরণে ও সুখ-শান্তি অর্জনের উপায় অবলম্বনে সচেষ্ট হওয়া। আর তা হচ্ছে ব্যক্তি তার অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাবে, যা তার পক্ষে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব এবং তাকে বুঝতে হবে যে, তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা অনর্থক কাজ। আর এ ধরনের কাজ আহাম্মকী ও পাগলামী যে, তার মন অতীতে ঘটে যাওয়া দুঃখ-কষ্ট নিয়ে চিন্তা-ভাবনায় ব্যস্ত হয়ে উঠবে এবং ঠিক একইভাবে তার মন ভবিষ্যৎ জীবনের কাল্পনিক অভাব-অনটন, ভয়-ভীতি ইত্যাদি ধরনের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠবে।Hapylife

সুতরাং তাকে জানতে হবে যে, ভবিষ্যতকালীন বিষয়াদি অজ্ঞাত ও অস্পষ্ট; তার মধ্যে ভাল, মন্দ আশা-হতাশা এবং দুঃখ-বেদনা সবই থাকতে পারে। আর তা মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর হাতে। তার কোন কিছুই বান্দাদের হাতে নয়। বান্দা শুধু তা থেকে কল্যাণসমূহ অর্জনে এবং অকল্যাণসমূহ থেকে আত্মরক্ষায় সচেষ্ট থাকবে। আর বন্দাকে আরও জানতে হবে যে, সে যখন ভবিষ্যতকালীন বিষয় নিয়ে তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও চিন্তা-ভাবনা থেকে ফিরে আসবে; তার ভাল-মন্দের ব্যাপারে তার প্রতিপালকের উপর ভরসা করবে এবং এই ব্যাপারে তার প্রতি আস্থাশীল হবে, তখন তার অন্তর শান্তি অনুভব করবে; তার অবস্থার উন্নতি হবে এবং তার সকল দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর হয়ে যাবে।

 

৯. দীন, দুনিয়া ও আখেরাতকে সুন্দর করার জন্য প্রার্থনা: ভবিষ্যৎ বিষয়ে মনোযোগ দেয়ার সবচেয়ে উপকারী পন্থা হল এই দো‘আটি যার দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রার্থনা করতেন। তিনি বলতেন:

« اللَّهُمَّ أَصْلِحْ لِى دِينِىَ الَّذِى هُوَ عِصْمَةُ أَمْرِى وَأَصْلِحْ لِى دُنْيَاىَ الَّتِى فِيهَا مَعَاشِى وَأَصْلِحْ لِى آخِرَتِى الَّتِى فِيهَا مَعَادِى وَاجْعَلِ الْحَيَاةَ زِيَادَةً لِى فِى كُلِّ خَيْرٍ وَاجْعَلِ الْمَوْتَ رَاحَةً لِى مِنْ كُلِّ شَرٍّ ».

“হে আল্লাহ! তুমি আমার দীনকে সংশোধন করে দাও, যা আমার কর্ম-কাণ্ডকে পাপমুক্ত রাখবে; তুমি আমার দুনিয়াকে সংশোধন করে দাও, যার মধ্যে আমার জীবন-জীবিকা রয়েছ এবং তুমি আমার আখেরাতকে সংশোধন করে দাও, যেখানে আমাকে ফিরে যেতে হবে। আর তুমি প্রতিটি কল্যাণের জন্য আমার হায়াতকে বাড়িয়ে দাও এবং খারাপ বা অকল্যাণের চেয়ে আমার জন্য মৃত্যুকে আনন্দদায়ক করে দাও।” —(মুসলিম, যিকির, দো‘আ ও তাওবা, বাব নং- ১৮, হাদিস নং- ৭০৭৮)

অনুরূপভাবে তিনি আরও বলেন:

« اللَّهُمَّ رَحْمَتَكَ أَرْجُو فَلاَ تَكِلْنِى إِلَى نَفْسِى طَرْفَةَ عَيْنٍ وَأَصْلِحْ لِى شَأْنِى كُلَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ ».

“হে আল্লাহ! আমি শুধু তোমার রহমতেরই প্রত্যাশা করি, সুতরাং তুমি এক মুহূর্তের জন্যও আমাকে আমার দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ো না। আর তুমি আমার সকল বিষয় সংশোধন করে দাও; তুমি ছাড়া কোন ইলাহ নেই।” —(আবু দাউদ, আদব, বাব নং- ১১০, হাদিস নং- ৫০৯২; আলবানী হাদিসটির সনদকে হাসান বলেছেন)

সুতরাং বান্দা যখন এই দো‘আটি বিশুদ্ধ নিয়তে মনোযোগ দিয়ে তার বাস্তব দিক নিয়ে চিন্তা-গবেষণাসহ পাঠ করবে, যার মধ্যে তার দীনী ও দুনিয়াবী ভবিষ্যৎ কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তখন আল্লাহ তার প্রার্থনা, প্রত্যাশা ও সে জন্য তার কাজ করাকে বাস্তবে রূপ দেবেন এবং তার দুশ্চিন্তাকে খুশি ও আনন্দে রূপান্তরিত করবেন।

১০. বিপদ-মুসিবত লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করা: বান্দা যখন দুর্ঘটনা কবলিত হয়, তখন তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম কার্যকারী উপায় হল তা লাঘব করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা-সাধনা করা এবং তার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়া। সুতরাং সে যখন এ জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করবে, তখন তার কর্তব্য হল সম্ভাব্যতার আলোকে যতটুকু লাঘব করা সম্ভব ততটুকু লাঘবের জন্য চেষ্টা-সাধনা করা। অতএব তার এই প্রস্তুতি ও ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার দ্বারা তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তাসমূহ দূর হবে। আর এই চেষ্টা-সাধনার বিনিময়ে বান্দর জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধা আসবে এবং বহু ক্ষয়-ক্ষতি প্রতিরোধে হবে।

সুতরাং যখন তাকে ভয়-ভীতি, রোগ-ব্যাধি, অভাব-অনটন ও বিভিন্ন প্রকার পছন্দনীয় বস্তুর ঘাটতির কারণসমূহ আচ্ছন্ন করে ফেলবে, তখন সে যেন এতেই প্রশান্তি লাভ করে এবং নিজের জন্য এই পরিবেশকে অথবা তার চেয়ে আরও কঠিন পরিবেশকে বাসস্থান হিসেবে গ্রহণ করে। কারণ, দুঃখ-কষ্টের সম্ভাবনাময় পরিবেশে কোন ব্যক্তি বসবাস করলে তার জন্য তা থেকে উত্তরণ সহজ হয় এবং তার ভয়াবহতা দূর হতে থাকে। বিশেষ করে যখন সে নিজেকে তার সাধ্যানুযায়ী দুঃখ-কষ্ট প্রতিরোধে ব্যস্ত রাখে, তখন সে বিপদ-মুসিবত দূর করার জন্য ফলপ্রসু চেষ্টা-সাধনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে বসবাস করতে থাকে এবং দুঃখ-কষ্ট মূলোৎপাটনে আল্লাহর উপর ভরসা ও সুন্দর আস্থা রেখে নতুন নতুন শক্তি ও কৌশল প্রয়োগে নিজেকে ব্যতিব্যস্ত রাখে। কোন সন্দেহ নেই যে, বান্দার ইহকালীন কল্যাণ ও পরকালীন প্রতিদান লাভের আশা-আকাঙ্খার সাথে সাথে সুখ-শান্তি ও হৃদয়ের প্রসারতা ও উদারতার গুণ অর্জনে এসব কর্ম-কাণ্ডের বিরাট উপকারিতা রয়েছে। আর এটা অভিজ্ঞতালব্ধ দৃশ্য বা দৃষ্টান্ত, যা সংঘটিত হয় অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষ থেকে।

১১. মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি ও আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা: মানসিক ও শারীরিক রোগ চিকিৎসার অন্যতম উপায় হচ্ছে মনোবল বৃদ্ধি এবং কল্পনাপ্রসূত অস্বস্তি ও আবেগ-উত্তেজনা বর্জন করা, যা দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনার জন্ম দেয়। কারণ, মানুষ যখন কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন করে এবং তার মন যখন রোগ-ব্যাধি, ক্রোধ, বেদনাদায়ক কারণে বিশৃঙ্খলা, দুঃখ-কষ্টে নিপতিত হওয়া ইত্যাদির প্রভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে, এসব তখন তাকে দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, মানসিক ও শারীরিক রোগ এবং স্নায়ুবিক দুর্বলতার দিকে ঠেলে দেয়; তার এমন অনেক কুপ্রভাব রয়েছে, যার বহু ক্ষতিকারক দিক সাধারণ মানুষ প্রত্যক্ষ করে।

১২. আল্লাহর উপর ভরসা করা: যখন বন্দার অন্তর আল্লাহ নির্ভরশীল হয়, সে নিজেও তার (আল্লাহর) উপর ভরসা করে, আন্দাজ-অনুমান ও কল্পনার নিকট আত্মসমর্পন না করে, দুশ্চিন্তা ও খারাপ কল্পনার অধিকারী না হয়, আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং তার অনুগ্রহের আশা-আকাঙ্খা পোষণ করে, এসব দ্বারা তখন তার দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাসমূহ প্রতিরোধ হবে এবং তার মানসিক ও শারীরিক রোগসমূহ দূর হয়ে যাবে। আর মানসিক শক্তি, উদারতা ও প্রফুল্লতা অর্জিত হবে। সুতরাং অনেক হাসপাতাল ভরপুর হয়েছে দুশ্চিন্তা ও দুর্ভাবনাগ্রস্ত মানসিক রোগীদের দ্বারা। আর এসবের কারণে দুর্বল ব্যক্তি ছাড়াও অনেক শক্তিশালী লোকের মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে এবং আহাম্মক ও পাগলে পরিণত করেছে। তার প্রভাব থেকে শুধু ঐ ব্যক্তিই বেঁচে গেছে, যাকে আল্লাহ ক্ষমা করেছেন এবং মানসিক শক্তি বৃদ্ধি ও মনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার ফলপ্রসু উপায় অবলম্বনের যথাযথ চেষ্টা-প্রচেষ্টা করার তাওফিক দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُ ﴾ [الطلاق:3]

“যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট।” —(সূরা আত-তালাক: ৩)

সুতরাং আল্লাহর উপর ভরসাকারী ব্যক্তি মানসিকভাবে শক্তিশালী, যাকে কোন কুধারনা ও দুশ্চিন্তা- দুর্ভাবনা প্রভাবিত করতে পারে না। আর তাকে কোন ঘটনা-দুর্ঘটনা বিরক্ত করতে পারে না তার এই জ্ঞান থাকার কারণে যে, নিশ্চয় এটা মানসিক দুর্বলতা এবং অবাস্তব ভয়-ভীতির কারণে সংঘটিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও সে জানে যে, যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে, তিনি তার সকল দায়-দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফলে সে আল্লাহর প্রতি আস্থাশীল হয় এবং তাঁর প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়। এতে তার দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর হয়; দুঃখ সুখে পরিণত হয়; দুঃখ-কষ্ট আনন্দে রূপান্তর হয় এবং ভয়-ভীতি পরিণত হয় নিরাপত্তায়। সুতরাং আমরা আল্লাহ তা‘আলার নিকট সুস্থতা কামনা করছি এবং আরও প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের উপর অনুগ্রহ করেন মানসিক শক্তি ও তাঁর উপর পূর্ণ ভরসায় অটল থাকার দ্বারা, যে ভরসার কারণে আল্লাহ তার সকল কল্যাণের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন এবং সকল অকল্যাণ ও ক্ষয়-ক্ষতির প্রতিরোধ করবেন।

১৩. মন্দ আচরণের পরিবর্তে ইহসান করা: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী:

« لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ ».

“কোন মুমিন বান্দা কোন মুমিন বান্দীকে ঘৃণা করবে না। তার কোন আচরণকে সে অপছন্দ করলেও তার কোন কোন আচরণকে সে পছন্দ করবে।” —(মুসলিম, রিদা‘, বাব-১৮, হাদিস নং- ৩৭২১)—এর মধ্যে দুইটি বড় ফায়দা রয়েছে:

ফায়দা-১: স্ত্রী, নিকটাত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব ও কর্মচারীর সাথে আচার-ব্যবহারের দিকনির্দেশনা; এদের প্রত্যেকের সাথে তোমার একটা ভাল সম্পর্ক রয়েছে। আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য এমন হওয়া উচিত যে, ব্যক্তির মধ্যে দোষ-ত্রুটি অথবা এমন কোন বিষয় রয়েছে যা আপনি অপছন্দ করেন; সুতরাং আপনি যখন তাকে এই অবস্থায় পাবেন, তখন আপনি বর্তমান পরিস্থিতি ও আপনার দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে তুলনামূলক পর্যালোচনা করুন। আপনার উচিৎ হবে তার মধ্যকার ভাল দিকগুলো ও বিশেষ ও সাধারণ উদ্দেশ্যসমূহের উল্লেখ করে সম্পর্ককে সুদৃঢ় করা এবং ভালবাসাকে স্থায়ী রূপ দেয়া। আর এভাবে মন্দ দিকগুলোকে উপেক্ষা করে এবং ভাল দিকগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বন্ধুত্ব ও সম্পর্ক অব্যাহত রাখা এবং তার জন্য শান্তি ও আনন্দকে পরিপূর্ণ করা।

ফায়দা-২: দুশ্চিন্তা ও অস্থিরতা দূর করা; হৃদ্যতা বজায় রাখা; ওয়াজিব ও মুস্তাহাব অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা অব্যহত রাখা এবং উভয় দিক তথা ইহকালীন ও পরকালীন জগতে শান্তি অর্জন করা। আর যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেছেন, তা পথনির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে না; বরং তার বিপরীত বিষয়কে পথনির্দেশ হিসেবে গ্রহণ করে; অতঃপর খারাপ ও মন্দসমূহের দিকে দৃষ্টি দেয় এবং উত্তম ও সুন্দর বিষয়ের ক্ষেত্রে অন্ধের ভূমিকা পালন করে। ফলে সে নিশ্চিতভাবে অস্থিরতা অনুভব করে; তার মধ্যে ও যিনি তার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চান, তাদের উভয়ের মধ্যকার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায় এবং তাদের উপর পরস্পরের অধিকার সংরক্ষণের যে দায়িত্ব রয়েছে, তার সিংহভাগ দায়িত্ব পালন সঙ্কোচিত হয়ে যায়।

চরম দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ব্যক্তিদের অনেকেই বিভিন্ন প্রকার দুর্যোগ ও বিপদ-মুসিবতের সময় নিজেদেরকে ধৈর্যধারণ ও শান্ত থাকার প্রবোধ দিয়ে থাকে; কিন্তু তারাই আবার অনেক তুচ্ছ বিষয়ে অস্থির হয়ে উঠে এবং পরিচ্ছন্নতাকে পঙ্কিলতায় পরিণত করে। এর একমাত্র কারণ হল, তারা বড় বড় বিষয়ের ক্ষেত্রে নিজেদেরকে দায়িত্ববান মনে করে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের ক্ষেত্রে তেমন দায়িত্ববান মনে করে না। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে। সুতরাং বুদ্ধিমান লোক নিজেকে ছোট ও বড় সকল বিষয়েই দায়িত্ববান মনে করে এবং এ বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলার নিকট সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করে। এক মুহূর্তের জন্যও সে নিজেকে দায়িত্বহীন মনে করে না। ফলে তার নিকট ছোট-বড় সকল সমস্যাই সহজ হয়ে যায় এবং প্রশান্ত হৃদয়ে বহাল তবিয়তে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে থাকে।

১৪. বুদ্ধিমান ব্যক্তি জানেন যে, তার সঠিক জীবনটাই সৌভাগ্যময় ও শান্তিময় জীবন। আর এটা খুবই সংক্ষিপ্ত। সুতরাং তার জন্য উচিত হবে না যে, দুশ্চিন্তা ও পাপ-পঙ্কিলতায় জড়িয়ে সে জীবনকে নষ্ট করা। অপরদিকে সঠিক জীবনের বিপরীত জীবনব্যবস্থা তার হায়াতকে সঙ্কুচিত করে দেয় এইভাবে যে, দুশ্চিন্তা ও পাপ-পঙ্কিলতার প্রস্তুতির কারণেই তার জীবন থেকে বহু সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। আর এ ক্ষেত্রে পুণ্যবান ও পাপীর মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কিন্তু এই গুণটি (সৎগুণটি) প্রতিষ্ঠিত থাকার করণে মুমিন ব্যক্তির জন্য ইহকালে ও পরকালে পরিপূর্ণ ও উপকারী অংশ বরাদ্ধ রয়েছে।

১৫. বুদ্ধিমান ব্যক্তির আরও কর্তব্য হল, যখন সে দুঃখ-কষ্ট পাবে অথবা ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা করবে, তখন সে দীনী ও দুনিয়াবী অর্জিত অপরাপর নিয়ামতসমূহ ও আক্রান্ত দুঃখ-কষ্টের মধ্যে তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে। অতঃপর পর্যালোচনার সময় তার নিকট এ কথা পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, দুঃখ-কষ্টের চেয়ে নিয়ামত অনেক বেশি।

অনুরূপভাবে সে তার ক্ষয়-ক্ষতির আশঙ্কা এবং শান্তি ও নিরাপত্তার বহু সম্ভাব্যতার তুলনামূলক পর্যালোচনা করবে; তখন তার নিকট ক্ষতির আশঙ্কার দুর্বল দিকটির চেয়ে শান্তি ও নিরাপত্তার সম্ভাব্যতার শক্তিশালী দিকটিই প্রাধান্য পাবে। আর এর মাধ্যমে তার দুশ্চিন্তা ও ভয়-ভীতির আশঙ্কা দূর হয়ে যাবে এবং দুঃখ-কষ্ট থেকে যা সংঘটিত হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, তা প্রতিরোধের জন্য অথবা তা থেকে কিছুটা লাগব করার জন্য সে চেষ্টা-সাধনা করবে।

১৬. উপকারী বিষয়ের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তুমি জেনে রাখবে যে, মানুষ যদি তোমাকে কষ্ট দেয়, বিশেষ করে মন্দ কথার দ্বারা, তবে তাতে তোমার ক্ষতি হবে না; বরং তাদেরই ক্ষতি হবে। কিন্তু তুমি যদি সে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত করে তোল, তখন তা তোমাকে ক্ষতি করবে, যেমনিভাবে তাদেরকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সুতরাং তুমি যদি তাতে কোন পরোয়া না কর, তবে তা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

১৭. আর তুমি জেনে রাখ যে, তোমার জীবন তোমার চিন্তা-চেতনার অনুসারী। সুতরাং তোমার চিন্তা-চেতনা যদি তোমার দীন ও দুনিয়ার জন্য উপকারী বিষয়ে হয়ে থাকে, তবে তোমার জীবন হবে সুন্দর, সৌভাগ্যময়। আর যদি তা না হয়, তবে ব্যাপারটি হবে তার বিপরীত। অর্থাৎ তখন তোমার জীবন হবে অসুন্দর ও দুর্ভাগ্যময়।

১৮. দুশ্চিন্তা দূর করার অন্যতম উপকারী উপায় হল, তুমি মনকে এই কথার উপর স্থির করবে যে, তুমি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে তোমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হউক তা দাবি করবে না। সুতরাং তুমি যখন তোমার উপর যার অধিকার আছে অথবা যার অধিকার নেই এমন ব্যক্তির উপর ইহসান করবে, তখন তুমি জেনে রাখবে যে, তোমার এই আচরণ আল্লাহর সাথে হয়েছে। আতএব তুমি যার উপর করুনা করেছ, তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের পরোয়া করবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির বিশেষ অধিকার প্রসঙ্গে বলেন:

﴿ إِنَّمَا نُطۡعِمُكُمۡ لِوَجۡهِ ٱللَّهِ لَا نُرِيدُ مِنكُمۡ جَزَآءٗ وَلَا شُكُورًا ٩﴾ [الإنسان:9]

“কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আমরা তোমাদেরকে আহার্য দান করি, আমরা তেমাদের নিকট থেকে প্রতিদান চাই না, কৃতজ্ঞতাও নয়।” —(সূরা আল-ইনসান: ৯)

এই আয়াতটি পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্তুতির সাথে আচার-আচরণ ও লেন-দেনের ক্ষেত্রে এবং তাদের সাথে তোমার সম্পর্ক শক্তিশালী করার ব্যাপারে জোর দিয়েছে। সুতরাং যখন তোমার হৃদয় তাদের থেকে অনিষ্ট দূর করতে প্রস্তুত হয়, তখন তোমার অন্তর সুখ ও শান্তি অনুভব করে।

আর সুখ-শান্তির অন্যতম দাবি হল মান-মর্যাদা অর্জন ও তার জন্য কোন রকম অস্থিরতা ছাড়াই মনের দাবি অনুযায়ী কাজ করা; মান-মর্যাদা অর্জনের ব্যর্থতার ধাপগুলো সফলতায় রূপ দিতে ধীরনীতি অবলম্বন করা, আর এটাই বুদ্ধিদীপ্ত কাজ এবং মন্দ কাজের পরিবর্তে পরিচ্ছন্ন কর্মসুচী গ্রহণ করা। আর এর দ্বারা প্রকৃত হৃদ্যতা বৃদ্ধি পাবে এবং মনের পঙ্কিলতা দূর হবে।

১৯. ফলপ্রসু কার্যাবলীকে তোমার দু’চোখের নিশানা হিসেবে ঠিক কর এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ কর। ক্ষতিকারক কোন কর্মের প্রতি দৃষ্টি দেবে না, যাতে তুমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-কষ্ট আনয়নকারী উপায়-উপকরণসমূহ ভুলে থাকতে পার। আর আনন্দের সাথে ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রতি মনোযোগসহ সাহায্য কামনা কর।

২০. আর ফলপ্রসু কার্যাবলীর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তাৎক্ষণিকভাবে কর্মসমূহ সম্পাদন করা এবং ভবিষ্যতকে কর্মমুক্ত রাখা। কারণ, কর্মসমূহ যখন যথাসময়ে সম্পাদন হবে না, তখন তোমার নিকট পূর্বের কাজসমূহ অবশিষ্ট থেকে যাবে এবং তার সাথে নিয়মিত কর্মসমূহ যোগ হবে; ফলে কাজের চাপ বেড়ে যাবে। সুতরাং তুমি যখন প্রতিটি কাজ যথাসময়ে সম্পাদন করবে, তখন তুমি ভবিষ্যৎ কর্মসূচী নিয়ে ভালভাবে চিন্তা-গবেষণা করে কাজ করতে সক্ষম হবে।

২১. আর তোমার উচিত হবে উপকারী কর্মসমূহ থেকে গুরুত্বের আলোকে একটার পর একটা বাছাই করা এবং যে কাজে তোমার ঝুঁক ও আগ্রহ বেশি, তা নির্ণয় করা। সুতরাং তার ব্যতিক্রম হলে অস্বস্তি ও বিরক্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। আর এ ব্যাপারে বিশুদ্ধ চিন্তা ও সঠিক পরামর্শের মাধ্যমে সহযোগিতা নেবে। কারণ, যে ব্যক্তি পরামর্শ নিয়ে কাজ করে, সে লজ্জিত হয় না। আর যে কাজের পরিকল্পনা গ্রহণ করবে, তা নিখুঁতভাবে পর্যালোচনার পর সম্পন্ন করবে। সুতরাং যখন কল্যাণকর কাজটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবে। আর আল্লাহ তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে ভালোবাসেন।

আর সমস্ত প্রশংসা সৃষ্টিকুলের রব এক আল্লাহর জন্য নিবেদিত।

وصلى الله على سيدنا محمد و على آله و صحبه و سلم.

(আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাত ও সালাম বর্ষিত হোক আমাদের নেতা মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীবৃন্দের প্রতি)।

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার

$
0
0

respectyourparentsঅনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

দীর্ঘ দিন সীমাহীন কষ্ট ও অবর্ণনীয় যাতনা সহ্য করে মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মায়ের পেটে সন্তান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে তার কষ্টের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনা পার হয়ে যখন সন্তান ভূমিষ্ট হয় তখন এ নবজাতককে ঘিরে মায়ের সব প্রত্যশা এবং স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এই নবজাতকের ভিতর সে দেখতে পায় জীবনের সব রূপ এবং সৌন্দর্য। যার ফলে দুনিয়ার প্রতি তার আগ্রহ এবং সম্পর্ক আরো গভীরতর হয়। পরম আদর-যত্নে সে শিশুর প্রতিপালনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের শরীরের নির্যাস দিয়ে তার খাবারের ব্যাবস্থা করে। নিজে কষ্ট করে তাকে সুখ দেয়। নিজে ক্ষুর্ধাত থেকে তাকে খাওয়ায়। নিজে নির্ঘূম রাত কাটায় সন্তানের ঘুমের জন্য। মা পরম আদর আর সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সন্তানকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। সন্তান কোথাও গেলে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন তার সন্তান নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে। সন্তানও যে কোন বিপদে ছুটে আসে মায়ের কোলে। পরম নির্ভরতায় ভরে থাকে তার বুক। যত বিপদই আসুক না কেন মা যদি বুকের সাথে চেপে ধরে কিংবা স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে একবার তাকায় তাহলে সব কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এই হল মা।

আর পিতা? তাকে তো সন্তানের মুখে এক লোকমা আহার তুলে দেয়ার জন্য করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সহ্য করতে হয় কতধরণের কষ্ট এবং ক্লেশ। সন্তানের জন্যই তো তাকে কখনো কখনো কৃপনতা করতে হয়। কখনো বা ভীরুতার পরিচয় দিতে হয়। সন্তান কাছে গেলে হাঁসি মুখে তাকে বুকে টেনে নেয়। তার নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য সে যে কোন ধরণের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। ইত্যাদি কারণে আমাদের অস্তিতের প্রতিটি কোণা পিতা-মাতার নিকট ঋণী। আর তাই তো আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের পরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ করার কথা উচ্চারিত হয়েছে বার বার। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়ে উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও আদেরকে বিরক্তি সূচক কিছু বলো না। এবং তাদেরকে ভর্র্ৎসনা করো না; তাদের সাথে কথা বলো সম্মান সূচক নম্র কথা।” [সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩]

আল কুরআনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার, প্রখ্যাত সাহাবী অবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আল কুরআনে এমন তিনটি আয়াত আছে যেখানে তিনটি জিনিস তিনটি জিনিসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি অগ্রহণযোগ্য। সে তিনটি আয়াত হলঃ

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

"হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর তার রাসূলের। এবং (তাদের বিরুদ্ধাচারণ করে) নিজেদের আমল বিনষ্ট কর না।" [সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩]

কেউ যদি আল্লাহর আনুগত্য করে কিন্তু রাসূলের আনুগত্য না করে তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

২) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

"এবং তোমরা সালাত (নামায) আদায় কর এবং যাকাত দাও।" [সূরা বাক্বারাঃ ৪৩]

কেউ যদি নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দিতে রাজী নয় তাহলে তাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় নয়।

৩) আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

“আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় কর।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]

কেউ যদি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিন্তু পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় না করে তবে তা আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত।

সে কারণেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে একাধিকবার আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের সাথে সাথে পিতা-মাতার আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশ এসেছে। ধ্বনীত হয়েছে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করার প্রতি কঠিন হুশিয়ারী। তা যে কোন কারণেই হোক না কেন। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। এবং তার সাথে কাউকে শরীক কর না আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।” [সূরা নিসাঃ ৩৬]

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً

“আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” [সূরা আনকাবূতঃ ৮]

তিনি আরও বলেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

“আর আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” [সূরা লোকমানঃ ১৪]

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে পিতা-মাতার মর্যাদা এবং তাদের প্রতি সন্তানদের অধিকারের প্রমান বহন করছে।

প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস থেকেঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস থেকেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

১) পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টিঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

“পিতা-মাতার সন্তুষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করছে।” (ত্ববারানী কাবীর-সহীহ)

২) ফিরে যাও, তাদের মুখে হাঁসি ফোটাওঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত,

জনৈক সাহাবী নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি হিজরত করার জন্য শপথ করতে। আমি যখন আসি আমার পিতা-মাতা কাঁদছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, “তাদের কাছে ফিরে যাও, এবং যেমন তাদেরকে কাঁদিয়েছিলে এখন তাদেরকে গিয়ে হাঁসাও।” (আবু দাউদ, নাসাঈ,ইবন মাজাহ-সহীহ)

৩) তার পা ধর, ওখানেই তোমার জান্নাতঃ মুয়া’বিয়া ইবন জাহাম সুহামী নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন, “যাও, তোমার আম্মার সেবা কর।” কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, “হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাক। ওখানেই তোমার জান্নাত।” (মুসনাদ আহমাদও ইবন মাজাহ্)

৪) পিতার তুলনায় মার অধিকার তিনগুণ বেশীঃ সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত,

একলোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উত্তম সংশ্রব পাওয়ার জন্য কে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? তিনি বললেন, তোমার মা।” লোকটি আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার মা।” সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার পিতা।” (বুখারী-মুসলিম)

অত্র হাদীস প্রমাণ বহন করে, পিতার তুলনায় মা তিনগুণ সদাচারণ পাওয়ার অধিকারী। কারণ, গর্ভে ধারণ, ভুমিষ্ট ও দুগ্ধদানের ক্ষেত্রে কেবল মাকেই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। পিতা কেবল সন্তান প্রতিপালনে স্ত্রীর সাথে অংশ গ্রহণ করে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ ত।আলা ইরশাদ করেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَاناً حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهاً وَوَضَعَتْهُ كُرْهاً وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلاثُونَ شَهْراً

“আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) গর্ভে ধারণ করেছে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারতে ও তার স্তন ছাড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস।” [আহক্বাফঃ ১৫]

৫) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন তাকাবেন নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা তাকাবেন না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

৬) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

৭) তবুও অবাধ্যতা নয়ঃ মু’য়ায (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তা হলো, আল্লাহর সাথে শিরক করবে না যদিও তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার, এবং সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে বলে…। (মুসনাদ আহমাদ)

নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর মাঃ

পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ইতোপূর্বে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একাধিক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এখন দেখব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মা-জননীর প্রতি বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য কী আদর্শ রেখে গেছেন।

সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, হুদায়বিয়া সন্ধির সময় প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সাথে আছে এক হাযার ঘোড় সাওয়ার। মক্কা ও মদীনার মাঝে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর প্রাণ প্রিয় মা-জননী চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি যাত্রা বিরতী করে তাঁর মা’র কবর যিয়ারত করতে গেলেন। কবরের কাছে গিয়ে তিনি কাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তার চর্তুদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাহাবীগণও কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আল্লাহর দরবারে আমার মা’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু তার কবর যিয়ারতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাতে অনুমতি দেন। সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ, কবর যিয়ারত করলে পরকালের কথা স্মরণ হয়।”(সহীহ মুসলিম)

ইবরাহীম (আঃ) এবং তার পিতা-মাতাঃ

ইবরাহীম (আঃ) এর পিতা-মাতা কাফের ছিল। তারপরও তিনি তাদের সাথে অত্যন- বিনয় ও ভদ্রতা সুলোভ আচরণ করতেন। তিনি তার পিতাকে শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহবান জানাচ্ছেনঃ

يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لا يَسْمَعُ وَلا يُبْصِرُ وَلا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئاً

আব্বাজান, আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করছেন যা শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকারও করতে পারে না? কিন্তু সে তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করল না বরং তাকে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তখন তিনি শুধু এতটুকুই বলেছিলেনঃ

قَالَ سَلامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً

“আপনাকে সালাম। আমি আপনার জন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।” [সূরা মারইয়ামঃ ৪৭]

ইয়াহয়া (আঃ): আল্লাহ তা’আলা তার প্রশংসা করে বলেনঃ

"সে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারী ছিল।” [সূরা মারইয়ামঃ ১৪]

এভাবে অনেক নবীর কথা আল কুরআনে উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বিশ্ববাসীর সামনে অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপন করেছেন।

আমাদের পূর্ব পুরুষগণ পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এসমস্ত মহামনিষীদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবদুল্লাহ্ ইবন্ মাসঊদ (রাঃ), ইবন্ হাসান তামীমী (রহঃ), ইবন আউন মুযানী (রহঃ) প্রমুখের নাম ইতিহাসখ্যাত।

পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপঃ পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপ হতে পারে যা হয়ত অনেক মানুষের কাছেই অজানা।

১) পিতা-মাতার উপর নিজেকে বড় মনে করা। অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান-প্রতিপত্তিতে পিতা-মাতার চেয়ে বেশী অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন নিজেকে বড় বড় মনে করা।

২) পিতা-মাতাকে পিতা-মাতাকে সহায়-সম্বলহীন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রাখা এবং যার কারণে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে বাধ্য হয়।

৩) বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-পুত্র বা অন্য কাউকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনকেও পিতা-মাতার উপর অগ্রাধিকার দেয়া তাদের নাফরমানীর অন্তর্ভূক্ত।

৪) পিতা-মাতাকে শুধু নাম ধরে বা এমন শব্দ প্রয়োগে ডাকা যা তাদের অসম্মান ও মর্যাদাহানীর ইঙ্গিত দেয়।

৫) পিতা-মাতার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকের সাথে কথা বলা।

৬) তাদের সেবা-শশ্রুসা না করা এবং শারিরীক বা মানষিক দিকের প্রতি লক্ষ না রাখা। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে বা রোগ-ব্যধিতে তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা।

পরিশেষেঃ প্রতিটি জ্ঞানবান মানুষের আছে আহবান জানাবো, আসুন, পিতা-মাতার ব্যাপারে অবহেলা করার ব্যাপারে সাবধানত হই। তাদের প্রতি প্রর্দশন করি সর্বোচ্চ সম্মান জনক আচরণ। কারণ এর মাধ্যমেই আমাদের পার্থিব জীবন সুন্দর হবে। গুনাহ-খাতা মাফ হবে। পরকালে মিলবে চির সুখের নিবাস জান্নাত।

মহিমাময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই হে পরওয়ারদেগার, আমাদেরকে আমাদের পিতা-মাতার সাথে চির শান্তির নীড় জান্নাতে একত্রিত করিও। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা।


ইসলামের দৃষ্টিতে ঋণ লেন-দেন

$
0
0

gold-dinar-silver-dirham

লেখকঃ  আব্দুর রাকীব মাদানী |  দাঈ, দাওয়াহ সেন্টার, খাফজী, সউদী আরব

আলহামদু লিল্লাহ, ওয়াস্ সালাতু ওয়াস্ সালামু আলা রাসূলিল্লাহ, আম্মাবাদ,

সুপ্রিয় পাঠক!  ঋণ-কর্জ মানুষের তথা সমাজের একটি প্রয়োজনীয় লেনদেন। সমাজে বসবাসকারী প্রত্যেক ব্যক্তি জিবন-যাপন করার ক্ষেত্রে কোনো না কোনো সময় ঋণ নেওয়ার কিংবা অন্যকে দেওয়ার সম্মুখীন  হতে হয়। তবে এই মানবীয় সুন্দর নিয়ম এবং অপরকে সহযোগিতা করার এই ইসলামী সুপ্রথাও অনেক সময় কুমতলবীর চক্রান্তে ও মায়াজালে ফেঁসে বিদ্বেষ, ঝগড়া-ঝাঁটি এমনকি বড় রকমের শত্রুতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর অনেকে তো এই ঋণ প্রথাকেই পুঁজি জমা করার উপায় হিসেবে ব্যবহার করে বিশ্বে পুঁজিপতি হয়েছে ও হচ্ছে। আর দরিদ্র সম্প্রদায় তাদের মুখাপেক্ষী হওয়ার কারণে ঋণের জাঁতায় পিষ্ট হচ্ছে। আমরা এই প্রবন্ধে ইসলামে ঋণের বিধি-বিধান সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। যেন ঋণের সঠিক বিধান জানতে পারি এবং বেঠিক বিধান হতে নিরাপদে থাকতে পারি। ওয়ামা তাওফীকী ইল্লা বিল্লাহ।

ঋণের অর্থঃ

ঋণের আরবী শব্দ ‘কায্র্’, যা প্রচলিত বাংলা ভাষায় কর্জ নামে পরিচিত।  এর বাংলা সমার্থবোধক শব্দ হচ্ছে, দেনা, ধার, হাওলাদ ইত্যাদি।

শরীয়তের পরিভাষায় ঋণঃ

মাল-পণ্য অপরকে প্রদান করা, যেন তার মাধ্যমে সে উপকৃত হয়, অতঃপর দাতাকে সেই মাল কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া। [ফিক্হ বিশ্বকোষ, খন্ড ৩৩, পৃঃ১১১]

ঋণের বৈধতাঃ

ঋণ প্রথা বৈধ, যা সুন্নত এবং ইজমা (ঐক্যমত) দ্বারা প্রমাণিত। [মুগনী, ইবনু কুদামাহ,৬/৪২৯]

নবী (সাঃ) একদা এক উষ্ট্রী ধার নেন এবং ফেরত দেওয়ার সময় সেই সমগুণের উষ্ট্রী না পাওয়ায় তার থেকে উত্তম গুণের পুরুষ উট ফেরত দেন এবং বলেনঃ “তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সে, যে উত্তম ঋণ পরিশোধকারী।’’  [বুখারী ,অধ্যায়,ইস্তিকরায, নং২৩৯০]

ঋণ যোগ্য জিনিসাদিঃ

অর্থাৎ কি কি জিনিস ঋণের অন্তর্ভুক্ত, যা ঋণ হিসাবে আদান-প্রদান করা যেতে পারে? এ বিষয়ে ফুকাহাদের মতভেদ বিদ্যমান। তবে নির্ভরযোগ্য মত হচ্ছে, প্রত্যেক এমন বস্তু যা বিক্রয় করা বৈধ, তা ঋণ দেওয়াও বৈধ। [যাদুল্ মুস্তাক্বনা’, হিজাভী/২১২]

ঋণ প্রদানের ফযীলতঃ

ঋণ প্রদান একটি নেকির কাজ, যার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে।  এর মাধ্যমে লোকের সাহায্য করা হয়, তাদের প্রতি দয়া করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা হ্রাস করা হয় কিংবা সমাধান করা হয়।

নবী (সাঃ) বলেনঃ ‘‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিম ব্যক্তির দুনিয়াবী বিপদ দূর করবে, আল্লাহ তাআলা তার আখেরাতের বিপদ দূর করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবীর কষ্ট সহজ করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতে সহজ করবেন। আল্লাহ বান্দার সাহায্য করেন যতক্ষণে বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্য করে।” [মুসলিম,অধ্যায়ঃ যিকর, দুআ,তাওবাহ ও ইস্তিগফার]

নবী (সাঃ) আরো বলেনঃ ‘‘যে কেউ কোনো মুসলিমকে দুই বার ঋণ দেয়, তা সেই অনুযায়ী এক বার সাদাকা করার মত।’’ [ইবনু মাজাহ, সূত্র হাসান,ইরওয়াউল গালীল নং১৩৮৯]

ঋণ লেন-দেনে মেয়াদ নির্ধারণঃ

বিষয়টির ব্যাখ্যা হচ্ছে, ঋণ দাতা এবং ঋণ গ্রহীতা লেন-দেনের সময় একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ নির্ধারণ করতে পারে কি পারে না? সঠিক মত হচ্ছে, মেয়াদ নির্ধারিত করতে পারে এবং প্রয়োজনে মেয়াদ বৃদ্ধিও করতে পারে। কারণ

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

"হে বিশ্বাসীগণ! যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ধারে কারবার করবে, তখন তা লিখে রাখবে।" [সূরা বাকারাহ - ২৮২]

অতঃপর মেয়াদ নির্ধারিত থাকলে ঋণদাতা নির্ধারিত সময়ের পূর্বে ঋণ গ্রহীতার নিকট থেকে ঋণ ফেরত নেওয়ার দাবী করতে পারে না। বরং সে নির্ধারিত মেয়াদ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বাধ্য। কারণ নবী (সাঃ) বলেনঃ

‘‘মুসলিমগণ শর্ত পূরণে বদ্ধপরিকর।” [আহমদ,আবু দাউদ,তিরমিযী]

ঋণের মাধ্যমে লাভ অর্জনঃ

ইসলামে ঋণের উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষকে সাহায্য করা, তাদের প্রতি দয়া করা তথা তাদের জীবন-যাপনে সহযোগিতা করা,সহযোগিতার আড়ালে সুবিধা অর্জন নয়। তাই বলা হয়েছে, ঋণের উদ্দেশ্য হবে আধ্যাত্বিক বৃদ্ধি বাহ্যিক বৃদ্ধি নয়। আর তা হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। এই কারণে ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় যা নিয়েছে তা কিংবা সেই অনুরূপ ফেরত দিতে আদিষ্ট, অতিরিক্ত নয়। ঋণ দাতা এর অতিরিক্ত নিলে কিংবা ঋণ গ্রহীতা অতিরিক্ত ফেরত দিলে, তা সুদ হিসাবে গণ্য হবে। কারণ ফিক্হী মূলণীতিতে উল্লেখ হয়েছে,

[كل قرض جرّ نفعا فهو ربا]

‘কুল্লু কার্যিন র্জারা নাফ্আন ফাহুআ রিবা।’

অর্থাৎ প্রত্যেক ঋণ, যার মাধ্যমে লাভ উপার্জিত হয়, তা সুদ।

প্রকাশ থাকে যে, উপরোল্লেখিত ফিকহী মূলণীতিটি হাদীস হিসাবে যয়ীফ (দুর্বল)। দেখুন, ইরওয়াউল গলীল,আলবানী, নং ১৩৯৮। তবে কায়েদা ফিকহিয়্যাহ (ফিকহী মূলণীতি)  হিসাবে স্বীকৃত।

ঋণের মাধ্যমে লাভের উদাহরণঃ

ক- কাউকে এক হাজার টাকা ধার দেওয়া এবং ফেরত নেওয়ার সময় বেশী নেওয়া। এটা স্পষ্ট।

খ- কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে বা এই শর্তে যে, ঋণ গ্রহীতা ঋণ দাতার কিংবা তার পরিবারের কাউকে চাকরি দিবে বা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।

গ- কাউকে ঋণ দেওয়া এই উদ্দেশ্যে যে, সে তাকে ঘর বা দোকান ভাড়া দিবে কিংবা এ ধরনের  অন্য কিছু, যা সমাজের অনেকাংশে প্রচলিত।

ইসলামে উত্তম ঋণ পরিশোধ ব্যবস্থা এবং বর্তমান ব্যাংকিং প্রথা, একটি সংশয় নিরসনঃ

ইসলাম ঋণ দেওয়াকে  যেমন লোকের সাহায্য তথা তাদের কষ্ট দূরীকরণ হিসাবে স্বীকার করে, তেমন ঋণ পরিশোধে উত্তম দৃষ্টান্ত পেশ করে। তাই ঋণ গ্রহীতা ঋণ ফেরত দেয়ার সময় বেশি বা উত্তম  ফেরত দিতে পারে, যাকে শরীয়তের পরিভাষায় ‘হুসনুল্ কাযা’ বা উত্তম পরিশোধ বলা হয়।

عن أبي رافع رضي الله عنه قال: استسلف رسول الله صلى الله عليه و سلم من رجل بكرا فقدمت عليه إبل من الصدقة فأمر أبا رافع أن يقضي الرجل بكره، فرجع إليه أبو رافع فقال: لم أجد فيها إلا  خيارا رباعيا، فقال: أعطه إياه، إن خيار الناس أحسنهم قضاء" - رواه مسلم و أحمد

অর্থ, আবু রাফে হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ একদা নবী (সাঃ) এক ব্যক্তি হতে একটি উষ্ট্রী ধার নেন। তার পর সাদাকার উট আসলে আবু রাফেকে আদেশ দেওয়া হয়, সে যেন সেই ব্যক্তির উট ফেরত দেয়। আবু রাফে (রাযিঃ)  ফিরে এসে বলেঃ  [সেই সমগুণের উট নেই বরং তার থেকে উত্তম] রুবায়ী মুখতার [এমন পুরুষ উট যা ছয় বছর বয়স অতিক্রম করে সপ্তম বছরে প্রবেশ করেছে এমন] উট আছে। নবী (সাঃ) বলেনঃ তাই দিয়ে দাও; কারণ ভাল মানুষ তারা যারা উত্তম পরিশোধকারী।” [মুসলিম, অধ্যায়ঃ বয়ূ, নং ৪১০৮]

অনেকে ইসলামের এই সুন্দর বিধান না বুঝতে পেরে, কিংবা না বোঝার ভান করে, কিংবা অপরিপক্ক জ্ঞানের কারণে কিংবা অন্তরে প্রবৃত্তির রোগ থাকার কারণে, বিষয়টিকে বর্তমান ব্যাংকিং প্রথায় অতিরিক্ত প্রদান করা ও অতিরিক্ত গ্রহণ করা বৈধ বলে ফতুয়া দিয়েছে। তাদের মন্তব্য, নবী (সাঃ) যেমন ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় বেশী দিলেন এবং ঋণ দাতা বেশী গ্রহণ করলেন, তেমন আমরা ব্যাংকে ঋণ ফেরত দেওয়ার সময় যদি বেশী দেই এবং তারা সেটা গ্রহণ করে তো অবৈধতার কিছু নেই।
উত্তরে বলবো, নবী (সাঃ) এর ঋণ ফেরতে বেশি দেওয়া এবং বর্তমান যুগের ব্যাংকিং প্রথায় বেশী লেন-দেনের প্রথার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান।

প্রথমতঃ নবী (সাঃ) কে ঋণ দাতা ঋণ প্রদানের সময় কোনো শর্ত দেয়নি যে, ঋণ ফেরত কালে বেশী ফেরত দিতে হবে। অন্যদিকে বর্তমান ব্যাংক সুক্ষ্ম হিসাবের মাধ্যমে বেশী দেওয়ার শতকরা হার নির্ধারণ করে দেয় এবং নির্ধারিত সময়ে তা ফেরত না দিতে পারলে শতকরা হার আরোও বৃদ্ধি পায়। আসলে ব্যাংক এই চক্রের মাধ্যমেই অর্থায়ন করে থাকে, আর আমরা বুঝেও বুঝি না।

দ্বিতীয়তঃ সমাজে এটা পরিচিত ছিল না যে,নবী (সাঃ) কে ঋণ দিলে তিনি অতিরিক্ত ফেরত দেন। বরং তিনি হঠাতই এই রকম আদেশ দেন। এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণের ঐক্যমত রয়েছে যে, যে কোনো ঋণে যদি বেশি ফেরতের শর্ত থাকে, তাহলে সেটা হারাম।

ইবনুল মুনযির বলেনঃ ‘তাদের ঐক্যমত রয়েছে যে, ঋণ দাতা যদি ঋণ গ্রহীতাকে ঋণ ফেরতের সময় বেশী দেওয়া কিংবা হাদিয়া সহ ঋণ ফেরত দেওয়ার শর্ত দেয় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ঋণ দেওয়া হয়, তাহলে বেশি নেওয়াটা সুদ।’ [মুগনী,৬/৪৩৬]  তাই ঋণ ফেরতের সময় বেশি গ্রহণ বৈধ নয়, যতক্ষণে দুটি শর্ত না পাওয়া যায়।

ক- ঋণ দাতা ঋণ গ্রহীতার সাথে লাভ নেওয়ার শর্ত দেয় নি।

খ- সমাজে বেশি দেওয়ার প্রথা প্রচলিত ও নয়।

যদি শর্ত দেওয়া হয় কিংবা এটা সমাজে প্রচলিত থাকে, তাহলে বেশি নেওয়া সুদ হবে। এখানে প্রচলিত শব্দটির উল্লেখ এই কারণে করা হচ্ছে যে, শারয়ী মূলণীতিতে প্রচলিত প্রথা শর্তর মতই। অর্থাৎ শর্তারোপ তো করে না কিন্তু প্রথা ও প্রচলন অনুযায়ী বেশি নেয় বা দেয়, তাহলে সেটা শর্ত হিসাবেই গণ্য হবে।

ঋণ পরিশোধে বিলম্ব না করাঃ

ঋণ দাতা যখন মানুষের উপকার্থে ঋণ প্রদান করে, তখন ঋণ গ্রহীতার দ্বীনী ও নৈতিক দায়িত্ব হবে তা যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দেওয়া। যদি এইরকম না করে টাল-বাহানা শুরু করে, মিথ্যা ওজর পেশ করতে লাগে, তাহলেই আপসে মিল-মুহব্বত ও ভ্রাতৃত্ব নষ্ট হয়, শত্রুতা বৃদ্ধি পায় এবং একে অপরের প্রতি বিশ্বাস যোগ্যতা হারায়।

মহান আল্লাহ বলেনঃ

"উত্তম কাজের প্রতিদান উত্তম পুরস্কার ছাড়া আর কি হতে পারে?" [সূরা আর রাহমান - ৬০]

তিনি অন্যত্রে বলেনঃ

( إن الله يأمركم أن تؤدوا الأمانات إلى أهلها )

"নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, হকদারদের হক তাদের নিকট পৌঁছে দিতে।" [ সূরা নিসা - ৫৮]

নবী (সাঃ) বলেনঃ

“ধনী ব্যক্তির টাল-বাহানা করা অত্যাচার।” [মুত্তাফাকুন আলাইহ]

তিনি (সাঃ) আরো বলেনঃ

" من فارق الروح الجسد، و هو بريء من ثلاث دخل الجنة: من الكبر، والغلول، والدين" - رواه ابن ماجه

 ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে, সে তিনটি স্বভাব থেকে মুক্ত ছিল, তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবেঃ অহংকার, গনীমতের সম্পদ হতে চুরি এবং ঋণ।” [ইবনু মাজাহ, আলবানী (রহঃ) সহীহ বলেছেন]

ঋণ পরিশোধের পূর্বে মৃত্যুবরণঃ

ঋণ মানুষের হক-পাওনা, তা পূরণের পূর্বে মৃত্যুবরণ করা মানে মানুষের হক নিজ স্কন্ধে থেকে যাওয়া, যা বড় অপরাধ। সেই কারণে এই প্রকার ব্যক্তির জানাযার নামায নবী (সাঃ) নিজে পড়েন নি। ইমাম তিরমিযী হাসান-সহীহ সনদে আবু ক্বাতাদাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত করেন, নবী (সাঃ) এর কাছে একদা এক ব্যক্তির জানাযা নিয়ে আসা হলে, তিনি (সাঃ) বলেনঃ ‘‘তোমরা তোমাদের সাথীর জানাযা পড়; কারণ সে ঋণী।’’ [তিরমিযী, অধ্যায়ঃ জানাযা, নং১০৬৯]

এই কারণে ইসলামী পন্ডিতগণ বলেন, মাইয়্যেতের তারেকাহ (উত্তরাধিকার) বন্টণের পূর্বে কয়েকটি হক নির্ধারিত, তা পূরণের পরেই তার উত্তরাধিকার বন্টিত হবে। তন্মধ্যে মাইয়্যেতের উপর অপরের হক সমূহ অন্যতম। সেই হক আল্লাহর হোক, যেমন যাকাত কিংবা মানুষের হক হোক, যেমন ঋণ। [আল্ মুলাখ্খাস আল্ ফিক্হী, ড. ফাউযান/৩৩৪]

অভাবী ঋণীকে অবকাশ প্রদানঃ

সমাজে যেমন কিছু লোক পাওয়া যায়, যারা সক্ষম হওয়া সত্ত্বেও ঋণ শোধ করতে ঢিলেমি করে, তেমন সত্যিকারে এমন লোকও রয়েছে যারা নির্ধারিত সময়ে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। এই রকম ব্যক্তিকে ইসলাম অতিরিক্ত সময় দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

( و إن كان ذو عُسرة فنظرة إلى ميسرة و أن تصدقوا خيرٌ لكم إن كنتم تعلمون) 

"যদি ঋণী দরিদ্র হয়, তবে স্বচ্ছল অবস্থা আসা পর্যন্ত অবকাশ দিবে আর মাফ করে দেয়া তোমাদের পক্ষে অতি উত্তম, যদি তোমরা জানতে!" [ সূরা বাক্বারাহ - ২৮০]

নবী (সাঃ) বলেনঃ

‘‘যে ব্যক্তি পছন্দ করে যে, আল্লাহ তাকে কিয়ামত দিবসের কষ্ট থেকে নিষ্কিৃতি দিবে, সে যেন অভাবী ঋনীকে অবকাশ দেয় কিংবা তার ঋণের বোঝা লাঘব করে।” [মুসলিম, অধ্যায়, ক্রয়-বিক্রয়, নং ৪০০০]

এখানে একটি বিষয় বর্ণনা করা জরূরী মনে করছি, তা হল, ঋণ গ্রহীতা যদি নির্ধারিত সময়ে ঋণ ফেরত দিতে না পারে, তাহলে তাকে অবকাশ দিতে হবে বিনা লাভের শর্তে। কিন্তু যদি ঋণ দাতা তার মেয়াদ বাড়িয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে লাভ নেয় তাহলে তা স্পষ্ট সুদ হবে। যেমন কেউ এক বছর পর তার ঋণ ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বছর শেষ হলে সে ফেরত না দিতে পারায় ঋণ দাতার নিকট আরো ৫ মাস সময় বাড়িয়ে দেয়ার আবেদন করলো। অতঃপর ঋণ দাতা তাকে বললোঃ ঠিক আছে মেয়াদ বাড়াবো কিন্তু এর বিনিময়ে তোমাকে ঋণ ফেরতের সময় মূল ধনের বেশি দিতে হবে। অর্থাৎ সময় বৃদ্ধির বিনিময়ে লাভ গ্রহণ। এটা স্পষ্ট সুদ, যা নবী (সাঃ) এর যুগে আরবের জনপদে  ছিল এবং তা এখনও বিদ্যমান। [আল্ মুলাখ্খাস আল ফিকহী, ড.ফাউযান /২৩৭]

ঋণ পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণঃ

আজ-কাল সমাজে আর এক প্রকার লোক দেখা যায়, যারা ঋণ নেয় পরিশোধ না করার উদ্দেশ্যে। অর্থাৎ আসলে তার অন্তরে থাকে অন্যের অর্থ কৌশলে আত্মসাত করা। আর ঋণ করাটা হচ্ছে তার একটি বাহানা মাত্র। এই রকম লোকেরা এক সাথে কয়েকটি হারাম কাজে লিপ্ত হয়।

১ - বাতিল পদ্ধতিতে অন্যের মাল-সম্পদ ভক্ষণ, যা আল্লাহ নিষেধ করেছেন। [বাক্বারাহ/১৮৮]

২ - ধোকা তথা প্রতারণা।

৩ - জেনে বুঝে সজ্ঞানে গুনাহ করা।

৪ - মিথ্যা বলা।

নবী (সাঃ) বলেনঃ

 من أخذ أموال الناس يريد أداءها أدى الله عنه، و من أخذ يريد إتلافها أتلفه الله  - رواه البخاري

অর্থ, ‘‘যে ব্যক্তি অন্যের মাল পরিশোধ করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তাআলা তার পক্ষ হতে পরিশোধ করে দেন। (পরিশোধ করতে সাহায্য করেন) আর যে ব্যক্তি তা নষ্ট করার উদ্দেশ্যে নেয়, আল্লাহ তা নষ্ট করে দেন। [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং২৩৮৭]

তাদের এই রকম জঘন্য কাজ থেকে বিরত থাকা উচিৎ। কারণ মানুষের এই হক পৃথিবীতে আদায় না করা হলেও  আখেরাতে আল্লাহর দরবারে তা অবশ্যই আদায় করতে হবে। বরং আল্লাহ তা নিজে আদায় করে দিবেন।

ঋণের যাকাতঃ

অর্থাৎ কেউ কাউকে ঋণ দিলে এবং সেই ঋণ যাকাতের আওতায় পড়লে, যাকাত কাকে দিতে হবে? ঋণ গ্রহীতাকে যার কাছে সেই মাল আছে? না ঋণ দাতাকে? আসলে সেই অর্থ, দাতার নিকট থেকে গ্রহীতার কাছে স্থানান্তর হয়েছে মাত্র। নচেৎ প্রকৃতপক্ষে তার মালিক দাতাই। সেই কারণে ঋণ দাতাকেই সেই মালের যাকাত দিতে হবে। তবে ইসলামী গবেষকদের নিকট বিষয়টির একটু ব্যাখ্যা রয়েছে, তা হলঃ ঋণ গ্রহীতা যদি অভাবী হয়, যার কারণে সে সঠিক সময়ে ঋণ ফেরত দিতে অক্ষম কিংবা সক্ষম তবে টাল-বাহানাকারী , যার থেকে ঋণ আদায় করা কষ্টকর। এই ক্ষেত্রে ঋণ দাতার প্রতি সেই মালের যাকাত দেওয়া জরূরী নয়, যতক্ষণে তা তার হাতে না আসে। আর যদি ঋনী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে সক্ষম হয় তথা সেই ঋণ পাওয়ার পুরো সম্ভাবনা থাকে, তাহলে যাকাতের সময় হলেই ঋণ দাতাকে তার যাকাত আদায় করতে হবে। [ফতোয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী কমিটি, ৯/১৯১, ফতোয়া নং ৯০৬৯]

তবে টাল-বাহানাকারীর কাছ থেকে কয়েক বছর পর ঋণ পাওয়া গেলে বিগত সব বছরের যাকাত দিতে হবে না এক বছরের দিলেই হবে? এ ক্ষেত্রে উপরোক্ত ফাতাওয়া কমিটি এক বছরের দিলেই হবে বলে ফাতওয়া দিয়েছেন। [ ফাতাওয়া ও গবেষণা বিষয়ক স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি,৯/১৯০]

ঋণ হতে আশ্রয় প্রার্থনা এবং ঋণ পরিশোধের দুআঃ

নবী (সাঃ) ঋণ হতে আল্লাহর নিকট বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করতেন, যা দেখে এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেনঃ আল্লাহর রাসূল!  আপনি ঋণ থেকে খুব বেশি বেশি আশ্রয় প্রার্থনা করেন? নবী (সাঃ) বলেনঃ

" إن الرجل إذا غرم حدّث فكذب و وعد فأخلف" - رواه البخاري

“মানুষ ঋণী হলে, যখন কথা বলে, মিথ্যা বলে এবং অঙ্গীকার করলে অঙ্গীকার ভঙ্গ করে।” [বুখারী, অধ্যায়ঃ ইস্তিকরায, নং ২৩৯৭]

তাই তিনি (সাঃ) বলতেনঃ

" أللّهمَّ! إنّي أعوذُ بِكَ مِنَ الكَسَلِ والهَرَمِ والمأثَمِ والمَغْرَمِ"  - رواه مسلم

উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা! ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ কাসালি, ওয়াল্ হারামি, ওয়াল্ মা’ছামি, ওয়াল্ মাগ্রাম॥

অনুবাদঃ ‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে আশ্রয় কামনা করছি অলসতা, অধিক বার্ধক্য, গুনাহ এবং ঋণ হতে।” 

[মুসলিম, অধ্যায়ঃ যিকর ও দুআ, নং৬৮৭১]

তিনি (সাঃ) আরো বলতেনঃ

" اللهم! إني أعوذ بك من الهم والحزن، والكسل، والبخل، والجبن، و ضلَع الدين، وغلبة الرجال" -  رواه النسائي

উচ্চারণঃ “আল্লাহহুম্মা ইন্নী আউযুবিকা মিনাল্ হাম্মি ওয়াল্ হাযানি, ওয়াল্ আজ্যি ওয়াল্ কাসালি, ওয়াল্ বুখ্লি ওয়াল্ জুব্নি, ওয়া যালাইদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।”

অর্থ, ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি, চিন্তা-ভাবনা, অপারগতা,অলসতা, কৃপণতা এবং কাপুরুষতা থেকে। অধিক ঋণ থেকে এবং দুষ্ট লোকের প্রাধান্য থেকে।’ [নাসাঈ, অধ্যায়ঃ ইস্তিআযাহ, নং ৫৪৭৮]

কৌতুকেও নয় মিছে কথা

$
0
0

lies3

লেখকঃ আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনাঃ  ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

রিকশা থেকে নেমে মানি ব্যাগ খুলে ভাড়া দিতে গিয়ে হয়তো দেখলেন খুচরো দশ টাকা নেই। এবার কী করবেন? নিশ্চয় আপনি পাশের মুদির দোকানে গিয়ে বলবেন, ভাই একশ টাকা খুচরো হবে? মুহূর্ত বিলম্ব না করে দোকানি নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেবেন, ‘না ভাই আমার কাছে কোনো খুচরো নেই’। অথচ সত্য হলো, তার ক্যাশে একশ টাকার খুচরো পর্যাপ্ত রয়েছে। তেমনি জিনিস কিনতে গিয়ে দেখবেন দোকানীরা দামদরের এক পর্যায়ে ক্রেতাকে পটাতে বলেন, ‘এটা আমি ... দিয়ে কিনেছি। আপনাকে এই দামে দিলে আমার কোনো লাভই থাকে না ভাই।’ তারপর দিব্যি তিনি ওই তথাকথিত কেনা দামেই দিয়ে দেন। ক্রেতার মন ভেজাতে কেউ বলেন, ‘আপনাকে এই দামে বেঁচলে কেবল আমার চালানটা উঠবে ভাই’ কিংবা এটা আমার কেনা দাম, এরচে কম বলবেন না ইত্যাদি বাক্যও উচ্চারণ করেন।

আমাদের রোজকার জীবনে এমন অনেক মিথ্যে কথাই বলে থাকি যার তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। অহেতুক এমন মিথ্যা উচ্চারণ আজকাল যেন দোষের কোনো বিষয়ই নয়। অথচ বলাবাহুল্য, মিথ্যা তো মিথ্যাই। তেমনি কেবল ইয়ার্কি করে বা লোক হাসানোর জন্যও অনেকে মিথ্যা বলে মজা পান। এটাও কিন্তু মিথ্যাই। খেয়ালি মনে কিংবা ফাজলামো করে কেউ যেমন কাউকে খুন করলে বা কোনো জিনিস ভেঙ্গে ফেললে তা অক্ষত থাকে না। ক্ষতি যা হবার তা হয়েই যায়। তেমনি মিথ্যাও যদি কেউ ঠাট্টাচ্ছলে বা ফাজলামো করে বলেন তিনিও ঠিক সে মিথ্যার গুনাহগার হন।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের জন্য সদা অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ঘুণাক্ষরেও মিথ্যা বলেন নি। তাঁর হাসি-কৌতুকও ছিল নির্মল ও অনিন্দ্য সত্যনির্ভর। এ প্রসঙ্গে সীরাতে রাসূল থেকে একটি চমৎকার ঘটনা উল্লেখের লোভ সংবরণ করতে পারছি না। হাদীসটি আমরা প্রায়ই আলোচনা করে থাকি। ঘটনাটি এমন :

أنَّ امرأةً عجوزًا جاءتْهُ تقولُ لَهُ : يا رسولَ اللهِ ادع اللهَ لي أنْ يدْخِلَني الجنةَ فقال لَها : يا أمَّ فلانٍ إِنَّ الجنَّةَ لا يدخلُها عجوزٌ وانزعجَتِ المرأةُ وبكَتْظنًّا منها أنها لن تدخلَ الجنةَ فلما رأى ذلِكَ منها بيَّنَ لها غرضَهُ أنَّ العجوزَ لَنْ تدخُلَ الجنَّةَ عجوزًا بل يُنشِئُها اللهُ خلقًا آخرَ فتدخلُها شابَّةً بكرًا وتَلَا عليها قولَ اللهِ تعالى : إِنَّا أَنشَأْناهُنَّ إِنشَاءً فَجَعَلْنَاهُنَّ أبْكًارًا عُرُبًا أُتْرَابًا .

‘একবার এক বুড়ি মা তাঁর কাছে এসে বললেন, আমার জন্য দো‘আ করুন যাতে আমি জান্নাতে যেতে পারি। (নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্মিত হাসি দিয়ে) বললেন, হে ওমুকের মা! জান্নাতে তো কোনো বুড়ি প্রবেশ করবে না। এ কথা শুনে বৃদ্ধা খুবই উদ্বিগ্ন হলেন, এমনকি কাঁদতে শুরু করলেন। তিনি ভাবলেন কখনোই বুঝি তার জান্নাতে যাওয়া হবে না। বৃদ্ধার অবস্থা দেখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (হেসে) ব্যাখ্যা করে বললেন, কোনো বৃদ্ধ মহিলা বৃদ্ধাবস্থায় জান্নাতে যাবে না। বরং আল্লাহ তাদেরকে নতুন সৃষ্টিতে রূপান্তরিত করবেন। অতঃপর পূর্ণযৌবনা-কুমারী হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। অতঃপর তিনি তাঁকে আল-কুরআনুল কারীমের (নিম্নোক্ত) আয়াত তিলাওয়াত করে শোনালেন,

﴿ إِنَّآ أَنشَأۡنَٰهُنَّ إِنشَآءٗ ٣٥ فَجَعَلۡنَٰهُنَّ أَبۡكَارًا ٣٦ عُرُبًا أَتۡرَابٗا ٣٧ ﴾ [الواقعة: ٣٥،  ٣٧]

‘নিশ্চয় আমি তাদেরকে বিশেষভাবে সৃষ্টি করব। অতঃপর তাদেরকে বানাব কুমারী, সোহাগিনী ও সমবয়সী।’ {সূরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত : ৩৫-৩৭} [গায়াতুল মারাম : ৩৭৫][1]

ঠাট্টা-মজাক করেও মিথ্যা বলার অবকাশ নেই। একটি হাদীসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাবধান করে বলেছেন,

«وَيْلٌ لِلَّذِي يُحَدِّثُ فَيَكْذِبُ لِيُضْحِكَ النَّاسَ مِنْهُ، وَيْلٌ لَهُ، وَيْلٌ لَهُ»

‘ওই ব্যক্তির জন্য কঠিন শাস্তি, কঠিন শাস্তি এবং কঠিন শাস্তি যে কেবল লোক হাসাতে মিথ্যে বলে।’ [আবূ দাউদ : ৪৯৯০][2]

শুধু শাস্তির ভয়ই দেখানো হয় নি; ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা পরিহার করলে তার জন্য শ্রেষ্ঠ পুরস্কারের ঘোষণাও করা হয়েছে। যেমন আবূ উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«أَنَا زَعِيمٌ بِبَيْتٍ في رَبَضِ الْجَنّةِ لِمَنْ تَرَكَ المِرَاءَ وَإِنْ كَانَ مُحِقاّ، وَبِبَيْتٍ في وَسَطِ الْجَنّةِ لِمَنْ تَرَكَ الْكَذِبَ وَإِنْ كان مَازِحاً، وَبِبَيْتٍ في أعْلَى الْجَنّةِ لِمَنْ حَسّنَ خُلُقَهُ »

‘আমি ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের আশপাশে কোনো গৃহের জামিন হব যে উপযুক্ত ও সঠিক হবার পরও (বিপক্ষের) তর্ক ছেড়ে দেয়, আর ওই ব্যক্তির জন্য জান্নাতের মধ্যস্থলে কোনো গৃহের জামিন হব যে ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যে পরিহার করে এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থানে কোনো গৃহের জামিন হব যে তার চরিত্রকে সুন্দর বানায়।’ [আবূ দাঊদ : ৪৮০০][3]

আজকাল প্রায়শই মোবাইলে কথা বলার সময়ও দেখা যায় অনেককে অহেতুক মিথ্যা বলতে। বাসায় কথা বলার সময় অনেকে নিজের অবস্থান থেকে একটু বাড়িয়ে আরেকটু সামনের কথা বলেন। অথচ সঠিক জায়গার কথা বললে তার তেমন কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি হয় না। যানবাহনে প্রায়ই দেখি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে অনেক ভদ্রলোক দিব্যি সবার সামনে মিথ্যা বলে যাচ্ছেন। অফিসের কর্তাকে ধোঁকা দিয়ে জনারণ্যে অসত্য বলছেন! আছেন এক জায়গায় আর বলছেন তার থেকে কয়েক মাইল এগিয়ে।

শিশুদের সঙ্গেও আমরা মাঝেমধ্যে অকারণে মিথ্যে বলি। যেমন হাতে কিছু না নিয়েও কিছু আছে বলে সোনামনিকে কাছে টানার চেষ্টা করা ইত্যাদি। অথচ এটিও মিথ্যার অন্তর্ভুক্ত। আবদুল্লাহ ইবন ‘আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

دَعَتْنِي أُمِّي يَوْمًا وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَاعِدٌ فِي بَيْتِنَا، فَقَالَتْ: هَا تَعَالَ أُعْطِيكَ، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «وَمَا أَرَدْتِ أَنْ تُعْطِيهِ؟» قَالَتْ: أُعْطِيهِ تَمْرًا، فَقَالَ لَهَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَمَا إِنَّكِ لَوْ لَمْ تُعْطِهِ شَيْئًا كُتِبَتْ عَلَيْكِ كِذْبَةٌ»

‘একদা আমার মা আমাকে ডাকতে লাগলেন, তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বাসায় বসা ছিলেন। (তিনি আমাকে কোলে নিতে চাইছিলেন আর আমি যেতে চাইছিলাম না।) এমতাবস্থায় তিনি বললেন, কাছে এসো, তোমাকে একটি জিনিস দেব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথা শুনে বললেন, সত্যিই কি তুমি তাকে কিছু দেবে নাকি এমনিই তাকে কাছে নেবার জন্য বলছ? মা বললেন, আমার খেজুর দেবার ইচ্ছা আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যদি তোমার খেজুর দেবার ইচ্ছা না থাকত এবং শুধুমাত্র তাকে আহ্বান করাই উদ্দেশ্য হত তাহলে তোমার আমলনামায় একটি মিথ্যা বলার গুনাহ লেখা হত। [আবূ দাঊদ : ৪৯৯১]

পবিত্র ধর্ম ইসলামে সর্বদা সত্য বলা এবং মিথ্যা বর্জনের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। মিথ্যার নিন্দা করা হয়েছে বহু আয়াত এবং হাদীসে। বিভিন্নভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে মিথ্যা বলতে। উৎসাহিত করা হয়েছে সত্য উচ্চারণে। বাংলাই প্রবাদই রয়েছে মিথ্যা মানুষের বিপদ ডেকে আনে। আমাদের মহান রব ইরশাদ করেন,

﴿ وَيۡلٞ يَوۡمَئِذٖ لِّلۡمُكَذِّبِينَ ١٠ ﴾ [المطففين: ١٠]

‘সেদিন ধ্বংস মিথ্যাবাদীদের (সত্য তথা ইসলামকে অস্বীকারকারীদের) জন্য।’ {সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত : ১০}

মিথ্যাবাদীদের তীব্র ভর্ৎসনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ إِنَّمَا يَفۡتَرِي ٱلۡكَذِبَ ٱلَّذِينَ لَا يُؤۡمِنُونَ بِ‍َٔايَٰتِ ٱللَّهِۖ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡكَٰذِبُونَ ١٠٥ ﴾ [النحل: ١٠٥]

‘একমাত্র তারাই মিথ্যা রটায়, যারা আল্লাহর আয়াতসমূহে বিশ্বাস করে না। আর তারাই মিথ্যাবাদী।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১০৫}

যাচ্ছে তাই সত্য-মিথ্যা বলতে আল্লাহ বারণ করেছেন। যেমন ইরশাদ হয়েছে,

﴿ وَلَا تَقُولُواْ لِمَا تَصِفُ أَلۡسِنَتُكُمُ ٱلۡكَذِبَ هَٰذَا حَلَٰلٞ وَهَٰذَا حَرَامٞ لِّتَفۡتَرُواْ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَۚ إِنَّ ٱلَّذِينَ يَفۡتَرُونَ عَلَى ٱللَّهِ ٱلۡكَذِبَ لَا يُفۡلِحُونَ ١١٦ ﴾ [النحل: ١١٦]

‘আর তোমাদের জিহ্বা দ্বারা বানানো মিথ্যার উপর নির্ভর করে বলো না যে, এটা হালাল এবং এটা হারাম, আল্লাহর উপর মিথ্যা রটানোর জন্য। নিশ্চয় যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা রটায়, তারা সফল হবে না।’ {সূরা আন-নাহল, আয়াত : ১১৬}

হাদীসে মিথ্যা বলার স্বভাবকে মুনাফিকের আলামত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«آيَةُ المُنَافِقِ ثَلاَثٌ: إِذَا حَدَّثَ كَذَبَ، وَإِذَا اؤْتُمِنَ خَانَ، وَإِذَا وَعَدَ أَخْلَفَ »

‘মুনাফিকের আলামত তিনটি : যখন কথা বলে মিথ্যা বলে, আমানত রাখলে খেয়ানত করে এবং প্রতিশ্রুতি দিলে তা ভঙ্গ করে। [সহীহ বুখারী : ২৫৬২]

মিথ্যা বলা শুধু মন্দ স্বভাবই নয়; বরং তা গুনাহ ও অশ্লীলতার দিকে নিয়ে যায়। যেমন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

«عَلَيْكُمْ بِالصِّدْقِ، فَإِنَّ الصِّدْقَ يَهْدِي إِلَى الْبِرِّ، وَإِنَّ الْبِرَّ يَهْدِي إِلَى الْجَنَّةِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَصْدُقُ وَيَتَحَرَّى الصِّدْقَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ صِدِّيقًا، وَإِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ، فَإِنَّ الْكَذِبَ يَهْدِي إِلَى الْفُجُورِ، وَإِنَّ الْفُجُورَ يَهْدِي إِلَى النَّارِ، وَمَا يَزَالُ الرَّجُلُ يَكْذِبُ وَيَتَحَرَّى الْكَذِبَ حَتَّى يُكْتَبَ عِنْدَ اللهِ كَذَّابًا»

‘সত্য বলাকে নিজের ওপর অপরিহার্য করে নাও। কেননা সত্যবাদীতা নেকীর দিকে আর নেকী জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। যে মানুষ সত্য বলে আর এ জন্যে চেষ্টা করতে থাকে, এতে সে আল্লাহ তা‘আলার কাছে সত্যবাদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। আর মিথ্যা থেকে বিরত থাক, কেননা মিথ্যা গুনাহ ও অশ্লীলতার দিকে আর গুনাহ এবং অশ্লীলতা জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়। যে মানুষ মিথ্যা বলতে থাকে আর এ দিকে আল্লাহ্’র কাছে তার নাম মিথ্যাবাদীদের তালিকায় লিপিবদ্ধ হয়ে যায়। [বুখারী : ৬০৯৪; মুসলিম : ২৬০৭]

সবচে বড় গুনাহগুলোর অন্যতম হলো মিথ্যা বলা। যেমন আবদুর রহমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

«أَلاَ أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الكَبَائِرِ؟» ثَلاَثًا، قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ، قَالَ: «الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ، وَعُقُوقُ الوَالِدَيْنِ - وَجَلَسَ وَكَانَ مُتَّكِئًا فَقَالَ - أَلاَ وَقَوْلُ الزُّورِ» ، قَالَ: فَمَا زَالَ يُكَرِّرُهَا حَتَّى قُلْنَا: لَيْتَهُ سَكَتَ

‘আমি কি তোমাকের সবচে বড় কবীরা গুনাহের খবর দেব না?’ তিনি তিনবার উচ্চারণ করলেন প্রশ্নটি। সাহাবীরা বললেন, অবশ্যই হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সঙ্গে শরীক করা, পিতা-পাতার অবাধ্য হওয়া –তিনি বসা অবস্থা থেকে হেলান দিয়ে বললেন- এবং মিথ্যা কথা বলা। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি কথাটির পুনরাবৃত্তি করতেই থাকলেন, এমনকি মনে মনে বললাম, ইস তিনি যদি নীরব হয়ে যেতেন! [বুখারী : ২৬৫৪; মুসলিম : ৮৮]

আল্লাহ তা‘আলা প্রতিটি ঈমানদারকে মিথ্যা থেকে বেঁচে চলার তাওফীক দান করুন। সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করুন সত্যবাদীদের কাতারে। আমীন।



[1]. শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুন আস-সিলসিলাতুস সাহীহা : ২৯৮৭।

[2]. শায়খ আলবানী হাসান বলেছেন।

[3]. শায়খ আলবানী হাসান বলেছেন।

সন্তানের হক

$
0
0

www_ummad_co_nr 7

হাবীবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

আল্লাহ তা‘আলা মানব জীবনকে সন্তান-সন্তুতির মাধ্যমে ভারসাম্যপূর্ণ এবং আকর্ষণীয় করেছেন। পারিবারিক জীবনে সন্তান-সন্ততি কতবড় নিয়ামত তা যার সন্তান হয়নি তিনি সবচেয়ে বেশি উপলব্ধি করে থাকেন। যাদেরকে আল্লাহ রাববুল আলামীন সন্তান দান করেছেন তাদের উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। পিতা-মাতার জন্য সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হবে যদি সন্তানকে আদর্শবান রূপে গড়ে না তুলতে পারেন। কেননা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

প্রতিটি নবজাতক তার স্বভাবজাত দ্বীন ইসলামের ওপর জন্ম গ্রহণ করে। অতঃপর তার মা-বাবা তাকে ইয়াহূদী, নাসারা অথবা অগ্নিপূজক হিসেবে গড়ে তোলে [সহীহ বুখারী: ১৩৫৮]।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা দিন দিন যেভাবে অপসংস্কৃতি, অনৈতিকতা এবং চরিত্র বিধ্বংসী কাজের দিকে ধাবিত হচ্ছে, সেখানে আমাদের সন্তানের উপর যেসব দায়িত্ব আছে তা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করতে হবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত পন্থায় সন্তানকে লালন-পালন করা ঈমানের অন্যতম দাবী। আমাদের উপর সন্তানদের যে হকগুলো রয়েছে তা এখানে আলোচনা করা হলো :

১. কানে আযান দেয়া : সন্তান দুনিয়াতে আসার পর গোসল দিয়ে পরিষ্কার করে তার ডান কানে আযান দেয়া, তা ছেলে হোক বা মেয়ে হোক। এটি পিতা-মাতার উপর এজন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বযে, শিশুর কানে সর্বপ্রথম আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের আওয়াজ পৌঁছে দেয়া এবং ওত পেতে থাকা শয়তান যাতে তার কোন ক্ষতি না করতে পারে। হাদিসে এসেছে,
আবূ রাফে রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হাসান ইবনে আলীর কানে আযান দিতে দেখেছি [সুনান আবূ দাউদ:৫১০৫]

২. সুন্দর নাম রাখা : বাচ্চার জন্য সুন্দর নাম নির্বাচন করা পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব ও কর্তব্য। নাম অর্থবহ হওয়া নামের সৌন্দর্য। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  অনেক অসুন্দর নাম পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন। [আবু দাউদ ৪৯৫২-৪৯৬১]

৩. আক্বিকা করা : ইসলামী সংস্কৃতির অন্যতম বিষয় হলো সন্তানের আকীকা করা। ছেলের পক্ষ থেকে ২টি ছাগল এবং মেয়ের পক্ষ থেকে ১টি ছাগল আল্লাহর নামে যবেহ করা। হাদীসে এসেছে,

সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সকল নবজাতক তার আক্বিকার সাথে আবদ্ধ। জন্মের সপ্তম দিন তার পক্ষ থেকে জবেহ করা হবে। ঐ দিন তার নাম রাখা হবে। আর তার মাথার চুল কামানো হবে। [সুনান আবূ দাউদ: ২৮৩৮]

৪. সদকাহ করা : ছেলে হোক বা মেয়ে হোক সপ্তম দিবসে চুল কাটা এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ করা সুন্নাত। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান রা. এর পক্ষ থেকে ১টি বকরী আকীকা দিয়েছেন এবং বলেছেন, হে ফাতেমা ! তার মাথা মুণ্ডন কর এবং চুল পরিমাণ রৌপ্য সদকাহ কর। [সুনান আত-তিরমিযী: ১৫১৯] এছাড়া রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিশুদেরকে খেজুর দিয়ে তাহনীক এবং বরকতের জন্য দো‘আ করতেন। [সহীহ বুখারী: ৩৯০৯; মুসলিম: ২১৪৬]

৫. খাতনা করা : ছেলেদের খাতনা করানো একটি অন্যতম সুন্নাত। হাদীসে এসেছে,

জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান এবং হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুমার সপ্তম দিবসে আকীকা এবং খাতনা করিয়েছেন। [আল-মু‘জামুল আওসাত: ৬৭০৮]

৬. তাওহীদ শিক্ষা দেয়া : শিশু যখন কথা বলা আরম্ভ করবে তখন থেকেই আল্লাহর তাওহীদ শিক্ষা দতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘

হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখাতে চাই। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, আল্লাহও তোমার হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর অধিকারের হেফাযত করবে, তুমি তাঁকে সর্বদা সামনে পাবে। যখন কোন কিছু চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর যখন সহযোগিতা চাইবে তখন আল্লাহর কাছেই চাইবে। আর জেনে রাখ! যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন উপকার করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন উপকার করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। আর যদি পুরো জাতি যদি তোমার কোন ক্ষতি করার জন্য একতাবদ্ধ হয়, তবে তোমার কোন ক্ষতি করতে সমর্থ হবে না, শুধু ততটুকুই করতে পারবে যতটুকু আল্লাহ তোমার জন্য লিখে রেখেছেন। কলমের লিখা শেষ হয়েছে এবং কাগজসমূহ শুকিয়ে গেছে। [তিরমিযী: ২৫১৬]

৭. কুরআন শিক্ষা দান : ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে কুরআন শিক্ষা দিতে হবে। কেননা কুরআন শিক্ষা করা ফরয। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের তিনটি বিষয় শিক্ষা দাও। তন্মধ্যে রয়েছে তাদেরকে কুরআন তিলাওয়াত শিক্ষা ও কুরআনের জ্ঞান দাও। [জামিউল কাবীর]

কুরআন শিক্ষা দেয়ার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই। উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।’’ [সহীহ বুখারী:৫০২৭]

৮. সলাত শিক্ষা দেয়া ও সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করা : এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার যে পিতা-মাতা তার সন্তানকে সলাত শিক্ষা দিবেন এবং সলাত আদায়ে অভ্যস্ত করাবেন। হাদীসে এসেছে,

আমর ইবনে শূয়াইব রাদিয়াল্লাহু আনহু তার বাবা তিনি তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমরা তোমাদের সন্তানদের সলাতের নির্দেশ দাও সাত বছর বয়সে। আর দশ বছর বয়সে সলাতের জন্য মৃদু প্রহার কর এবং শোয়ার স্থানে ভিন্নতা আনো। [সুনান আবূ দাউদ: ৪৯৫]

৯. আদব বা শিষ্টাচার শিক্ষা দেয়া : সন্তানদের আচরণ শিক্ষা দেয়া পিতামাতার উপর দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভূক্ত। লুকমান আলাইহিস সালাম তার সন্তানকে বললেন, ‘আর তুমি মানুষের দিক থেকে তোমার মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না। আর যমীনে দম্ভভরে চলাফেরা করো না; নিশ্চয় আল্লাহ কোন দাম্ভিক, অহঙ্কারীকে পছন্দ করেন না। আর তোমার চলার ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন কর, তোমার আওয়াজ নীচু কর; নিশ্চয় সবচাইতে নিকৃষ্ট আওয়াজ হল গাধার আওয়াজ।’ [ সূরা লুকমান ১৮,১৯]

১০.আদর স্নেহ ও ভালবাসা দেয়া : সন্তানদেরকে স্নেহ করা এবং তাদেরকে আন্তরিকভাবে ভালবাসতে হবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ইবনে আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে চুম্বন দিলেন এবং আদর করলেন। সে সময় আকরা ইবনে হাবিস রাদিয়াল্লাহু আনহুও উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলতে লাগলেন, আমারতো দশটি সন্তান কিন্তু আমিতো কখনো আমার সন্তানদেরকে আদর স্নেহ করিনি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার দিকে তাকালেন এবং বললেন, যে অন্যের প্রতি রহম করে না আল্লাহও তার প্রতি রহম করেন না। [সহীহ বুখারী: ৫৯৯৭]

১১. দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেয়া : সন্তানকে দীনি ইলম শিক্ষা দেয়া ফরজ করা হয়েছে। কারণ দ্বীনি ইলম না জানা থাকলে সে বিভ্রান্ত এবং ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভূক্ত হবে। হাদীসে এসেছে-

আনাস বিন মালিক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক মুসলিমের উপর জ্ঞানার্জন করা ফরয। [সুনান ইবন মাজাহ: ২২৪]

১২. প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া পর্যন্ত লালন-পালন করা : সন্তানদেরকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত লালন-পালন করতে হবে এবং তাদের জন্য প্রয়োজনীয় খরচ করতে হবে।

উম্মে সালামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম আবূ সালামার সন্তানদের জন্য আমি যদি খরচ করি এতে কি আমার জন্য প্রতিদান রয়েছে? নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হ্যাঁ যতদিন তুমি খরচ করবে ততদিন তোমার জন্য প্রতিদান থাকবে। [সহীহ বুখারী: ৫৩৬৯]

১৩. সক্ষম করে তোলা : সন্তানদেরকে এমনভাবে সক্ষম করে গড়ে তোলা,তারা যেন উপার্জন করার মত যোগ্যতা অর্জন করতে পারে। সা‘দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে এভাবে বলেছেন,

তোমাদের সন্তান সন্ততিদেরকে সক্ষম ও সাবলম্বি রেখে যাওয়া, তাদেরকে অভাবী ও মানুষের কাছে হাত পাতা অবস্থায় রেখে যাওয়ার চেয়ে উত্তম। [সহীহ বুখারী:১২৯৫]

১৪. বিবাহ দেয়া : সুন্নাহ পদ্ধতিতে বিবাহ দেয়া এবং বিবাহর যাবতীয় কাজ সম্পাদন করা এবং উপযুক্ত সময়ে বিবাহর ব্যবস্থা করা। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, নিশ্চয়ই পিতার উপর সন্তানের হকের মধ্যে রয়েছে, সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বিবাহ দেবে। [জামিউল কাবীর]

১৫. দ্বীনের পথে পরিচালিত করা : পিতা-মাতার অন্যতম দায়িত্ব হলো সন্তানদেরকে দ্বীনের পথে, কুরআন-সুন্নাহর পথে পরিচালনা করা, দ্বীনের বিধান পালনের ক্ষেত্রে অভ্যস্ত করে তোলা। কুরআনে এসেছে,

‘ বল, ‘এটা আমার পথ। আমি জেনে-বুঝে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেই এবং যারা আমার অনুসরণ করেছে তারাও। আর আল্লাহ পবিত্র মহান এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’। [সূরা ইউসুফ : ১০৮]

সন্তানকে দ্বীনের পথে পরিচালনার মাধ্যমে সওয়াব অর্জন করার এক বিরাট সুযোগ রয়েছে। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আলী রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন,

তোমার মাধ্যমে একজনও যদি হিদায়াতপ্রাপ্ত হয়, তবে তা হবে তোমার জন্য লালবর্ণের অতি মূল্যবান উট থেকেও উত্তম। [সহীহ বুখারী]

১৬. সন্তানদের মাঝে ইনসাফ করা : সন্তানগণ পিতামাতার কাছ থেকে ইনসাফ আশা করে এবং তাদের মাঝে ইনসাফ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বিষয়ে বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেছেন, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের সন্তাদের মাঝে ইনসাফ করো’। [সহীহ বুখারী: ২৫৮৭]

১৭. ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে বিরত রাখা : ইসলাম অনুমোদন করে না এমন কাজ থেকে তাদেরকে বিরত না রাখলে এই সন্তানগনই কিয়ামাতে পিতামাতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। কুরআনে এসেছে,

হে ইমানদারগণ! তোমরা তোমাদের নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। [সূরা আত-তাহরীম-৬]

আর কাফিররা বলবে, ‘হে আমাদের রব, জ্বিন ও মানুষের মধ্যে যারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছে তাদেরকে আমাদের দেখিয়ে দিন। আমরা তাদের উভয়কে আমাদের পায়ের নীচে রাখব, যাতে তারা নিকৃষ্টদের অন্তর্ভুক্ত হয়। [সূরা হা-মীম আসসিজদাহ-২৯ ]

১৮. পাপকাজ, অশ্লিলতা, বেহায়াপনা, অপসংস্কৃতি থেকে বিরত রাখা : সন্তান দুনিয়ার আসার সাথে সাথে শয়তান তার পেছনে লেগে যায় এবং বিভিন্নভাবে, ভিন্ন ভিন্ন রুপে,পোশাক-পরিচ্ছেদের মাধ্যমে, বিভিন্ন ফ্যাশনে, বিভিন্ন ডিজাইনে, বিভিন্ন শিক্ষার নামে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করে। তাই পিতা-মাতাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,

হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। [সূরা তাগাবুন-১৪]

হাদীসে এসেছে,

ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলে করীম রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরুষের বেশ ধারণকারী নারী ও নারীর বেশ ধারণকারী পুরুষকে অভিসম্পাত করেছেন। [সহীহ বুখারী:৫৮৮৫]

আব্দুল্লাহ ইবন আমর রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

‘যে ব্যক্তি অন্য জাতির সাথে সা-দৃশ্যতা রাখবে সে তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে। [সুনান আবূ দাউদ:৪০৩১]

১৯. দো‘আ করা : আমাদের সন্তানদের জন্য দো‘আ করতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দো‘আ শিক্ষা দিয়েছেন এভাবে,

আল্লাহর নেক বান্দা তারাই যারা বলে,

হে আমাদের রব, আমাদেরকে এমন স্ত্রী ও সন্তানাদি দান করুন যারা আমাদের চক্ষু শীতল করবে। আর আপনি আমাদেরকে মুত্তাকীদের নেতা বানিয়ে দিন। [সূরা আলফুরকান-৭৪]

যাকারিয়্যা আলাইহিস সালাম আল্লাহর নিকট দো‘আ করেছিলেন,

‘হে আমার রব, আমাকে আপনার পক্ষ থেকে উত্তম সন্তান দান করুন। নিশ্চয় আপনি প্রার্থনা শ্রবণকারী’। [সূরা আলে ইমরান ৩৮]

সম্মানিত পিতামাতাবৃন্দ, আমরা কি সন্তানের হকগুলো পালন করতে পেরেছি বা পারছি ? আসুন, আমরা আমাদের সন্তানদেরকে নেকসন্তান হিসাবে গড়ে তুলি। যে সম্পর্কে হাদিসে এসেছে,

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-
১. সদকায়ে জারিয়া
২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়
৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দো‘আ করে [সহিহ মুসলিম:১৬৩১]

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সন্তানদেরকে কবুল করুন,
তাদের হকসমূহ যথাযথভাবে পালন করার তাওফীক দিন। আমীন!

মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের জন্য করণীয় আমলসূমহ

$
0
0

011_03_32DEs

লেখকঃ হাবিবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল | অনুবাদক : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين، أما بعد

মা-বাবা ছোট শব্দ, কিন্তু এ দুটি শব্দের সাথে কত যে আদর, স্নেহ, ভালবাসা রয়েছে  তা পৃথিবীর কোন মাপযন্ত্র দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। মা-বাবা কত না কষ্ট করেছেন, না খেয়ে থেকেছেন, অনেক সময় ভাল পোষাকও পরিধান করতে পারেন নি, কত না সময় বসে থাকতেন সন্তানের অপেক্ষায়। সেই মা বাবা যাদের চলে গিয়েছেন, তারাই বুঝেন মা বাবা কত বড় সম্পদ। যেদিন থেকে মা বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন থেকে মনে হয় কী যেন হারিয়ে গেল,তখন বুক কেঁপে উঠে, চোখ থেকে বৃষ্টির মত পানি ঝরে, কী শান্তনাই বা তাদেরকে দেয়া যায়!  সেই মা বাবা যাদের চলে গিয়েছে তারা কি মা-বাবার জন্য কিছুই করবে না?। এত কষ্ট করে আমাদের কে যে মা-বাবা লালন পালন করেছেন তাদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মৃত মা-বাবা জন্য কী ধরনের আমল করা যাবে এবং যে আমলের সওয়াব তাদের নিকট পৌছবে তা উল্লেখ করা হলো:

১. বেশী বেশী দু‘আ করা

মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশী বেশী দু‘আ করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দু‘আ করবো তাও শিক্ষা দিয়েছেন । আল-কুরআনে এসেছে,

رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [الاسراء: ٢٤]

‘‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’’ [সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৪]

رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ ٤١﴾ [ابراهيم: ٤١]

‘‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’’ [সুরা ইবরাহীমঃ৪১]

এছাড়া আলস্নাহ রাববুল আলামীন পিতা-মাতার জন্য দূ‘আ করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেনঃ

رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيۡتِيَ مُؤۡمِنٗا وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارَۢا ٢٨ ﴾ [نوح: ٢٨

‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না ’[সূরা নুহ: ২৮] ।

মা-বাবা এমন সন্তান রেখে যাবেন যারা তাদের জন্য দোয়া করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

« إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ».

অর্থ: মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া  ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দু‘আ করে [সহিহ মুসলিম: ৪৩১০]

মূলত: জানাযার নামায প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ স্বরূপ।

২. দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রদান করাঃ

মা-বাবা বেচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে  সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّىَ افْتُلِتَتْ نَفْسَهَا وَلَمْ تُوصِ وَأَظُنُّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ أَفَلَهَا أَجْرٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا قَالَ « نَعَمْ »

অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃতু বরণ করেছেন। তাই কোন অছিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৭৩]

তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি।

৩. মা-বাবার পক্ষ থেকে সিয়াম  পালনঃ

মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোন মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

«مَنْ مَاتَ  وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ»

অর্থ: ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে’’ [সহীহ বুখারী:১৯৫২]।

অধিকাংশ আলেমগণ এ হাদীসটি শুধুমাত্র ওয়াজিব রোযা বা মানতের রোযার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলীল নাই।

৪. হজ্জ বা উমরাহ করাঃ

মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা  উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«أَنَّ امْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ جَاءَتْ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ إِنَّ أُمِّي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ فَلَمْ تَحُجَّ حَتَّى مَاتَتْ أَفَأَحُجُّ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ حُجِّي عَنْهَا أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً اقْضُوا اللَّهَ فَاللَّهُ أَحَقُّ بِالْوَفَاءِ»

অর্থ: ‘‘ জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’’ [সহীহ বুখারী: ১৮৫২]

তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।

৫. মা-বাবার ওসিয়ত পূর্ণ করাঃ

মা-বাবা শরীয়াহ সম্মত কোন ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব। রাশীদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنَّ أُمِّي أَوْصَتْ أَنْ نُعْتِقُ عَنْهَا رَقَبَةً ، وَعِنْدِي جَارِيَةٌ سَوْدَاءُ ، قَالَ : ادْعُ بِهَا ، فَجَاءَتْ ، فَقَالَ : مَنْ رَبُّكِ ؟ قَالَتِ : اللَّهُ ، قَالَ : مَنْ أَنَا ؟ قَالَتْ : رَسُولُ اللَّهِ ، قَالَ : أَعْتِقْهَا ، فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ».

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেন না সে মু’মিনা । [সহীহ ইবন হিববান :১৮৯]

৬. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করাঃ

মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া,তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَجُلاً مِنَ الأَعْرَابِ لَقِيَهُ بِطَرِيقِ مَكَّةَ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأْسِهِ فَقَالَ ابْنُ دِينَارٍ فَقُلْنَا لَهُ أَصْلَحَكَ اللَّهُ إِنَّهُمُ الأَعْرَابُ وَإِنَّهُمْ يَرْضَوْنَ بِالْيَسِيرِ. فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ».

অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবান দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ’’ [সহীহ মুসলিম:৬৬৭৭]।

মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«إِذَا ذَبَحَ الشَّاةَ فَيَقُولُ « أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَدِيجَةَ »

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও [সহীহ মুসলিম: ৬৪৩১]

৭. মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখাঃ

সন্তান তার মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ ، فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ»

‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ [সহীহ ইবন হিববান:৪৩২]

৮. ঋণ পরিশোধ করাঃ

মা-বাবার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهً حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ».

অর্থ: ‘‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। [সুনান ইবন মাজাহ:২৪১৩]

ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয় । হাদীসে  আরো এসেছে,

«مَا دَخَلَ الْجَنَّةَ حَتَّى يُقْضَى دَيْنُهُ»

অর্থ: যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [নাসায়ী ৭/৩১৪; তাবরানী ফিল কাবীর ১৯/২৪৮; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৯]

৯. কাফফারা আদায় করাঃ

মা-বাবার কোন শপথের কাফফারা,ভুলকৃত হত্যাসহ কোন কাফফারা বাকী থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَ‍ٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ ﴾ [النساء: ٩٢]

অর্থ: যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে সেটা ভিন্ন কথা) [ সূরা আন-নিসা:৯২]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

« مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فَرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَلْيَأْتِهَا وَلْيُكَفِّرْ عَنْ يَمِينِهِ ».

অর্থ: ‘‘ যে ব্যক্তি কসম খেয়ে শপথ করার পর তার থেকে উত্তম কিছু করলেও তার কাফফারা অদায় করবে’’ [সহীহ মুসলিম: ৪৩৬০] ।

এ বিধান জীবিত ও মৃত সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। দুনিয়ার বুকে কেউ অন্যায় করলে তার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে কেউ অন্যায় করে মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা প্রদান করবেন।

১০. ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ

মা-বাবার জন্য আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। হাদীসে বলা হয়েছে,

«عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : تُرْفَعُ لِلْمَيِّتِ بَعْدَ مَوْتِهِ دَرَجَتُهُ . فَيَقُولُ : أَيْ رَبِّ ، أَيُّ شَيْءٍ هَذِهِ ؟ فَيُقَالُ : وَلَدُكَ اسْتَغْفَرَ لَكَ»

অর্থ: আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু  হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কোন বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে হে আমার রব, আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল আসলো ? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছো’’ [আল-আদাবুল মুফরাদ:৩৬]।

মা-বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«عَنْ عُثْمَانَ ، قَالَ : وَقَفَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى قَبْرِ رَجُلٍ وَهُوَ يُدْفَنُ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَالَ : اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا اللَّهَ لَهُ بالثَّبَاتِ ؛ فَإِنَّهُ يُسْأَلُ الآنَ».

অর্থ: উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়ালেন এবং বললেন ‘‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য ঈমানের উপর অবিচলতা ও দৃঢ়তা কামনা কর, কেননা এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে’’ [মুসনাদুল বাজ্জার :৪৪৫]।

তাই সুন্নাত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে কবরে দেয়ার পর তার কবরের পার্শ্বে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রশ্নোত্তর সহজ করে দেয়া, প্রশ্নোত্তর দিতে সমর্থ হওয়ার জন্য দো‘আ করা।

১১. মান্নত পূরণ করাঃ

মা-বাবা কোন মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«أَنَّ امْرَأَةً نَذَرَتْ أَنْ تَصُومَ شَهْرًا فَمَاتَتْ فَأَتَى أَخُوهَا النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ :« صُمْ عَنْهَا ».

অর্থ: কোন মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলে তিনি বলরেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। [সহীহ ইবন হিববান:২৮০]

১২. মা-বাবার ভাল কাজসমূহ জারী রাখাঃ

মা-বাবা যেসব ভাল কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীসে এসেছে,

«مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ »

‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’। [সুনান আততিরমীযি : ২৬৭০]

«مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ»

যে ব্যক্তির ইসলামের ভাল কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৯৮]।

১৩. কবর যিয়ারত করাঃ

সন্তান তার মা-বাবার কবর যিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَقَدْ أُذِنَ لِمُحَمَّدٍ فِى زِيَارَةِ قَبْرِ أُمِّهِ فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ»

অর্থ: আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম,অত:পর মুহাম্মাদের মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর যিয়রাত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমীযি :১০৫৪]।

যিয়রাত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমীযি :১০৫৪]।

কবর যিয়ারত কোন দিনকে নির্দিষ্ট করে করা যাবে না। কবর যিযারত করার সময় বলবে,

«السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ ، نَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ».

অর্থ: কবরবাসী মুমিন-মুসলিম আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক । নিশ্চয় আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহর কাছে আপনাদের এবং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। [সুনান ইবন মাজাহ :১৫৪৭]

১৪. ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করাঃ

মা-বাবা কারো সাথে কোন ভাল কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তারা বেচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

وَأَوۡفُواْ بِٱلۡعَهۡدِۖ إِنَّ ٱلۡعَهۡدَ كَانَ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٤ ﴾ [الاسراء: ٣٤

অর্থ: আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। [ সূরা বনী ইসরাঈল:৩৪]

১৫.কোন গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করাঃ

মা-বাবা বেচে থাকতে কোন গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু  হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا ».

এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহীহ মুসলিম:৬৯৮০]।

১৬.মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়াঃ

মা-বাবা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর যুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে।  কেননা হাদীসে এসেছে,

«عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، فَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ ، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ ، فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ».

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আততিরমিযি :২৪২৮]

সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

অল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মা বাবার জন্য আমলগুলো করার তাওফীক দিন। আমীন!

وصلى الله على نبينا محمد وعلي اله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين- وأخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

বিবাহে প্রচলিত কু-প্রথা

$
0
0
Marraigeলেখক- হুসাইন বিন সোহরাব
বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিবাহ করা নবীগণের (আলাহিসসালাতু আসসালাম) সুন্নাত।
রাসুল(সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ
যে বাক্তি বিয়ে করার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিয়ে করে না, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়। (দারিমী-কিতাবুন নিকাহ)
ইমাম রাগিব বলেনঃ
বিয়েকে দুর্গ বলা হয়েছে,কেননা(বিয়ে) স্বামী-স্ত্রী উভয়কে সকল প্রকার লজ্জাজনক কাজ থেকে দুর্গবাসীদের মতোয় বাচিয়ে রাখে। (মুফরাদাত)
তবে এই পবিত্র কর্ম পালন করতে গিয়ে মাঝে মাঝে কিছু কু-প্রথা মানা হয়।যা কিনা অনুচিত।আসুন নবীগণের(আলাহিসসালাতু আসসালাম)  এই সুন্নাত কে সুন্নাত তরীকায় পালন করি।
বিবাহে প্রচলিত কু-প্রথা: 
১.চন্দ্র বর্ষের কোন মাসে বা কোন দিনে অথবা বর/কনের জন্ম তারিখে বা তাদের পূর্ব পুরুষের মৃত্যুর তারিখে বিবাহ শাদী হওয়া অথবা যে কোন শুভ সৎ কাজ করার জন্য ইসলামী শারী’য়াতে বা ইসলামী দিন তারিখের কোন বিধি নিষেধ নেয়। বরং উপরিউক্ত কাজগুলো বিশেষ কোন মাসে বা যে কোন দিনে করা যাবে না মনে করাই গুনাহ।
২.বিবাহ উৎসবে অথবা অন্য যে কোন উৎসবে পটকা-আতশবাজি ফুটান,অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা, রংবাজী করা বা রঙ দেওয়ার ছড়াছড়ি ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ ও অপচয়।
আল্লাহু-তা’য়ালা বলেনঃ

إِنَّ الْمُبَذِّرِينَ كَانُوا إِخْوَانَ الشَّيَاطِينِ ۖ وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِرَبِّهِ كَفُورًا 

“নিশ্চয় অপচয়কারী শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর প্রতি বড় অকৃতজ্ঞ।” (বানী ইসরাঈল-২৭)
৩.বাঁশের কুলায় চন্দন,মেহদি,হলুদ,কিছু ধান-দূর্বা ঘাস কিছু কলা, সিঁদুর ও মাটির চাটি নেওয়া হয়।মাটির চাটিতে তেল নিয়ে আগুন জ্বালানো হয়। স্ত্রী ও বরের কপালে তিনবার হলুদ লাগায় এমনকি মূর্তিপূজার ন্যায় কুলাতে রাখা আগুন জ্বালানো চাটি বর-কনের মুখের সামনে ধরা হয় ও আগুনের ধুঁয়া ও কুলা হেলিয়ে-দুলিয়ে বাতাস দেওয়া হয়। এসব হিন্দুয়ানী প্রথা ও অনৈসলামিক কাজ।
৪.বরের আত্মীয়রা কনেকে কোলে তুলে বাসর ঘর পর্যন্ত পৌছে দেওয়া অথবা বরের কোলে করে মুরুব্বীদের সামনে স্ত্রীর বাসর ঘরে গমনের নীতি একটি বেহায়াপনা, নিরলজ্জতা ও অনৈসলামিক কাজ।
৫.বরের ভাবী ও অন্য যুবতী মেয়েরা বরকে সমস্ত শরীরে হলুদ মাখিয়ে গোসল করিয়ে দেওয়া নির্লজ্জ কাজ যা ইসলাম সমর্থন করে না।
৬.বর ও কনেকে হলুদ বা গোসল করতে নিয়ে যাওয়ার সময় মাথার উপর বড় চাদর এর চার কোনা চার জনের ধরা হিন্দুয়ানী প্রথা।
৭.বিবাহ করতে যাওয়ার সময় বরকে পিড়িতে বসিয়ে বা সিল-পাটাই দাড় করিয়ে দই-ভাত খাওয়ান ইসলামিক প্রথা নয়।
৮.বিবাহ কাজ সম্পূর্ণ হওয়ার পর বরকে দাড় করিয়ে সালাম দেওয়ানোর প্রথা রাসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীদের (রাযি আল্লাহু আনহুম) দ্বারা প্রমানিত নয়।
৯.বর ও কনের মুরুব্বীদের কদমবুসি করা একটি মারাত্মক কু-প্রথা। বিয়ে তো নয় এমনকি যে কোন সময় কদমবুসি করা রাসুল (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও তার সাহাবীদের (রাযি আল্লাহু আনহুম) দ্বারা কোন কালে প্রমানিত নয়। কদমবুসি করার সময় সালাতের রুকু-সিজদার মত অবস্থা হয়। বেশি সম্মান প্রদর্শন করতে গিয়ে হিন্দুয়ানী প্রণামকে প্রথা হিসেবে নিয়ে আসা মুমিনদের বৈশিষ্ট্য নয়।
ইয়া আল্লাহ,দয়া করে আমাদের তুমি সুন্নাত তরীকায় বিবাহ করার তওফিক দিয়।আমিন।

ইসলামের দৃষ্টিতে আন্তধর্ম বিয়ে

$
0
0

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদক: মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

আন্তধর্ম বিয়ে সম্পর্কে ইসলাম :

মুসলিম হয়ে অন্য ধর্মাবলম্বীকে বিয়ে করা প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

আর তোমরা মুশরিক নারীদের বিয়ে করো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে এবং মুমিন দাসী মুশরিক নারীর চেয়ে নিশ্চয় উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। আর মুশরিক পুরুষদের সাথে বিয়ে দিয়ো না, যতক্ষণ না তারা ঈমান আনে। আর একজন মুমিন দাস একজন মুশরিক পুরুষের চেয়ে উত্তম, যদিও সে তোমাদেরকে মুগ্ধ করে। তারা তোমাদেরকে আগুনের দিকে আহ্বান করে, আর আল্লাহ তাঁর অনুমতিতে তোমাদেরকে জান্নাত ও ক্ষমার দিকে আহ্বান করেন এবং মানুষের জন্য তাঁর আয়াতসমূহ স্পষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ২২১}

আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবূ মারছিদ নামক এক সাহাবীকে মক্কায় প্রেরণ করেন গোপনে গিয়ে সেখানে থেকে যাওয়া লোকদের আনতে। তিনি সেখানে পৌঁছলে ‘ইনাক নামক এক মুশরিক নারী তাঁর কথা শুনতে পায়। সে ছিল তাঁর জাহেলী যুগের বান্ধবী। সে তাঁর কাছে এসে বলল, হে আবূ মারছিদ তুমি কি আমায় সান্নিধ্য দেবে না? তিনি বললেন, ধ্বংস হও তুমি হে ‘ইনাক, ইসলাম এখন আমাদের মাঝে ওই কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে। সে বলল, তবে কি তুমি আমায় বিয়ে করতে পার? তিনি বললেন, হ্যা, কিন্তু আমাকে আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে যেতে হবে। তাঁর কাছে আমি (তোমাকে) বিয়ে করার অনুমতি প্রার্থনা করব। সে বলল, তুমি আমাকে উপেক্ষা করছ? অতপর মেয়েটি তাঁর বিরুদ্ধে (নিজ গোত্রীয়) লোকদের সাহায্য চাইল। তারা তাঁকে বেদম প্রহার করল। তারপর তাঁর পথ ছেড়ে দিল। মক্কায় নিজের কাজ সেরে তিনি যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গেলেন, তাঁকে তিনি নিজের অবস্থা, ‘ইনাকের বিষয় এবং এ জন্য প্রহৃত হবার ঘটনা জানালেন। তারপর বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমার জন্য কি তাকে (মুশরিক নারীকে) বিয়ে করা হালাল হবে? তখন আল্লাহ এই আয়াতটি নাযিল করেন।[1]

এই আয়াতের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাফসীর শাস্ত্রের ইমাম ইবনু জারীর আত-তবারী রহিমাহুল্লাহ বলেন,

اخْتَلَفَ أَهْلُ التَّأْوِيلِ فِي هَذِهِ الآيَةِ : هَلْ نَزَلَتْ مُرَادًا بِهَا كُلُّ مُشْرِكَةٍ ، أَمْ مُرَادًا بِحُكْمِهَا بَعْضَ الْمُشْرِكَاتِ دُونَ بَعْضٍ ؟ وَهَلْ نُسِخَ مِنْهَا بَعْدَ وُجُوبِ الْحُكْمِ بِهَا شَيْءٌ أَمْ لاَ ؟ فَقَالَ بَعْضُهُمْ : نَزَلَتْ مُرَادًا بِهَا تَحْرِيمُ نِكَاحِ كُلِّ مُشْرِكَةٍ عَلَى كُلِّ مُسْلِمٍ مِنْ أَيِّ أَجْنَاسِ الشِّرْكِ كَانَتْ عَابِدَةَ وَثَنٍ أَوْ كَانَتْ يَهُودِيَّةً أَوْ نَصْرَانِيَّةً أَوْ مَجُوسِيَّةً أَوْ مِنْ غَيْرِهِمْ مِنْ أَصْنَافِ الشِّرْكِ ، ثُمَّ نُسِخَ تَحْرِيمُ نِكَاحِ أَهْلِ الْكِتَابِ بِقَوْلِهِ : {يَسْأَلُونَكَ مَاذَا أُحِلَّ لَهُمْ قُلْ أُحِلَّ لَكُمُ الطَّيِّبَاتُ} إِلَى {وَطَعَامُ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حِلٌّ لَكُمْ وَطَعَامُكُمْ حِلٌّ لَهُمْ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ وَالْمُحْصَنَاتُ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ مِنْ قَبْلِكُمْ} ..ذِكْرُ مَنْ قَالَ ذَلِكَ :

‘আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর বিশারদগণ এ ব্যাপারে মতবিরোধ করেছেন যে এতে সকল মুশরিকের কথা বলা হয়েছে নাকি কতিপয় মুশরিকের কথা। আর আয়াতটি নাযিল করার পর এর কিছুকে মানসূখ বা রহিত করা হয়েছে কি-না। তাঁদের কেউ বলেছেন, আয়াতে সকল মুসলিমের জন্য সব মুশরিক নারীর বিবাহকে হারাম বুঝানো হয়েছে। চাই সে যে কোনো ধরনের শিরকেই লিপ্ত থাকুক না কেন। হোক সে মূর্তিপূজারী, ইহুদী, খ্রিস্টান, অগ্নিপূজারী বা অন্য কোনো ধরনের শিরকে লিপ্ত কেউ।

অতপর আহলে কিতাবদের বিয়ে হারামের বিয়ষটি রহিত ঘোষণা করা হয় নিচের আয়াতের মাধ্যমে।

আল্লাহ তা‘আলা তাতে ইরশাদ করেন,

﴿ ٱلۡيَوۡمَ أُحِلَّ لَكُمُ ٱلطَّيِّبَٰتُۖ وَطَعَامُ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ حِلّٞ لَّكُمۡ وَطَعَامُكُمۡ حِلّٞ لَّهُمۡۖ وَٱلۡمُحۡصَنَٰتُ مِنَ ٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ وَٱلۡمُحۡصَنَٰتُ مِنَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡكِتَٰبَ مِن قَبۡلِكُمۡ إِذَآ ءَاتَيۡتُمُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ مُحۡصِنِينَ غَيۡرَ مُسَٰفِحِينَ وَلَا مُتَّخِذِيٓ أَخۡدَانٖۗ وَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلۡإِيمَٰنِ فَقَدۡ حَبِطَ عَمَلُهُۥ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٥ ﴾ [المائ‍دة: ٥]

আজ তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো সব ভালো বস্তু এবং যাদেরকে কিতাব প্রদান করা হয়েছে, তাদের খাবার তোমাদের জন্য বৈধ এবং তোমার খাবার তাদের জন্য বৈধ। আর মুমিন সচ্চরিত্রা নারী এবং তোমাদের পূর্বে যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা নারীদের সাথে তোমাদের বিবাহ বৈধ। যখন তোমরা তাদেরকে মোহর দেবে, বিবাহকারী হিসেবে, প্রকাশ্য ব্যভিচারকারী বা গোপনপত্নী গ্রহণকারী হিসেবে নয়’। {সূরা আল-মায়িদা, আয়াত : ৫} এ আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সতী-সাধ্বী খ্রিস্টান ও ইহুদীদের বিয়ের অনুমতি দিয়েছেন।[2]

একই শাস্ত্রের আরেক ইমাম ইবন কাছীর রহিমাহুল্লাহ বলেন, এ আয়াতে আল্লাহ সাধারণভাবে শিরকে লিপ্ত সব নারীকে বিয়ে করা হারাম ঘোষণা করেছেন, চাই সে মূর্তিপূজক কিংবা আহলে কিতাব সম্প্রদায়ভুক্ত হোক। তবে পরবর্তীতে মায়িদার আয়াতে তাদের মধ্যে কেবল আসমানী কিতাবধারী সচ্চরিত্রা নারীদের বিশেষভাবে বিয়ের অনুমতি দেয়া হয়েছে।[3]

উপরোক্ত ব্যাখ্যার আলোকে প্রতিভাত হয় যে বিশেষ কিছু শর্ত সাপেক্ষেই কেবল খ্রিস্টান বা ইহুদী নারীকে কোনো মুসলিম বিয়ে করতে পারে।

এক. বাস্তবিকই আহলে কিতাব হতে হবে। শুধু নামে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হলে চলবে না। নামে ইহুদী-খ্রিস্টান অথচ সে নাস্তিক কিংবা নিজ ধর্মকে বিশ্বাস করে না; তাহলে চলবে না।

দুই. অবশ্যই তাকে পবিত্র হতে হবে। ব্যভিচারিণী হলে চলবে না।

তিন. এমন কাউকে বিয়ে করা যাবে না যার জাতি পুরো মুসলিম উম্মতের সাথে ঘোর শত্রুতা পোষণ করে, যেমন : বর্তমান সময়ের ইসরাঈলের ইহুদীরা।

চার. বিয়ের কারণে স্বামীর সন্তানের কোনো বৈষয়িক ক্ষতি সাধিত হওয়ার আশংকা থাকলেও আহলে কিতাব বিয়ে করা যাবে না।[4]

আন্তধর্ম বিয়ের ভয়াবহ পরিণতি :

বিয়ে একটি ধর্মীয় ও সামাজিক বন্ধন। নিজের খেয়াল-খুশি মতো এ বন্ধনের নিয়মে ব্যত্যয় ঘটাবার সুযোগ নেই। ইসলাম মানবজীবনের সব পর্যায়ের যাবতীয় উপলক্ষ ও অনুসর্গকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কেমন হবে, দিয়েছে তার দ্ব্যর্থহীন দিকনির্দেশনা। এই জীবনদিশা আল্লাহ প্রদত্ত বিধায় এর মধ্যে কোনো গলদ নেই। সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিয়ে সম্পর্কিত আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণের বিকল্প নেই। এর বাইরে যাওয়ার চেষ্টা মানেই নিজেদের ধ্বংস নিজেরা ডেকে আনা। ব্যক্তি স্বাধীনতার নাম দিয়ে বল্গাহীনভাবে কিছু করার স্বাধীনতা ইসলামে নেই। যারা নিজের স্বাধীনতা দিয়ে অন্যের ধর্ম, সম্মান, রীতি-নীতি ও স্বাধীনতাকে নষ্ট করে তারা মানবতার শত্রু।

আন্তধর্ম বিয়ের পরিণতি হতে পারে ভয়াবহ। বাংলাদেশে আগে দেখা যেত, কেউ নিজের ধর্ম ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইলে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে বিয়ে করতে হতো বিধায় সহজে কেউ ওপথে হাঁটতো না। এখন বিষয়টি সহজ হয়ে যাবে। ধর্ম ত্যাগ না করেই যুবক-যুবতীরা তাদের রঙ্গলীলা সাঙ্গ করতে নেমে পড়বে। কোনো ধর্মের স্বকীয়তা আর থাকবে না। যার ফল দাঁড়াবে অদূর ভবিষ্যতে গোটা সমাজ ব্যবস্থাই ধর্মহীন হয়ে পড়বে। যেনা-ব্যভিচার ডাল-ভাতে পরিণত হবে। জন্ম নেবে জারজ সন্তান। একদিন জারজ সন্তানে দেশ ভরে যাবে। আর এই ব্যভিচার নামক গর্হিত কাজটি আল্লাহর কিতাব, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ ও সমগ্র উম্মাহর ঐক্যমত্যে হারাম। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓۖ إِنَّهُۥ كَانَ فَٰحِشَةٗ وَسَآءَ سَبِيلٗا ٣٢ ﴾ [الاسراء: ٣٢]

আর তোমরা ব্যভিচারের কাছে যেয়ো না, নিশ্চয় তা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ’। {সূরা বানী ইসরাঈল, আয়াত : ৩২}

ব্যভিচার তো দূরের কথা ইসলামে যে কোনো ধরনের অশ্লীলতাকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلۡ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَ وَٱلۡإِثۡمَ وَٱلۡبَغۡيَ بِغَيۡرِ ٱلۡحَقِّ وَأَن تُشۡرِكُواْ بِٱللَّهِ مَا لَمۡ يُنَزِّلۡ بِهِۦ سُلۡطَٰنٗا وَأَن تَقُولُواْ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٣٣ ﴾ [الاعراف: ٣٣]

বল, ‘আমার রব তো হারাম করেছেন অশ্লীল কাজ- যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে, আর পাপ ও অন্যায়ভাবে সীমালঙ্ঘন এবং আল্লাহর সাথে তোমাদের শরীক করা, যে ব্যাপারে আল্লাহ কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি এবং আল্লাহর ব্যাপারে এমন কিছু বলা যা তোমরা জান না’। {সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত : ৩৩}

অপর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন,

﴿ ۞قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡ‍ٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗاۖ وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَوۡلَٰدَكُم مِّنۡ إِمۡلَٰقٖ نَّحۡنُ نَرۡزُقُكُمۡ وَإِيَّاهُمۡۖ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلۡفَوَٰحِشَ مَا ظَهَرَ مِنۡهَا وَمَا بَطَنَۖ وَلَا تَقۡتُلُواْ ٱلنَّفۡسَ ٱلَّتِي حَرَّمَ ٱللَّهُ إِلَّا بِٱلۡحَقِّۚ ذَٰلِكُمۡ وَصَّىٰكُم بِهِۦ لَعَلَّكُمۡ تَعۡقِلُونَ ١٥١ ﴾ [الانعام: ١٥١]

বল, ‘এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি। তা এই যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিযক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার’। {সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১৫১}

যেনা-ব্যভিচারের ভয়াবহতা তুলে ধরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারবার মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। যেমন আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« لا يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ , وَلا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ , وَلا يَنْتَهِبُ مُنْتَهِبٌ النُّهْبَةَ يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ ».

যেনাকারী মুমিন থাকে না যখন সে যেনা করে, আর মদ্যপ মুমিন থাকে না যখন মদ পান করে, চোর মুমিন থাকে না যখন সে চুরি করে, ছিনতাইকারী মুমিন থাকে না যখন সে কোনোরূপ ছিনতাই করে আর লোকেরা তার দিকে (বিস্ময় বিস্ফোরিত নেত্রে) চেয়ে থাকে।’[5]

আবদুর রহমান ইবন সাখার রাদিআল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

« إِذَا زَنَى الْعَبْدُ خَرَجَ مِنْهُ الْإِيمَانُ فَكَانَ فَوْقَ رَأْسِهِ كَالظُّلَّةِ فَإِذَا خَرَجَ مِنْ ذَلِكَ الْعَمَلِ عَادَ إِلَيْهِ الْإِيمَانُ ».

‘বান্দা যখন যেনা করে তখন তার কাছ থেকে ঈমান বেরিয়ে যায় এবং তা ছায়ার মতো (শূন্যে) দুলতে থাকে। অতপর যখন সে ওই কাজ থেকে নিবৃত হয়, তখন তার কাছে ঈমান ফিরে আসে।’[6]

বিশেষ বিবাহ আইনটি বাংলাদেশে কার্যকর হলে সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হবে দু’ধর্ম পালনকারী দম্পতির সন্তানরা। মানসিকভাবে তারা বিকারগ্রস্ত হবে। মুসলিম বাবা বলবেন, আল্লাহ এক আর মা বলবেন ঈশ্বর তিনজন অথবা আমাদের অসংখ্য খোদা রয়েছেন। মুসলিম বাবা যেটাকে বলবেন সত্য সেটাকেই অমুসলিম মা বলবেন অসত্য। মা-বাবার এই বিপরীত অবস্থান থেকে সন্তানের মনে ঘৃণার জন্ম নেবে। জীবনের ঊষাকাল থেকে মধ্যগগন অবধি সে হাবুডুবু খাবে সিদ্ধান্তহীনতার চোরাবালিতে। এছাড়া উত্তরাধিকারী হয়ে মা বাবার সম্পত্তি ভোগ করতেও ঝামেলায় পড়তে হবে সন্তানকে। প্রচলিত আইনে স্বামী-স্ত্রীর অধিকার পেতেও তাদের ঝামেলা পোহাতে হবে। মোটকথা নৈরাজ্য ছাড়া উপায় নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের একজন অধ্যাপক দৈনিক নয়াদিগন্তকে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপকের মুসলিম স্ত্রীর কথা তুলে ধরে বলেন, ওই পরিবারে জন্ম নেয়া সন্তানটি কোন ধর্ম গ্রহণ করবে, সেটি নির্ধারণ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীতে সমস্যা এখন মনোমালিন্য পর্যায়ে পৌঁছেছে। তিনি বলেন, দেশের একজন খ্যাতিমান প্রবাসী কথাশিল্পীর স্বামী মুসলিম। তিনি হিন্দু। তার সন্তান মারা যাওয়ার পর তাকে জানাযা দেয়া হবে নাকি দাহ করা হবে তা নিয়ে প্রচণ্ড সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল। তাই এ ধরনের বিয়ে সমাজে কোনো রকমের ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। এটা একটা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে মাত্র। (১ মে সংখ্যা)

তাই পৃথিবীর কোনো ধর্মই অন্য ধর্মের অনুসারীকে বিয়ে করাটা ভালোভাবে নেয় না। এটি একটি অস্বাভাবিক অবস্থা। ব্যতিক্রম শুধু ইহুদী ধর্ম। তাদের ব্যাপারটি বেশ মজারও বটে! ইহুদীরা তাদের মেয়েদের অন্য ধর্মাবলম্বীদের কাছে বিয়ে দেয়, কিন্ত কখনোই ছেলেদের এই অনুমতি দেয় না। কারণ তাদের বিশ্বাস, সন্তানেরা তাদের মায়েদের ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। এ কারণে বিল ক্লিন্টনের মেয়েকে এক ইহুদী ছেলে বিয়ে করায় জুইস কাউন্সিল এর তীব্র সমালোচনা করেছিল। অতএব নিজেদের জাতকে বিশুদ্ধ রেখে অন্য সকল ধর্মের মধ্যে ফ্রি মিক্সিং বা জগাখিচুড়িকে উত্সাহিত করা ইহুদীদের কৌশল। বাংলা রম্য রচনার বরপুত্র সৈয়দ মুজতবা আলীর কর্নেল গল্পে এর ইঙ্গিত দেওয়া আছে।

ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ মতে শিশুকে তার বাবা মায়ের ধর্মের অনুসারী ধরা হলে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব হয়। শিশুকে যে কোনো নীতি বা আদর্শের দীক্ষা দেওয়াই তার স্বাধীনতার পরিপন্থী! তাই হয়তো বড় হয়ে বিবেক-বুদ্ধি অনুসারে যে কোনো ধর্মের অনুকরণ করা না করা তার এখতিয়ারে রাখা হয়েছে। তাহলে প্রশ্ন হলো, দেশাত্ববোধের বিষয়টিও কি তার ইচ্ছাধীন? বড় হয়ে তার কি দেশের সংবিধান ও আদর্শে বিশ্বাসী না হবারও অধিকার রয়েছে? কোনো উদারতম ধর্মনিরপেক্ষ বা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রও কিন্তু এ অধিকার দেবে না।

আসলে মানুষ কখনোই পুরোপুরি স্বাধীন নয়। তার স্বাধীনতা সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত। আর একজন মুসলিমের স্বাধীনতার প্রথম শর্তই হলো তা আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির মধ্যে থাকতে হবে। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে,

﴿ وَمَن يَبۡتَغِ غَيۡرَ ٱلۡإِسۡلَٰمِ دِينٗا فَلَن يُقۡبَلَ مِنۡهُ وَهُوَ فِي ٱلۡأٓخِرَةِ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٨٥ ﴾ [ال عمران: ٨٥]

আর যে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো দীন চায় তবে তার কাছ থেকে তা কখনো গ্রহণ করা হবে না এবং সে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’। {সূরা আলে-ইমরান, আয়াত : ৮৫}

কেউ সুন্দরী বিধর্মী নারীতে মজে আল্লাহর বিধান উপেক্ষা করবেন আর নিজেকে খুব ভালো মুসলিম ভেবে আবার তৃপ্তও হবেন তা কিন্তু হয় না। তারা মূলত বোকার স্বর্গে বাস করছেন। কিছু মানা আর কিছু না মানার কোনো সুযোগ ইসলামে রাখা হয় নি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ أَفَتُؤۡمِنُونَ بِبَعۡضِ ٱلۡكِتَٰبِ وَتَكۡفُرُونَ بِبَعۡضٖۚ فَمَا جَزَآءُ مَن يَفۡعَلُ ذَٰلِكَ مِنكُمۡ إِلَّا خِزۡيٞ فِي ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يُرَدُّونَ إِلَىٰٓ أَشَدِّ ٱلۡعَذَابِۗ وَمَا ٱللَّهُ بِغَٰفِلٍ عَمَّا تَعۡمَلُونَ ٨٥ ﴾ [البقرة : ٨٥]

তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশে ঈমান রাখ আর কিছু অংশ অস্বীকার কর? সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা তা করে দুনিয়ার জীবনে লাঞ্ছনা ছাড়া তাদের কী প্রতিদান হতে পারে? আর কিয়ামতের দিনে তাদেরকে কঠিনতম আযাবে নিক্ষেপ করা হবে। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ সে সম্পর্কে গাফিল নন’। {সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ৮৫}

নিজের মন মতো নয় আমাদের সব কাজ হতে হবে আল্লাহর প্রেরিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুযায়ী। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন,

﴿ فَلَا وَرَبِّكَ لَا يُؤۡمِنُونَ حَتَّىٰ يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيۡنَهُمۡ ثُمَّ لَا يَجِدُواْ فِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَرَجٗا مِّمَّا قَضَيۡتَ وَيُسَلِّمُواْ تَسۡلِيمٗا ٦٥ ﴾ [النساء: ٦٥]

অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফয়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়’। {সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৬৫}

বাংলাদেশে আন্তধর্ম বিয়ে আইন :

নিজ ধর্ম বিশ্বাস বাদ দিয়ে যেসব নারী-পুরুষ বিয়ে করতে আগ্রহী তাদের বিয়ের রেজিস্ট্রি করতে গত ১৮ এপ্রিল ২০১২ ইং আইনমন্ত্রীর এপিএস (সহকারী একান্ত সচিব) আকছির এম চৌধুরীকে নিয়োগ দেয়া হয়। এতদিন এই বিয়ে পড়ানোর একমাত্র স্থান হিসেবে নির্ধারিত ছিল পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী শরৎচন্দ্র ব্রাহ্ম প্রচারক নিবাস। এখানে প্রাণেশ সমাদ্দার ছিলেন সরকার নিযুক্ত একমাত্র রেজিস্ট্রার। এখন উভয়ে এই বিয়ে রেজিস্ট্রি করতে পারবেন। এখানে সবাই স্বাধীনভাবে যে কোনো ধর্মের (হিন্দু-বৌদ্ধ, খ্রিস্টান-মুসলমান) নারী-পুরুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবেন।

এই আইন অনুযায়ী একজন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মের যে কেউ যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। ধর্ম পরিবর্তন ছাড়াই তারা দাম্পত্য জীবনে প্রবেশ করতে পারবে। ইচ্ছে করলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অথবা যে কোনো একজন নিজ ধর্মীয় বিশ্বাস বাদ দিতে পারে। এ ধরনের বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সন্তানদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। বড় হয়ে (১৮ বছর) তারা যে কোনো ধর্ম বেছে নিতে পারবে অথবা ধর্ম বিশ্বাস ছাড়াই জীবন যাপন করতে পারবে। (১ মে, ২০১২ দৈনিক নয়া দিগন্ত ও আমার দেশ)

আইন সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা :

আইনটি পাসের উদ্যোগ নেয়ার পর থেকে দেশের আলেম সমাজ একে ইসলামবিরোধী আখ্যায়িত করে বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রতিবাদ জানিয়ে আসছেন। সকল দল-মতের ইসলামী ভাবাপন্ন নেতৃবৃন্দ এবং সর্বশ্রেণীর ধর্মপ্রাণ মানুষ এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকার বলছে, প্রস্তাবিত আইনে ইসলামবিরোধী কিছু নেই।

১৫ মে (সোমবার) আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিবাহ আইন সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়, ‘বিশেষ বিবাহ আইনটি ১৮৭২ সালে প্রণীত হয়েছে। এ আইন এখনো বর্তমান আছে। বর্তমান সরকারের সময় এ আইনের কোনো প্রকার সংশোধন হয় নি। আইনটি অপরিবর্তিত অবস্থায় বহাল আছে।’

এতে আরো বলা হয়েছে, ‘১৮৭২ সালের এ আইন অনুযায়ী একজন মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, ইহুদী কিংবা অন্য যে কোনো ধর্মের যে কেউ যে কাউকে বিয়ে করতে পারবে। এজন্য পাত্র-পাত্রী কাউকেই ধর্মান্তরিত হতে হবে না। এ ধরনের বিয়ের মাধ্যমে জন্ম নেয়া সন্তানদের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকবে না। তারা ১৮ বছর বয়সের পর যে কোনো ধর্ম বেছে নিতে পারবে।’ (আমার দেশ : ১৬/০৫/২০১২)

আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার অসারতা :

বক্তব্যটি আসলে একটি স্পষ্ট মিথ্যাচারের নমুনা। কেননা, ১৮৭২ সালের আইনেও মুসলমান কর্তৃক বিধর্মীদের বিয়ে জায়িয বলা হয় নি। ১৮৭২ সালের বিশেষ বিয়ে আইনে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি খ্রিস্টান, ইহুদী, হিন্দু, মুসলিম, পারসি, বৌদ্ধ, শিখ অথবা জৈন কোনো ধর্মই পালন করে না, তারা এ আইনের অধীনে বিয়ে করতে পারে। এ আইনের অধীনে বিয়ে করতে হলে পাত্র-পাত্রীকে ঘোষণা করতে হবে, তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করে না। ধর্ম ত্যাগের ঘোষণা না করলে বিয়েটি অবৈধ, বরং বাতিল হবে। তবে বিয়েটি যদি হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ ও জৈনদের মধ্যে সম্পাদন করা হয় তাহলে তারা নিজ নিজ ধর্ম অনুসরণ করতে পারবে।

নিচে ১৮৭২ সালে প্রণীত স্পেশাল ম্যারিজ এ্যাক্ট বা বিশেষ বিবাহ আইনটি হুবহু তুলে ধরা হলো :

THE SPECIAL MARRIAGE ACT, 1872

(ACT NO. III OF 1872). [18th July, 1872]

Local extent 1. This Act extends to the whole of [Bangladesh].

An Act to provide a form of Marriage in certain cases.

Preamble WHEREAS it is expedient to provide a form of marriage for persons who do not profess the Christian, Jewish, Hindu, Muslim, Parsi, Buddhist, Sikh or Jaina religion, and for persons who profess the Hindu, Buddhist, Sikh or Jaina religion and to legalize certain marriages the validity of which is doubtful; It is hereby enacted as follows:–

Conditions upon which marriages under Act may be celebrated :

2. Marriages may be celebrated under this Act between persons neither of whom professes the Christian or the Jewish, or the Hindu or the Muslim or the Parsi or the Buddhist, or the Sikh or the Jaina religion, or between persons each of whom professes one or other of the following religions, that is to say, the Hindu, Buddhist, Sikh or Jaina religion upon the following conditions:–
(1) neither party must, at the time of the marriage, have a husband or wife living:

(2) the man must have completed his age of eighteen years, and the woman her age of fourteen years, according to the Gregorian calendar:

(3) each party must, if he or she has not completed the age of twenty-one years, have obtained the consent of his or her father or guardian to the marriage:

(4) the parties must not be related to each other in any degree of consanguinity or affinity which would, according to any law to which either of them is subject, render a marriage between them illegal.

1st Proviso- No such law or custom, other than one relating to consanguinity or affinity, shall prevent them from marrying.

2nd Proviso- No law or custom as to consanguinity shall prevent them from marrying, unless a relationship can be traced between the parties through some common ancestor, who stands to each of them in a nearer relationship than that of great-great-grand-father or great-great-grand-mother, or unless one of the parties is the lineal ancestor, or the brother or sister of some lineal ancestor, of the other.

আইনের ধারাগুলো পড়লেই বুঝা যায় বর্তমানে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। বৃটিশ প্রণীত এই আইনটিকে বলা হয়েছে ‘বিশেষ বিবাহ আইন’। পক্ষান্তরে সরকার যে আইনটি করতে যাচ্ছে তা মূলত তো ‘আন্তধর্ম বিয়ে আইন’। বিশেষ আর আন্তধর্ম বিয়ের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। বিশেষ বিবাহ আইন হলো, স্বধর্মত্যাগীদের জন্য এক বিশেষ ব্যবস্থা। পক্ষান্তরে আন্তধর্ম বিয়ে হলো, এক ধর্মের লোকের সঙ্গে আরেক ধর্মাবলম্বীর বিয়ে।

সুতরাং বৃটিশ আমলে খ্রিস্টান সরকারও কিন্তু সরাসরি কুরআন-সুন্নাহর সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধাতে যায় নি। অতএব কুরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের ভোটে নির্বাচিত মুসলিম সরকারকে বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে। যারা এমন বিয়ের বাঁধনে জড়াতে চান তাদের উদ্দেশে বলি, সমাজ ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই যদি বিয়ে করতে হয় তবে এ সম্পর্কে জড়ানোর কী দরকার? যারা সরাসরি আল্লাহর বাণীকে অবজ্ঞা করে তাদের কাছে যেনা-ব্যভিচার তো কোনো ব্যাপারই না। এ দিয়েই তো তাদের কাজ চলার কথা। সামাজিক ও আইনগত দায়বদ্ধতায় আনতেই কি তবে তাদের বিয়ের বৈধতা প্রয়োজন? উত্তর হ্যা হলে প্রশ্ন, যারা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতি-নীতির তোয়াক্কা করে না তাদের সামাজিক বৈধতা দিতে রাষ্ট্রের এত দায় কেন?

এটি আসলে প্রবঞ্চনামূলক জবাব। তা না হলে হঠাৎ করে দু’জন কাজী নিয়োগ দিয়ে কেন বলা হবে, সারাদেশেও প্রয়োজন হলে এ ধরনের কাজী নিয়োগ হবে। যেখানে বছরে দু-চারজন নিজ ধর্ম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে বিয়ে-শাদি করছে সেখানে কয়জন কাজী লাগে? তাছাড়া ১৮৭২ সনের বৃটিশ আইনই আমাদের রাখার দরকার কী? প্রতিনিয়ত সব কিছু উল্টাতে পারলে ওই আইন নিয়ে কেন মাথা ব্যথা?

অতএব সরকার ও দেশের সর্বশ্রেণীর মুসলিম ভাই-বোনের প্রতি অনুরোধ থাকবে, আপনারা না জেনে না বুঝে পবিত্র কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবেন না। পবিত্র কুরআনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে তা-ই হবে আমাদের ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। সর্বশক্তিমান আল্লাহই একমাত্র আমাদের ভরসাস্থল; কেবল তিনিই যাবতীয় প্রতিকূলতা থেকে এই দেশ ও জাতিকে রক্ষা করতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে সুমতি দান করুন। আমীন।

[1]. তাফসীর তাবারী : ৪/৩৬৪।

[2]. তাফসীরে তাবারী : ৪/৩৬৩; আল-ওয়াসিত : ৩২০-৩২১।

[3]. তাফসীরে ইবন কাছীর : ১/৪৭৪।

[4]. তাফসীরে কুরতুবী : ৩/৬৭-৬৯।

[5]. বুখারী : ২৪৭৫; মুসলিম : ৫৫৩।

[6]. আল-মুস্তাদরাক আলাস-সাহীহাইন : ৫৫; বাইহাকী, শু‘আবুল ঈমান : ৪৯৬৪।

শুধু তোমাকে বলছি… (আর কাউকে বোলো না, প্লীজ!)

$
0
0

sealed letterরচনাঃ নায়লা নুজহাত

ঘটনা ১

"আপা, নামেন।"
চমকে রিকশাওয়ালার দিকে তাকালো মিলা। চলে এসেছে? এতো তাড়াতাড়ি? হবেও বা। বাসা থেকে বেরিয়েছে কেমন একটা ঘোরের মাঝে, রিকশাও ঠিক করেছে কিছু না বুঝেই।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পুরনো রঙ উঠে যাওয়া লোহার গেট ঠেলে বাসার উঠোনে এসে দাঁড়ালো মিলা। রোজিনা খালা কি আছেন বাসায়? একটা ফোন করে আসতেও মনে নেই। বহুদিন ধরে স্বামীর সাথে সমস্যা চলছে, কাউকে বলেনি, নিজের মাকেও না। কেই বা বুঝবে তাকে? আজ যখন অসহ্য হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে, তখন এই সহজ সরল মহিলার কথাই মনে এসেছে।

"এসো মা, এসো। তোমার চেহারা অমন হয়ে আছে কেন?"

"খালা, আমি কি আপনাকে কিছু কথা বলতে পারি? কিন্তু কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলবেন না, প্লীজ?"

চোখের পানি আর বাঁধ মানেনি। খালাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল মিলা। বলে ফেলল সব কথা। অনেকক্ষণ ধরে বুঝালেন মহিলা মিলাকে। বহুদিন পর যেন কেউ মিলাকে ভালবাসল

কবে এই মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছিলো যেন? মিলার মনে নেই। তার বাবা মায়ের পরিচিত, খুব ঘনিষ্ঠ। বিশ্বস্ত। তাই তো উনার কাছেই ও ছুটে এসেছে। ছোট্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিলা।

হাল্কা মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিল সেদিন মিলা। রোজিনা খালার দেয়া উপদেশগুলোও ভুলেনি। সত্যি বলতে তার সংসারটাও টিকে গিয়েছে।

একদিন সে আর তার স্বামী রাত করে বাসায় ফিরছিল। পথে স্বামীর এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধুটি খুব অবাক চোখে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কুশল পর্বের আগেই বলে বসলো, "যাক বাবা, তোরা একত্রে আছিস তাহলে এখনো?" অবাক হয়ে মিলার স্বামী প্রশ্ন করলেন "মানে?"

"না মানে ইয়ে ওই রোজিনা অ্যান্টি আছেন না? আরে ওই যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন? তিনি বলছিলেন যে মিলার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে।"

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মিলা। শুনতে পায় না স্বামী প্রশ্ন করছেন রোজিনা অ্যান্টি ব্যাপারটা কিভাবে জানলো। শুনতে পায়না স্বামীর বন্ধু সেই মহিলার থেকে শোনা পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করছেন।

এক মূক অভিমানে স্তব্ধ হয়ে থাকে সাংসারিক বুদ্ধিতে কাঁচা মিলা। অতি বোকা মিলা।

ঘটনা ২

মেয়েটি কাঁদছিল। পাশে এসে বসলো তার বান্ধবী সোহানা।

"এই লাবনী, এই। কাঁদছিস কেন?"

আচ্ছা মেয়ে তো! কাঁদছে, অথচ বলবে না কী হয়েছে! "চল আমার বাসায় যাবি। অ্যান্টিকে কল করে বলে দে। বিকেলে পৌঁছে দিয়ে আসবো চল! একসাথে দুপুরে খাব, গল্প করব, দেখবি মন ভাল হয়ে গিয়েছে।"

সোহানাদের বাড়িটা খুব সুন্দর। ওর মা খুব আদর করেন লাবনীকে। সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচয়, কত এসেছে! দুপুরে খাওয়ার পর একথা সেকথা বলতে বলতে একসময় বলেই ফেলল লাবনী তার সমস্যার কথা। একজনকে ভালবাসে। তার সাথে বাবা মা বিয়ে দিবেন না। সোহানার জন্য এসব কোনও ব্যাপার না-- ও কোনদিনও সিরিয়াস না এসব নিয়ে। আর কি অদ্ভুত মেয়েটা, হাসি ঠাট্টা করে লাবনীরও মনের দুঃখ কখন কাটিয়ে দিল লাবনী টেরও পায়নি।

বাসায় ফেরার সময় সোহানার হাত ধরে বলল, "কাউকে বলিস না রে। আমাদের ফ্রেন্ডদেরও না"

............................................

আজ লাবনীর বিয়ে। না, বাবা মা কে কষ্ট দিতে পারেনি সে। চুপচাপ বসেছিল। বান্ধবীরাও এসেছে সবাই। তাদের হৈ চৈ ওর কানে যেন প্রবেশ করতে পারছে না। এমন সময় কে যেন ওর হাত চেপে ধরল। চমকে তাকিয়ে দেখে রিতার আম্মা। রিতাও সোহানির মতই ওর বাল্য বান্ধবী। মহিলা ফিস ফিস করে বললেন, "মা, এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত বুঝে শুনে নিয়েছ তো?"

অ্যান্টি ভুল কিছুই বলেননি। তবু লাবনীর মনেহল কে যেন তার অন্তরে ছুরি চালিয়ে দিল। সোহানা? হ্যাঁ, সোহানাই। তাকে ছাড়া তো আর কাউকে বলেনি সে?

"এই কি করছিস সব মেক আপ নষ্ট হয়ে যাবে যে!" আরেকবার চমকে ওঠে লাবনী। এবার তার প্রানপ্রিয় বান্ধবী সোহানার স্পষ্ট কথায়। তাই তো, সে নিজেই বুঝতে পারেনি এতক্ষন ধরে যে সে কাঁদছে!

বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদছে!

ঘটনা ৩

অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়ে মাত্র রুমা ল্যাপটপটা অন করে বসেছে। এমন সময় ফোন। "আপা, আমি ঊর্মি।" কে? ও আচ্ছা, ওই যে সেদিন রুমাদের অফিসে এসেছিলো, তার এক জুনিয়রের বউ।

"আপা শুনছেন? আমি একটু বিপদে পড়েছি, আপনাকে সেদিন দেখেই বড় ভাল লেগেছিল, বড় আপন মনে হয়েছিল, তাই আপনাকেই বলছি। কাউকে বলবেন না প্লীজ। আপা জানেন, আমার স্বামী..."

মেয়েটির সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে একটু চা করতে রান্না ঘরে গেল রুমা। মাথাটা ধরে গিয়েছে। না, মেয়েটার কথায় না। এমন করে মনের কথা অনেকেই বলে থাকে তাকে। কেন টা সে নিজেও জানেনা। মাথা ধরেছে একথা ভেবে যে আজকাল মেয়েগুলো এত বোকা হয় কেন? চিনে না, জানে না এমন মানুষকেও আপন ভেবে মনের কথা সব বলে দেয়। রুমা জানে রুমা আর কাউকে বলবে না। কিন্তু তার জায়গায় অন্য কেউ হলে?

চা খেতে খেতে আবার একই প্রশ্ন করলো নিজেকে রুমা। মেয়েগুলো এত বোকা কেন?

----------------------------------------------------------------------------------------------------------

উপরের ঘটনা গুলো গল্পাকারে লিখলেও এসবই বাস্তব ঘটনা, বিভিন্ন সময়ে এমনটা হয়ে থাকে, হতে দেখেছি অথবা এমনটা হওয়ার দরুন কাউকে কষ্ট পেতে দেখেছি। সাধারণত যারা নিজেরা ভালো, তারাই এসমস্ত কষ্ট গুলো পায়। কারণ তারা নিজেরাও অপরের মাঝে ভালটাই দেখতে পায়। তারা জানে বিশ্বাস মানুষই মানুষকে করে, আর মানুষই মানুষের বিশ্বাস রাখে। তারা জানে কেউ কাউকে কথা দিলে সে কথা ভাঙ্গা যায়না। নিজেরা প্রাণ দিয়ে হলেও নিজেদের দেয়া কথা রাখে বলেই অন্যের দেয়া কথাকেও প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে। এমন ভালো মানুষ হয়ে জন্মানোটা বর্তমান জগতে আসলে ভালোত্ব না, রীতিমত পাপ। আর হ্যাঁ, সেই পাপের মাসুল তাদের দিতে হয় নিজেদের অন্তরের রক্তক্ষরন দিয়ে।

আমার সেই সব পাপী বোনদের বলছি। যারা মানুষকে বিশ্বাস করে কিছু বলার মত পাপটা করেছ অথবা করতে চলেছ। একটা কথা কি জানো আপু, সব মানুষই মানুষ। মানবিক দুর্বলতা সবারই থাকে। এই যে গল্পে যাদের কথা লিখেছি, এরাও কিন্তু কেউই পুরোপুরি খারাপ না। কিন্তু তাদের এমন কিছু দুর্বলতা আছে যা অপরের জন্য ক্ষতিকর। হয়ত তারা নিজেরাও তা জানেনা। তাই আমি বলি কি, এই পৃথিবীতে মানুষকে ভালবাসবে। তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখবে। বিশ্বাসও করবে। শুধু নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বাস করে বসবে না। কারণ হয়ত কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে তারা ভুলে যাবে তোমাকে দেয়া কথা। ভুলে যাবে কথাটি ছড়ালে তোমার ক্ষতি হতে পারে। হয়ত সবাই তারা খুব ভালো। তবু শয়তান হয়ত তাদেরকে ভুলিয়ে দিবে। তুমি তো জানো, বোন, যে শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু, জানো না? একজন মানুষ যত ভালই হোক, মনে রাখবে যে সে তারপরও একজন মানুষই। মানুষটা খুব ধার্মিক হতে পারে, খুব পরিচিত বান্ধবী হতে পারে--- তবুও সেও মানুষ। তাই এমন কথা কাউকে বলবে না যা কোনও কারণে পাঁচ কান হলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আর যদি খুব বলতে ইচ্ছা করে, নিজের মা কে বলবে, বোন কে বলবে। তাঁরা যদি বকেনও, তবু তাঁদের কাছেই তুমি সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁরা যে তোমাকে "তুমি" হিসেবে দেখেন না। তাঁরা তোমাকে দেখেন তাঁদেরই এক অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে!

আর হ্যাঁ। সবচেয়ে মজার কথাটা তো বলিইনি। তুমি কি জান, এমন একজন বন্ধু আছেন যাকে কিছু বলতে তোমার তাঁকে খুঁজতে হবে না, তুমি বললেই তিনি শুনবেন? তুমি কি জানো, তোমার বলতেও হবে না, তোমার চোখের প্রতিটা পানির হিসেব তিনি নিজেই রাখেন? তুমি কি জানো, এমন একজন আছেন যিনি তোমার দোষ অপরকে বলে বেড়াবেন না? তিনি যে তোমার প্রতিটা কথা শোনার জন্য সদা প্রস্তুত, তা কি তুমি জানো?

এত বিশ্বস্ত, এত আপন, এত কাছের তোমার সেই রব কে ফেলে আর কার কাছে যাবে তুমি ভালবাসা খুঁজতে, খুঁজতে আশ্রয়? আর কেনই বা যাবে বোন?

বোনেরা আমার, আমাদের জন্য আমাদের রব আছেন। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা যেন তাঁর কাছেই আমাদের অন্তরের প্রশান্তি খুঁজি। তাঁর সৃষ্টির কাছে না, যারা নিজেরাই তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থী। নিজেদের ভুলে নিজেদের যেন আমরা অসম্মান করে না বসি। আমাদের সম্মানটা যে আমাদের কাছে আমাদের জীবনের চেয়েও দামী!

আমীন!


একজন সফল অভিভাবকের গুণাবলি

$
0
0

 

লেখকঃ মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

পরিবারের নেতৃত্ব দেন একজন পুরুষ। আল কুরআন পুরুষের ঘাড়েই গুরুত্বপূর্ণ নেতৃত্বের দায়িত্বভার অর্পণ করেছে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পুরুষের নেতৃত্ব আদিকাল থেকে চলে-আসা একটি কালচার, যা প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে থাকে। পুরুষের মনোগঠন, সপ্রতিভ আচরণ, দৃঢ়চিত্ততা, সাহসিকতা, প্রতিকূল পরিবেশে – আবেগ নয়- বরং বুদ্ধিচালিত হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যোগ্যতা, অধিকন্তু শীত-বর্ষা-হেমন্ত-বসন্ত রোদ-বৃষ্টি, আলো-অন্ধকার সকল পরিস্থিতিতে দেহ সঞ্চালিত করে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করার শারীরিক ক্ষমতা পুরুষকে সমাসীন করেছে নেতৃত্বের আসনে। তাই পুরুষকেই পালন করতে হবে একটি পরিবারের মূল গার্ডিয়ানের ভূমিকা।

বর্তমান বিশ্বে হাতে-গোণা কয়েকটি দেশ ব্যতীত, সকল দেশেই নারীসমাজ ভোগ করছে, অধিকার ও দায়িত্বের ক্ষেত্রে, পুরুষের মতোই সমান সুযোগ-সুবিধা। তবু সাধারণ ব্যাকরণ ও তিক্ত-সত্য হল, সকল সমাজেই, এখনো, পুরুষরা পালন করে যাচ্ছে নেতৃত্ব প্রদানের মূল ভূমিকা। প্রত্যন্ত গ্রামের মাতব্বর-প্রধানদের থেকে শুরু করে প্রশাসনের বিস্তীর্ণ ময়দানে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণদের অধিকাংশই পুরুষ। পৃথিবীর যেকোনো দেশে মন্ত্রীপরিষদ অথবা পার্লামেন্ট মেম্বারদের অধিকাংশই পুরুষ। পুরুষের জেনেটিক অবগঠন নেতৃত্বানুকুল। সে হিসেবে বর্তমান নারীবাদীদের কেউ কেউ মাতৃগর্ভে থাকাকালীন নারী-এব্রয়ও-তে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাধন করে পুরুষের সাথে সমতা আনার দাবি উত্থাপন করেছেন, সেটা যদি করাও হয় তাহলেও তা হবে ঐশী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ, প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে বিপরীতে অবস্থান যা কখনো মানবতার জন্য কল্যাণকর হবে না, হওয়ার প্রশ্নই আসে না। এর বড় প্রমাণ মানুষ প্রকৃতিগত বিধানের বিরুদ্ধে যেখানে যা করেছে তার সবগুলোই মানবতা, প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য অকল্যাণকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।

এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা অন্য কোনো সুযোগে করা যাবে। এখানে যা বলতে চাচ্ছি তা হল, একটি পরিবারের মূল গার্ডিয়ানশিপ পুরুষের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। আর সে ক্ষেত্রে পুরুষকে অর্জন করতে হবে বেশ কিছু যোগ্যতা, যা সুচারুরূপে তার দায়িত্ব পালনে সহায়তা দেবে।
নবী-রাসূলগণ ছিলেন ইনসানে কামেল, মানবিক গুণাবলির পূর্ণাঙ্গতম প্রতিফলন যাদের জীবনে ঘটেছে। নবী-রাসূলগণ আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি দিকনির্দেশনাপ্রাপ্ত, তাই তারা ছিলেন নির্ভুল, আদর্শিক উচ্চতার শীর্ষচূড়ায় অধিষ্ঠিত। সাধারণ মানুষের পক্ষে নবী-রাসূলগণের মতো ইনসানে কামেল হওয়া দু:সাধ্য হলেও আমল-আখলাক-চরিত্র-আদর্শ ইত্যাদির ক্ষেত্রে নবীদের উসওয়া বা আদর্শ সামনে রেখে নিজের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজিয়ে নেয়া সম্ভব। অন্যথায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আমাদের জন্য উসওয়া বা আদর্শ হিসেবে পেশ করা হত না।

ইরশাদ হয়েছে:

অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে 

[ সূরা আল আহযাব:২১ ]

সে হিসেবে একজন মানুষ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সকল আদর্শ আপন করে নিয়ে তার প্রয়োগ ঘটাতে চেষ্টা-সাধনা করে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ সামনে রেখে নিজেকে সবসময় বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখবে কোন দিকটায় ত্রুটি রয়েছে, কোন দিনটা আরো উন্নত, সুস্মিত করতে হবে। জীবনপর্যায়ের কতটুকু অংশে উসওয়ায়ে রাসূল স্থান করে নিতে পেরেছে। উসওয়ায়ে রাসূলের চাঁচে ফেলে নিজেকে উন্নত করার, পরিমার্জিত করার এক নিরবচ্ছিন্ন মেহনতে-শ্রমে নিজেকে নিক্ষেপ করতে হবে।

উসওয়ায়ে রাসূলের যথার্থ অনুসরণ একজন মানুষকে যোগ্য গার্ডিয়ান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে, পরিবারের দেখভাল, সন্তান লালনের দায়িত্ব যথার্থরূপে পালনের জন্য চারিত্রিক ও আদর্শিক যোগ্যতা দান করবে।

এটা হল একটা জেনারেল কথা যা কেবল গার্ডিয়ানশিপ নয় বরং জীবনের সকল ক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক বলে মনি করি। আর আমরা যেহেতু গার্ডিয়ানশিপ নিয়ে আলোচনায় বসেছি তাই এ ক্ষেত্রে নবীর উসওয়া-আদর্শ কী তা জ্বলজ্বলে করে বলা আবশ্যক বলে মনে করি।
এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে একজন সফল গার্ডিয়ানকে নিম্নবর্ণিত গুণসমূহ অর্জন করে সফল গার্ডিয়ানশিপ নিশ্চিত করতে হবে।

এক. আদর্শের অনুবর্তিতা

একজন গার্ডিয়ান তার পরিবার ও ছেলেমেয়ের তালিম-তরবিয়ত ও আখলাক চরিত্রের প্রহরী। আর যিনি প্রহরী তিনি নিজেই যদি আদর্শচ্যুত হন তবে অন্যদেরকে শেখাবেন কী। আপনি যদি নিজে সিগারেট পান করায় অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, আর পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে উপদেশ দেন, তোমরা সিগারেট পান করো না; কেননা তা ক্ষতিকর, তাহলে আপনার উপদেশ ধূম্রের মতো বাতাসে উড়ে যাবে। যাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন তাদের মাঝে কোনো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে না। সে হিসেবে একজন গার্ডিয়ানের জন্য আদর্শের অনুবর্তিতা একটি অপরিহার্য গুণ, যার অনুপস্থিতি গার্ডিয়ানশিপের গোটা প্রক্রিয়াকে ভণ্ডুল করে দেবে, দেওয়া স্বাভাবিক।

দুই. সহিষ্ণুতা ও ধীরস্থিরতা

গার্ডিয়ানকে বিবেচক হতে হবে। আবেগের মাথায় হুট্ করে একটা কিছু করে ফেললেই হবে না। সে হিসেবে তাকে যথেষ্ট পরিমাণ সহিষ্ণু হতে হবে। ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। সহিষ্ণুতা ও ধীরস্থিরতা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় গুণ, হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জনৈক সাহাবিকে বলেছেন :

তোমার মধ্যে এ দুটি গুণ রয়েছে যা আল্লাহর কাছে পছন্দনীয়, সহিষ্ণুতা, ও ধীরস্থিরতা। 

[ মুসলিম: হাদিস নং ১৭]

সহিষ্ণুতা ও ধীরস্থিরতা দাবি হল, আপনি যখন আপনার ছেলেমেয়েকে কোনো অন্যায় করতে দেখবেন, তখন রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সাথে সাথে মারধর করতে যাবেন না, এ ক্ষেত্রে আপনাকে বরং নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। শুরুতে আপনি তাকে জিজ্ঞাসা করবেন কেন এমনটি করল, তারপর তাকে এ ব্যাপারে যা সঠিক তা বাতলে দেবেন। সে যে অন্যায় করেছে তা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝাবেন। সাথে সাথে তাকে একটু আদরও করে দেবেন। হতে পারে সে সংশোধিত হয়ে যাবে। রাফে ইবনে আমর আল-গিফারি হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেনঃ

বাল্যকালে আমি আনসারদের খেজুর গাছে ঢিল ছুড়তাম, অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে বলা হল, একটি বালক আমাদের খেজুর গাছে ঢিল ছুড়ছে’। এরপর আমাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন: হে বালক খেজুর গাছে তোমার ঢিল ছোড়ার কারণ কী? আমি বললাম: (খেজুর) খাই। তিনি বললেন : খেজুর গাছে ঢিল মেরো না। গাছের নিচে যা এমনিতেই পড়ে তা খাও। অতঃপর তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং বললেন, হে আল্লাহ! আপনি এর উদর পরিতৃপ্ত করুন। [ইমাম তিরমিযি হাদিসটি বিশুদ্ধ বলেছেন]

সহিষ্ণুতা ও ধীরস্থিরতার আরেকটি দাবি হল বাচ্ছাদেরকে প্রহার না করা। আমরা অনেকেই মনে করি যে মারধর না করলে ছেলেসন্তান মানুষ করা যাবে না। এ কথা ভুল। বরং হেকমত ও দূরদর্শিতার মাধ্যমে বাচ্চাদের ভুলত্রুটি শুদ্ধ করা জরুরি। আবু উমামা (রাযি:) হতে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, তিনি বলেন:

 নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি বালক নিয়ে এলেন, তাদের একজনকে আলী (রাযি:) কে দিয়ে দিলেন এবং বললেন, একে মেরো না, কেননা নামাজ আদায়কারীকে মারার ব্যাপারে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে। [ আলবানি: সহিহু আদাবিল মুফরাদ]

ইসলামে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্য ইসলাহ ও সংশোধন, প্রতিশোধ ও মনের ঝাল মেটানো নয়। এ কারণে শিশুকে শাস্তি দেয়ার পূর্বে তার মেজাজ-প্রকৃতি বুঝতে হবে। ভুল সম্পর্কে শিশুকে বারবার বলে বুঝাতে হবে। ইবনে খালদুন রা. বলেন, ‘ যে ব্যক্তি শিক্ষার্থী ও খাদেমদেরকে মারধর ও মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে শিক্ষা দিতে যাবে, এমতাবস্থায় এ বলপ্রয়োগই অধিপতি হয়ে বসবে, বলপ্রয়োগকৃত ব্যক্তির হৃদয়ে সংকীর্ণতা আগমন করবে। উদ্যম-উৎসাহ বিদায় নেবে। অলসতা জায়গা করে নেবে। এ কাজ তাকে মিথ্যা ও খারাবির দিকে ধাবিত করবে; সে এরূপ করবে এই ভয়ে যে অন্যথায় দমনপীড়নের খড়্গ তার উপর নেমে আসবে। দমনপীড়ন তাকে ধোঁকা ও ছলচাতুরি শেখাবে। পরবর্তীতে এরূপ করা তার অভ্যাসে পরিণত হবে। মানবতা, যা তাকে শেখানোর উদ্দেশ্য ছিল তা বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়বে।

অভিজ্ঞতার সাক্ষী এই যে মারধর কোনো ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনে না। অধিকাংশ সময় মারধর বরং বিপরীত ফলাফল বয়ে আনে। মারধর শিশুর ইচ্ছা শক্তিকে দুর্বল করে দেয়, চেতনার শাণিতভাব বিলুপ্ত করে দেয়, উদ্যম উৎসাহে ব্যত্যয় ঘটায়। সন্তান যদি তার পাশে এমন ব্যক্তিকে পায় যে সবসময় তাকে হেকমত ও সুন্দর ভাষায় তার দায়দায়িত্ব সম্পর্কে বোঝাবে, কাজ করার প্রতি উৎসাহী করে তুলবে। তা হলে কঠিন শাস্তির কোনো প্রয়োজন হবে মনে হয় না।

হ্যাঁ, মারধর করার একান্তর প্রয়োজন হলে তা হতে হবে হালকাভাবে, অর্থাৎ তা হতে হবে এমনভাবে যে মারের আঘাত গায়ের চামড়া ভেদ করে কখনো যেন মাংস পর্যন্ত গিয়ে না পৌঁছায়। শিশুর বয়স দশ বছরের কম হলে হালকাভাবে একসাথে তিন প্রহারের অধিক করা যাবে না। উমর ইবনে আব্দুল আযীয রা. বিভিন্ন এলাকায় এই বলে চিঠি লিখে পাঠাতেন যে , শিক্ষক যেন একসাথে তিন প্রহারের অধিক না দেয়; কেননা এতটুকু শিশুকে ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। শিশু দশ বছর বয়সে উপনীত হলে তাকে নামাজ পড়তে বাধ্য করার প্রয়োজনে মারধরের অনুমতি রয়েছে, তবে এক্ষেত্রেও শুধু গাত্রের চামড়ার উপর দিয়ে হালকাভাবে বেশির বেশি দশ প্রহার পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এর অধিক নয়। হাদিসে এসেছে:

হদ(শরিয়ত নির্ধারিত শাস্তি) ব্যতীত অন্য কোনো ক্ষেত্র দশপ্রহারের অধিক প্রয়োগ করা হবে না। [বুখারি:৬৩৪২]

হালকাভাবে কেবল গাত্রের চামড়া স্পর্শ করে এমনভাবে প্রহার করতে হবে এই জন্য বললাম যে কুরআনের ব্যাখ্যাকারগণ ব্যভিচারকারীর উপর শাস্তি প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলা যে শব্দটি প্রয়োগ করেছেন তা হল {فاجلدوا } মুফাসসিরগণ বলেছেন যে এর অর্থ এমনভাবে প্রহার করা যা চামড়া অতিক্রম করে না। যদি চামড়া অতিক্রম করে মাংস পর্যন্ত চলে যায় তাহলে সেটা হবে ইসলামের আদর্শবহির্ভূত অযাচিত একটি কর্ম। যেসব ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের উপর হদ প্রয়োগের কথা আছে সেখানেও প্রহার করার মাধ্যম – বেত ইত্যাদি- কর্কশ বা গিটযুক্ত হওয়া নিষেধ। যায়েদ ইবনে আসলাম থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগে এক ব্যক্তি ব্যভিচার করেছে বলে স্বীকার করে নেয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাস্তি প্রয়োগের জন্য একটি বেত আনতে বললেন, অতঃপর একটি ভাঙ্গা বেত আনা হল। তিনি বললেন, এর চেয়ে ভাল। অতঃপর একটি নতুন বেত নিয়ে আসা হল যার গিটগুলো তখনো অকর্তিত। তিনি বললেন, এর চেয়ে নিচে। এরপর একটি বেত নিয়ে আসা হল যার গিটগুলো কর্তিত এবং বেতটিও নরম। অতঃপর তিনি নির্দেশ দিলেন এবং তাকে জিদল (প্রহার) করা হল। [মুয়াত্তায়ে ইমাম মালেক, কিতাবুল হুদুদ:২১৯৯]

 

প্রহারকারীর ক্ষেত্রে উমর (রাযি:) এর নির্দেশ হল হাত এমনভাবে না উঠানো যাতে বগলের নীচ প্রকাশ পেয়ে যায়।[ ইবনে আব্দুল বারর, আত্তামহিদ: খণ্ড :৫, পৃষ্ঠা ৩৩৪]

অর্থাৎ প্রহার যেন শক্ত ও কঠিনভাবে না হয়।

প্রহারকালীন কোনো শিশু যদি আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করে তবে সাথে সাথে প্রহার বন্ধ করে দেয়া জরুরি। হাদিসে এসেছে যে ব্যক্তি তোমাদের কাছে আল্লাহর নামে আশ্রয় প্রার্থনা করল, তাকে আশ্রয় দাও। এবং আল্লাহর নামে যে চাইল তাকে দাও। [ সহিহুল জামে:৬০২১]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো শিশুকে কোনো দিন মারধর করেন নি। বেশির বেশি তিনি হালকাভাবে কান ডলা দিয়ে দিতেন। এমনকী জেহাদের ময়দান ব্যতীত তিনি তার নিজ হাতে কাউকে প্রহার করেন নি। হাদিসে এসেছে, আয়েশা (রাযি:) বলেন:

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার হাত দিয়ে কাউকে কখনো প্রহার করেন নি। না কোনো নারীকে, না খাদেমকে, হ্যাঁ, যদি তিনি আল্লাহর রাস্তায় জেহাদে থাকতেন, (তবে ভিন্ন কথা)। [মুসলিম : ৪২৬৯]

অতএব এ ক্ষেত্রে খোলাসা কথা হল, শিশুকে আদব শেখানো প্রহারের আশ্রয় ব্যতীতই সম্পন্ন হওয়া উচিত। হিকমত-প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, পরিণতি-চিন্তা ইত্যাদি বিবেচনায় রেখে শিশুকে আদব শেখানোর উত্তম পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত। দশ বছরের নিচে যার বয়স এমন শিশুকে প্রহার করার ক্ষেত্রে হালকাভাবে একত্রে তিন প্রহারের ঊর্ধ্বে যাওয়া যাবে না। দশ বছরের ঊর্ধ্বে হলে হালকাভাবে দশ প্রহার পর্যন্ত যাওয়া যাবে, এর বেশি নয়।

তিন. দয়া ও কোমলতা প্রদর্শন এবং হিংস্রতা থেকে দূরে থাকা

আয়েশা (রাযি:) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

 ‘নিশ্চয় আল্লাহ দয়ালু, তিনি কোমলতাকে পছন্দ করেন। তিনি কোমলতার বিপরীতে দেন যা তিনি সহিংসতার বিপরীতে দেন না, কোমলতা ব্যতীত অন্য কিছুর বিপরীতে দেন না। [মুসলিম]

আয়েশা (রাযি:) থেকে আরেকটি হাদিসে এসেছে,

নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ কোমলতাপূর্ণ, তিনি সকল বিষয়ে কোমলতাকে পছন্দ করেন’। [ বুখারি ও মুসলিম]

জারির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাযি:) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,

আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি যে, যাকে কোমলতা থেকে বঞ্চিত করা হল তাকে সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত করা হল’। [মুসলিম]

ইমাম আহমদ আয়েশা (রাযি:) হতে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার তাকে খেতাব করে বলেছেন,

হে আয়েশা! তুমি কোমলতা অবলম্বন করো; কেননা আল্লাহ তাআলা যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান তখন তাদেরকে কোমলতার পথ দেখান, – অন্য এক বর্ণনা মতে- আল্লাহ যখন কোনো পরিবারের কল্যাণ চান, তিনি তাদের মধ্যে কোমলতার প্রবেশ ঘটান’। [আহমদ]

শিশুদের প্রতি কোমলতা প্রদর্শনের একটি অতি উজ্জ্বল উদাহরণ হল, নামাজরত অবস্থায় হাসান ও হুসাইন (রাযি:) এর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র পিঠে আরোহণ করার ঘটনা। আবু হুরায়রা (রাযি:) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন:

আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এশার নামাজ আদয়রত ছিলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়ছিলেন। তিনি যখন সেজদায় যেতেন হাসান ও হুসাইন (রাযি:) তাঁর পিঠে লাফ দিয়ে উঠত। তিনি যখন সেজদা থেকে মাথা উঠাতেন তাদেরকে ধরে হালকাভাবে রাখতেন। তিনি যখন আবার সেজদায় যেতেই তারা পুনরায় ফিরে আসত। অতঃপর তিনি যখন নামাজ শেষ করলেন একজনকে এখানে ও অন্যজনকে ওখানে রাখলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলাম এবং বললাম, য়্যা রাসূলাল্লাহ! আমি কে এদেরকে তাদের মায়ের কাছে নিয়ে যাবো? তিনি বললেন, না। অতঃপর আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। তিনি তাদেরকে বললেন, ‘ তোমরা তোমাদের মায়ের কাছে যাও’। রাসতাসে বিদ্যুতের আলোতে চলতে চলতে বাড়িতে গিয়ে প্রবেশ করল।  [হাকেম:৩/১৬৭]

চার: মমত্বপূর্ণ হৃদয়

একজন গার্ডিয়ানকে হতে হবে মমত্বপূর্ণ হৃদয়ের অধিকারি। নির্দয়, কঠিন হৃদয় ব্যক্তির পক্ষে যথার্থরূপে গার্ডিয়ানশিপের দায়িত্ব পালন সম্ভব হবে না। আবু সুলায়মান মালেক ইবনে হুয়াইরেস বলেন:

আমরা কতিপয় সমবয়সী যুবক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বিশ দিন অবস্থান করলাম। আমাদের প্রতি তিনি ছিলেন কোমল ও দয়াময়। তিনি মনে করলেন যে আমরা আমাদের পরিবার পরিজনের সাথে সাক্ষাতের জন্যে আকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়েছি। তিনি আমাদেরকে আমাদের পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা তাকে এ ব্যাপারে জানালাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে বললেন, ‘ তোমরা তোমাদের পরিবারের কাছে ফিরে যাও, এত সময় এত দিন থাক। যখন নামাজের সময় হবে, তোমাদের একজনে আজান দেবে, ও তোমাদের মধ্যে বয়সে যে বড় সে ইমামতি করবে। [ বুখারি ও মুসলিম]

ইবনে উমর (রাযি:) থেকে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

‘ প্রতিটি বৃক্ষেরই ফল রয়েছে, আর কলিজার ফল হল সন্তান। আল্লাহ তাআলা ওই ব্যক্তিকে রহম করেন না যে ব্যক্তি তার সন্তানের প্রতি করুণা প্রদর্শন করে না। যার হাতে আমার আত্মা তার কসম, দয়ার্দ্র ব্যতীত কেউ জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আমরা বললাম, য়্যা রাসূলাল্লাহ! আমরা সবাই তো দয়াশীল। তিনি বললেন, ‘তোমাদের কারো দয়ার্দ্র হওয়ার অর্থ এ নয় যে সে তার সাথীর প্রতি দয়ার্দ্র হবে। বরং দয়া-করুণা হল মানুষের প্রতি দয়া করা। [বুখারি ও মুসলিম]

পাঁচ: দুটি বিষয়ের মধ্যে যা অধিক সহজ তা বেছে নেওয়া যদি তা পাপপূর্ণ না হয় 

সফল গার্ডিয়ানের গুণাবলির মধ্যে একটি হল, দুটি বিষয়ের মধ্যে সহজতর বিষয়টি বেছে নেওয়ার যোগ্যতা, যদি তাতে গুনাহ না থাকে। আয়েশা (রাযি:) হতে এক বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে যখনই দুটি বিষয়ের মধ্যে একটি বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হত, তখনই তিনি সহজটি বেছে নিতেন তা যদি পাপপূর্ণ না হত। আর তিনি কখনোই নিজের জন্য কোনো বিষয়ে প্রতিশোধ নিতেন না। তবে হ্যাঁ, আল্লাহর হুরমত লঙ্ঘিত হলে তিনি আল্লাহর জন্য প্রতিশোধ নিতেন। [ বুখারি ও মুসলিম]

ছয়: রাগ-রোষ বর্জন করা

একজন সফল গার্ডিয়ানের অন্যতম একটি গুণ হল রাগ-রোষ থেকে দূরে থেকে ঠাণ্ডা মাথায় কার্যবিধি নির্ধারণ করা; কেননা রাগ, উন্মত্ততা, একঘেয়েমি আদব শেখানোর ক্ষেত্রে একটি নেতিবাচক গুণ। সামাজিকভাবেও তা অনাকাঙ্খিত একটি অভ্যাস। মানুষ যদি তার রাগ-রোষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, হজম করতে পারে তবে তা নিজের জন্য ও সন্তানদের জন্য বয়ে আনবে কল্যাণ। এর উল্টো হলে ফলাফলও হবে বিপরীত।

জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিজের জন্য বিশেষ উপদেশ চাইলে তিনি তাকে রাগ না করার উপদেশ দেন। [ দ্রঃ: সিলসিলাতুল আহাদিস আস সাহিহা:৯৩৮]

শুধু তাই নয়, বরং রাগ সংবরণকে তিনি আসল বীরত্ব বলে আখ্যায়িত করেন। আবু হুরায়রা (রাযি:) হতে এক বর্ণনায় এসেছে, নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

বীর-বাহাদুর সে নয় যে কুস্তিতে অন্যকে পরাহত করতে পারে। বরং বীর-বাহাদুর সে যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে’। [বুখারি ও মুসলিম]

সাত : মধ্যমপন্থা অবলম্বন

কট্টরপন্থা সকল ক্ষেত্রে নিন্দনীয় একটি গুণ। এ-কারণেই আমরা দেখতে পাই যে ইসলামের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজের ক্ষেত্রেও তিনি মধ্যমপন্থা অবলম্বনকে পছন্দ করেছেন। আবু মাসুদ উকবা ইবনে উমর আল-বাদরি বর্ণনা করে বলেন যে,

 রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এক ব্যক্তি এসে বলল যে আমি অমুকের কারণে ফজরের নামাজে আসি না। সে আমাদেরকে নিয়ে দীর্ঘ করে নামাজ পড়ে। কথা শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বক্তৃতা দানকালে এত বেশি রাগ করলেন ইতঃপূর্বে যা অন্য কোনো বক্তৃতায় করেন নি। অতঃপর তিনি বললেন: ‘হে লোকসকল! নিশ্চয় তোমাদের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা বিতাড়ক, তাই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি ইমামতি করবে সে যেন সংক্ষেপ করে; কেননা তার পেছনে বৃদ্ধ, শিশু ও প্রয়োজনগ্রস্থ লোক রয়েছে’। [বুখারি ও মুসলিম]

মধ্যমপন্থী বিষয় উত্তম বিষয় বলে একটি কথা আছে। কাজেই একজন গার্ডিয়ানকে তার পোষ্যের লালন-পালনের ক্ষেত্রে মধ্যমপন্থা অবলম্বন অবশ্যই জরুরি।
উপরে বর্ণিত গুণগুলো পূর্ণাঙ্গরূপে কারও মধ্যে পাওয়া গেলেই কেবল গার্ডিয়ানশিপের ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের আশা করা যেতে পারে। আল্লাহ আমাদের সহায় হউন।

সমাপ্ত

অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?

$
0
0

মূল লেখক : শায়েখ আব্দুল ‘আযীয্‌ ইবনু বাজ (রঃ) | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : 'আব্‌দ আল-আহাদ

প্রকাশনায় : কুরআনের আলো ওয়েবসাইট

Image Courtesy: IERA Facebook Page

Image Courtesy: IERA Facebook Page

প্রশ্ন : একজন অমুসলিম কোনো মুসলিম দেশে প্রবাসী যিম্মি (মুসলিম শাসনে বসবাসকারী অমুসলিম) হিসেবে বসবাস করতে পারে। আবার একজন মুসলিম কোনো অমুসলিম দেশে প্রবাসী হিসেবেও বসবাস করতে পারে। পরিস্থিতি দুটোর যা-ই হোক না কেন, একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের কী ধরণের আচরণ করা উচিত? অমুসলিমদের সম্ভাষণ জানানো থেকে শুরু করে তাদের বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠান পালন করা সহ, তাদের সাথে মসুলিমদের চালচলন কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে আমি একটা সচ্ছ ধারণা পেতে চাই। শুধু কর্মক্ষেত্রে কোনো অমুসলিমকে কি বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি আছে? দয়া করে জানাবেন।

 

উত্তর : প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্‌র জন্য। অমুসলিমদের প্রতি মুসলিমদের কর্তব্যের মধ্যে অনেকগুলো বিষয় অন্তর্ভুক্ত।

প্রথমত :

একজন অমুসলিমের প্রতি একজন মুসলিমের প্রথম কর্তব্য হলো, তাকে আল্লাহ্‌র দ্বীন, ইসলামের দা‘ওয়াত দিতে হবে। ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়ার পাশাপাশি যতদূর সম্ভব, জ্ঞান নিজের বিশুদ্ধ অনুযায়ী বাস্তবিক অর্থে ইসলাম কী, সে ব্যাপারে অমুসলিম ব্যক্তিকে বুঝাতে হবে। কারণ অন্যান্য মুসলিমদের পাশাপাশি কোনো ইহুদী, খ্রিস্টান কিংবা মুশরিকের প্রতি একজন মুসলিমের সর্বোচ্চ পরিমাণ অনুগ্রহ দেখানো উপায় হলো, তাদেরকে আল্লাহ্‌র দ্বীনের দা‘ওয়াত দেওয়া। নবী (সা) বলেছেন :

“যে ব্যাক্তি অন্যদেরকে কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সে ‘আমলকারীর সমপরিমান সওয়াব পাবে” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৮৯৩]

‘আলীকে (রা) খায়বারে প্রেরণের সময় রাসূল (সা) নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তিনি যেন ইহুদীদেরকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেন। রাসূল (সা) বলেছিলেন :

“আল্লাহ্‌র কসম! আল্লাহ্‌ যদি তোমার মাধ্যমে একজন মাত্র ব্যক্তিকে হিদায়াত দান করেন, তাহলে তোমার জন্য তা হবে লাল উট (সেরা প্রজাতির উট) থাকার চেয়েও অধিক উত্তম।”

তিনি (সা) আরও বলেছিলেন :

“যে ব্যক্তি অন্যদেরকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করে, সে তাদের সমপরিমান সওয়াব লাভ করবে, যারা সে পথের অনুসরণ করবে। অথচ তাদের কারও সওয়াব থেকে বিন্দুমাত্র কম করা হবে না।” [সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৪৮৩২]

কাজেই, আন্তরিকতার সাথে একজন অমুসলিমকে ইসলামের দা‘ওয়াত দেওয়া এবং তার কাছে ইসলামের বাণী পৌঁছে দেওয়া আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়।

দ্বিতীয়ত :

কোনো মুসলিম শারীরিক, আর্থিক কিংবা সম্মান-মর্যাদার দিক থেকে অমুসলিম ব্যাক্তির প্রতি কোনোরূপ অন্যায় করতে পারবে না। অমুসলিম ব্যক্তি যদি যিম্মি (মুসলিম শাসনাধীনে বসবাসকারী), মুস্তা’মান (মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় নিরাপত্তাপ্রাপ্ত) কিংবা মু‘আহিদ (যার দেশের সাথে মুসলিমদের শান্তিচুক্তিতে আবন্ধ) হয়, তাহলে তাকে তার প্রাপ্য অধিকার দিতে হবে এবং  চুরি, বিশ্বাসঘাতকতা বা প্রতারণার মাধ্যমে তার ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি করা যাবে না। তাকে হত্যা করা যাবে না এবং আঘাত করে শারীরিকভাবে কষ্ট দেওয়া যাবে না। কারণ সে মু‘আহিদ, যিম্মি কিংবা মুস্তা’মান হওয়ায় ইসলামী শারী‘আহ্‌ কর্তৃক তার নিরাপত্তা সুরক্ষিত।

তৃতীয়ত :

এমন কোনো কারণ নেই যার ফলে আমরা অমুসলিম সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য, তাদের কাছে জিনিসপত্র ভাড়া দেওয়া বা তাদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া ইত্যাদি কাজগুলো করতে পারবো না। সহীহ হাদীসের বর্ণনা অনুযায়ী, আল্লাহ্‌র রাসূল (সা) কাফের এবং মুশরিকদের থেকে জিনিসপত্র কিনেছেন। আর তাদের থেকে জিনিসপত্র কেনা মূলত তাদের সাথে সম্পর্ক রাখা। তাঁর (সা) মৃত্যুর সময়েও তাঁর একটি বর্ম একজন ইহুদীর কাছে বন্ধক ছিল। ইহুদীর কাছে একসময় বর্মটি বন্ধক রেখে রাসূল (সা) তাঁর পরিবারের জন্য খাবার কিনেছিলেন।

চতুর্থত :

অমুসলিমদেরকে প্রথমে সম্ভাষণ জানানো মুসলিম ব্যক্তির উচিত নয়। নবী (সা) বলেছেন,

“ইহুদী কিংবা খ্রিস্টানদের প্রথমে তোমরা সালাম জানাবে না।” [সহীহ মুসলিম, সালাম অধ্যায়, হাদীস নং ২১৬৭]

তিনি (সা) আরও বলেছেন,

“যদি আহলে কিতাবদের কেউ সালামের (আস্‌সালামু ‘আলাইকুম) মাধ্যমে তোমাদের অভিবাদন জানায়, তাহলে বোলো, ‘ওয়া ‘আলাইকুম।’” [আল-বুখারি, হাদীস নং ৫৯০১; মুসলিম, হাদীস নং ২১৬৫]

অতএব, নিজে থেকে প্রথমেই কোনো কাফিরকে সালাম জানানো মুসলিমের উচিত নয়। তবে কোন কাফের, ইহুদী বা খ্রিস্টান যদি কোনো মুসলিমকে সালাম জানায়, তাহলে রাসূলের (সা) নির্দেশ অনুযায়ী, “ওয়া ‘আলাইকুম” বলে উত্তর দিতে হবে।

ভালো প্রতিবেশী হওয়া মুসলিমদের উপর অমুসলিমদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার। কাজেই কোনো অমুসলিম  আপনার প্রতিবেশী হলে তার প্রতি সদয় হউন। তাকে কোনোভাবে হয়রানি করবেন না। অসচ্ছল হলে তাকে সাহায্য করুন। উপহার দিয়ে, সুপরামর্শ দিয়ে তাকে সহায়তা করুন। এতে করে সে ইসলামের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হবে এবং মুসলমান হওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। অধিকিন্তু, প্রতিবেশী হিসেবে আপনার উপর তার অধিকার রয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন,

“জিব্‌রীল (আ) প্রতিবেশীর প্রতি সদয় হওয়ার জন্য আমাকে এতটাই তাগিদ দিতে থাকলেন যে, আমি ভাবলাম, তিনি হয়তো প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে ফেলবেন।” [আল-বুখারি ও মুসলিম]

প্রতিবেশী কাফির হলেও প্রতিবেশী হিসেবে তার অধিকার রয়েছে। প্রতিবেশী যদি কাফির হওয়ার পাশাপাশি আত্মীয়ও হয়, তাহলে তার অধিকার দ্বিগুন: প্রতিবেশী হিসেবে এবং আত্মীয় হিসেবে।

প্রতিবেশী দরিদ্র হলে তাকে যাকাত না দিয়ে আর্থিকভাবে সাহায্য করুন। কারণ প্রতিবেশী হিসেবে এই সাহায্য পাওয়ার অধিকার তার আছে। এই সম্পর্কে আল্লাহ্‌ বলেন (অর্থের ব্যাখ্যা),

দ্বীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ হতে বহিষ্কার করেনি, তাদের প্রতি সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। আল্লাহ্‌ তো ন্যায়-পরায়ণদেরকে  ভালোবাসেন।” [সূরা মুমতাহিনাহ্‌, আয়াত-৮]

আস্‌মা বিন্‌তে আবি বাক্‌র (রা) থেকে বর্ণিত একটি বিশুদ্ধ বর্ণনানুযায়ী, মক্কার মুশরিক এবং রাসূলের (সা) মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলাকালীন তার মা — যে তখনও মুশরিকা ছিল — তার সাথে দেখা করে সাহায্য চাইলো। মায়ের সাথে তার সম্পর্কের বন্ধনকে বহাল রাখবে কি না, সে বিষয়ে আস্‌মা রাসূলের (সা) কাছে অনুমতি চাইলেন। উত্তরে রাসূল (সা) বলেছিলেন,

“তার সাথে রক্তের বন্ধনকে বহাল রাখো।”

অমুসলিমদের উৎসব-অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের ক্ষেত্রে বিধান হলো, কোনো মুসলিম সেগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। তবে তাদের কোনো প্রিয়জন মারা গেলে, সমবেদনা জ্ঞাপন করাতে দোষের কিছু নেই। যেমন: ‘আল্লাহ্‌ আপনার ক্ষতিপূরণ করুন’ বা এই জাতীয় সহানুভূতিপূর্ণ কথা বলা যেতে পারে। তবে মৃত ব্যক্তি কাফির হলে “আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করে দিন” বা ‘আল্লাহ্‌ তার উপর দয়া করুন’ ইত্যাদি বলা যাবে না এবং মৃতের জন্য কোনো দো‘আও করা যাবে না। কিন্তু মৃত ব্যক্তির জীবিত আত্মীয়স্বজনদের ক্ষতিপূরণের জন্য এবং তাদের হিদায়াতের জন্য দো‘আ করা যাবে।

ফাতাওয়া নূর ‘আলা আদ্‌-দার্‌ব, ১/২৮৯-২৯১

একজন মুসলিমের প্রাত্যহিক জীবন যেমন হওয়া উচিৎ

$
0
0

colorful_poppy_flowers-wide

লেখকঃ উস্তাদ মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

بسم الله الرحمن الرحيم

আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চলা ও তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে একজন মুসলিমকে যে বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া উচিৎ, তা হল তার প্রাত্যহিক রুটিন৷ একজন মুসলিম কখন ঘুম থেকে উঠবে, রাতে কখন বিছানায় যাবে - এ সকল বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে৷

হাদীসে বর্ণিত:

عَنْ صَخْرٍ الْغَامِدِىِّ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِى فِى بُكُورِهَا ». وَكَانَ إِذَا بَعَثَ سَرِيَّةً أَوْ جَيْشًا بَعَثَهُمْ فِى أَوَّلِ النَّهَارِ. وَكَانَ صَخْرٌ رَجُلاً تَاجِرًا وَكَانَ يَبْعَثُ تِجَارَتَهُ مِنْ أَوَّلِ النَّهَارِ فَأَثْرَى وَكَثُرَ مَالُهُ. قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَهُوَ صَخْرُ بْنُ وَدَاعَةَ

সাখর আল গামিদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন: হে আল্লাহ আপনি দিনের অগ্রভাগে আমার উম্মাতের জন্য বরকত দিন৷ এবং তিনি যখন কোন ছোট বাহিনী কিংবা বড় দলকে অভিযানে পাঠাতেন, তাদের দিনের অগ্রভাগে পাঠাতেন৷ আর সাখর একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি ছিলেন৷ তিনি দিনের প্রথমভাগ থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতেন, ফলে তিনি ধনাঢ্য হয়ে ওঠেন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়৷১

এই হাদীস থেকে জানা যায় যে এই উম্মাতের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে দিনের অগ্রভাগে৷ অতএব ফজরের সালাতের পর না ঘুমিয়ে যিকরে মশগুল থাকা এবং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে এরপর কাজে নেমে পড়া মুসলিমদের জন্য বরকত তথা কল্যাণ বৃদ্ধি ও স্থায়ীত্বের কারণ হবে৷ আর যে ফজরের সালাতের সাথে সাথেই দিনের শুরু করতে চায়, তাকে রাতে আগেভাগেই বিছানায় যেতে হবে৷ এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার সালাতের পর কথাবার্তা বলা পছন্দ করতেন না৷ তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ এশার পরপর রাত্রির অগ্রভাগেই বিছানায় যেতেন, যেন শেষরাত্রিতে জেগে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারেন; অথবা অন্ততপক্ষে যেন ফজরের সালাতের সময় সতেজ দেহমন নিয়ে জেগে উঠতে পারেন৷ হাদীসে বর্ণিত:

وَكَانَ يَسْتَحِبُّ أَنْ يُؤَخِّرَ الْعِشَاءَ... وَكَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَهَا وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَا

আর তিনি [রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এশা বিলম্বিত করাকে পছন্দ করতেন,...আর তিনি এর পূর্বে ঘুমকে এবং এর পরে কথাবার্তাকে অপছন্দ করতেন৷২

আজ বহু মুসলিম পরিবারেই এর বিপরীত অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়৷ অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত রাত্রিজাগরণে অভ্যস্ত। তাদের অনেকেই ফজরের সালাত ঘুমিয়ে পার করে দেন৷ অনেকে রাত জেগে টেলিভিশন দেখে, ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে কিংবা গল্পগুজব করে সময় কাটান, আর এগুলোর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধরনের গুনাহে লিপ্ত হন৷

অনেক ছাত্রদের ধারণা যে রাত জেগে লেখাপড়া করলে ভাল ফল পাওয়া যায়৷ কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত৷ কেউ রাত্রিতে যথেষ্ট ঘুমিয়ে ভোরে উঠে সতেজ দেহ-মন নিয়ে দু-ঘন্টায় যতটুকু পড়া করতে পারবে, তা হয়ত রাত জেগে চার ঘন্টা লেখাপড়ার সমান৷

অনেকে অভিযোগ করেন যে রাত্রি জাগরণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আর এ অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না৷ এই অভ্যাস পরিবর্তনের সহজ উপায় আছে৷ কষ্ট করে কয়েকদিন ফজরের সময় ঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং ফজরের সালাতের পর আর বিছানায় না যাওয়ার অনুশীলন করলে প্রথমে কষ্ট হলেও শীঘ্রই এটা অভ্যাসে পরিণত হবে৷ ফজরের পর ঘুম তাড়িয়ে রাখার জন্য প্রথমদিকে কিছু খেলাধূলা বা শারীরিক পরিশ্রম করা যেতে পারে৷ প্রয়োজনে অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য ছুটির সময়কে বেছে নেয়া যেতে পারে, যেন তা করতে গিয়ে কাজের ক্ষতি না হয়৷ মোটকথা ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব - এটি পরীক্ষিত৷

দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকতে পারে দিনের শেষভাগে খেলাধূলা ও শরীরচর্চা৷ সাহাবীগণ দিনের শেষভাগে, এমনকি মাগরিবের সালাত আদায় করেও তীর-নিক্ষেপ চর্চা করতেন৷ দিনের শেষভাগে কিছুটা শরীরচর্চা, হাঁটা বা খেলাধূলা করা রাত্রিতে ঘুমকে গভীর করতে সহায়ক হবে৷ এছাড়া দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তো আছেই - যার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য-কর্তব্য৷

দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকা দরকার নিয়মিত দ্বীন-শিক্ষা ও কুরআন চর্চা৷ হঠাৎ বেশি পরিমাণে কোন আমল করার চেয়ে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাটা অধিক উপকারী এবং আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়৷ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

« أَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ »

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় সে সমস্ত আমল, যা অল্প হলেও নিয়মিত করা হয়৷৩

তেমনি দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে থাকা উচিৎ নিকটাত্মীয়, বিশেষভাবে মা-বাবার খোঁজখবর নেয়া, তাঁদের প্রয়োজন পূরণ করা৷ এছাড়া স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সময় বরাদ্দ থাকা দরকার৷

এই সমস্ত দিকনির্দেশনা মেনে প্রাত্যহিক রুটিন ঠিক করে নিয়ে তা অনুসরণ করলে একজন মুসলিম সহজেই যাবতীয় পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা তার জন্য সহজতর হবে ইনশা আল্লাহ৷


১ আহমদ ও সুনান গ্রন্থসমূহের প্রণেতাগণ কর্তৃক বর্ণিত৷
২ বুখারী, মুসলিম৷
৩ বুখারী, মুসলিম৷

দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর কর্তব্য

$
0
0

11982_10151631702843033_1921499306_n

 লেখক : সানাউল্লাহ বিন নজির আহমদ | সম্পাদনা : আলী হাসান তৈয়ব

 ১. স্বামীর অসন্তুষ্টি থেকে বিরত থাকা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “তিনজন ব্যক্তির নামাজ তাদের মাথার উপরে উঠে না।

  • (ক) পলাতক গোলামের নামাজ, যতক্ষণ না সে মনিবের নিকট ফিরে আসে।
  • (খ) সে নারীর নামাজ, যে নিজ স্বামীকে রাগান্বিত রেখে রাত যাপন করে।
  • (গ)সে আমিরের নামাজ, যার উপর তার অধীনরা অসন্তুষ্ট।”

২. স্বামীকে কষ্ট দেওয়া থেকে বিরত থাকা।

ইমাম আহমদ ও অন্যান্য মুহাদ্দিস বর্ণনা করেন, “দুনিয়াতে যে নারী তার স্বামীকে কষ্ট দেয়, জান্নাতে তার হুরগণ (স্ত্রীগণ) সে নারীকে লক্ষ্য করে বলে, তাকে কষ্ট দিয়ো না, আল্লাহ তোমার সর্বনাশ করুন। সে তো তোমার কাছে ক’দিনের মেহমান মাত্র, অতি শীঘ্রই তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবে।”

৩. স্বামীর অকৃতজ্ঞ না হওয়া।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তা’আলা সে নারীর দিকে দৃষ্টি দেবেন না, যে নিজ স্বামীর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না, অথচ সে স্বামী ব্যতীত স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়।”  ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “আমি জাহান্নাম কয়েক বার দেখেছি, কিন্তু আজকের ন্যায় ভয়ানক দৃশ্য আর কোন দিন দেখিনি। তার মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশী দেখেছি। তারা বলল, আল্লাহর রাসূল কেন? তিনি বললেন, তাদের না শুকরির কারণে। জিজ্ঞাসা করা হল, তারা কি আল্লাহর না শুকরি করে? বললেন, না, তারা স্বামীর না শুকরি করে, তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে না। তুমি যদি তাদের কারো উপর যুগ-যুগ ধরে ইহসান কর, অতঃপর কোন দিন তোমার কাছে তার বাসনা পূণ না হলে সে বলবে, আজ পর্যন্ত তোমার কাছে কোন কল্যাণই পেলাম না।”

৪. কারণ ছাড়া তালাক তলব না করা।

ইমাম তিরমিজি, আবু দাউদ প্রমুখগণ সওবান রাদিআল্লাহ আনহু থেকে বর্ণনা করেন, “যে নারী কোন কারণ ছাড়া স্বামীর কাছে তালাক তলব করল, তার উপর জান্নাতের ঘ্রাণ পর্যন্ত হারাম।”

৫. অবৈধ ক্ষেত্রে স্বামীর আনুগত্য না করা।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “আল্লাহর অবাধ্যতায় মানুষের আনুগত্য করা যাবে না।”  এখানে নারীদের শয়তানের একটি ধোঁকা থেকে সতর্ক করছি, দোয়া করি আল্লাহ তাদের সুপথ দান করুন। কারণ দেখা যায় স্বামী যখন তাকে কোন জিনিসের হুকুম করে, সে এ হাদিসের দোহাই দিয়ে বলে এটা হারাম, এটা নাজায়েজ, এটা জরুরি নয়। উদ্দেশ্য স্বামীর নির্দেশ উপেক্ষা করা। আমি তাদেরকে আল্লাহর নিম্নোক্ত বাণীটি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, আল্লাহ তা’আলা বলেন, “যারা আল্লাহর উপর মিথ্যা আরোপ করেছে, কিয়ামতের দিন তাদের চেহারা কালো দেখবেন।”  হাসান বসরি রহ. বলেন, “হালাল ও হারামের ব্যাপারে আল্লাহ ও তার রাসূলের উপর মিথ্যা বলা নিরেট কুফরি।”

৬. স্বামীর বর্তমানে তার অনুমতি ব্যতীত রোজা না রাখা।

সহিহ মুসলিমে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, “কোন নারী স্বামীর উপস্থিতিতে তার অনুমতি ব্যতীত রোজা রাখবে না।”  যেহেতু স্ত্রীর রোজার কারণে স্বামী নিজ প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকে, যা কখনো গুনার কারণ হতে পারে। এখানে রোজা দ্বারা স্বাভাবিকভাবেই নফল রোজা উদ্দেশ্য। কারণ ফরজ রোজা আল্লাহর অধিকার, আল্লাহর অধিকার স্বামীর অধিকারের চেয়ে বড়।

৭. স্বামীর ডাকে সাড়া না দেওয়া :

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন পুরুষ যখন তার স্ত্রীকে নিজের বিছানায় ডাকে, আর স্ত্রী তার ডাকে সাড়া না দেয়, এভাবেই স্বামী রাত যাপন করে, সে স্ত্রীর উপর ফেরেশতারা সকাল পর্যন্ত অভিসম্পাত করে।”

৮. স্বামী-স্ত্রীর একান্ত গোপনীয়তা প্রকাশ না করা :

আসমা বিনতে ইয়াজিদ থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, “কিছু  পুরুষ আছে যারা নিজ স্ত্রীর সাথে কৃত আচরণের কথা বলে বেড়ায়, তদ্রুপ কিছু নারীও আছে যারা আপন স্বামীর গোপন ব্যাপারগুলো প্রচার করে বেড়ায়?! এ কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল, কেউ কোন শব্দ করল না। আমি বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! নারী-পুরুষেরা এমন করে থাকে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এমন করো না। এটা তো শয়তানের মতো যে রাস্তার মাঝে নারী শয়তানের সাক্ষাৎ পেল, আর অমনি তাকে জড়িয়ে ধরল, এদিকে লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে!”

৯. স্বামীর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও বিবস্ত্র না হওয়া।

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, যে নারী স্বামীর ঘর ব্যতীত অন্য কোথাও বিবস্ত্র হল, আল্লাহ তার গোপনীয়তা নষ্ট করে দেবেন।”

১০. স্বামীর অনুমতি ব্যতীত কাউকে তার ঘরে ঢুকতে না দেয়া।

বুখারিতে আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “নারী তার স্বামীর উপস্থিতিতে অনুমিত ছাড়া রোজা রাখবে না এবং তার অনুমতি ছাড়া তার ঘরে কাউকে প্রবেশ করতে দেবে না।”

১১. স্বামীর অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া।

আল্লাহ তা’আলা বলেন, “তোমরা ঘরে অবস্থান কর” ইবনে কাসির রহ. এর ব্যাখ্যায় বলেন, “তোমরা ঘরকে আঁকড়িয়ে ধর, কোন প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হয়ো না।”  নারীর জন্য স্বামীর আনুগত্য যেমন ওয়াজিব, তেমন ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য তার অনুমতি ওয়াজিব।

স্বামীর খেদমতের উদাহরণ: মুসলিম বোন! স্বামীর খেদমতের ব্যাপারে একজন সাহাবির স্ত্রীর একটি ঘটনার উল্লেখ যথেষ্ট হবে বলে আমার ধারণা। তারা কীভাবে স্বামীর খেদমত করেছেন, স্বামীর কাজে সহযোগিতার স্বাক্ষর রেখেছেন ইত্যাদি বিষয় বুঝার জন্য দীর্ঘ উপস্থাপনার পরিবর্তে একটি উদাহরণই যথেষ্ট হবে, আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আসমা বিনতে আবু বকর থেকে সহিহ মুসলিমে বর্ণিত, তিনি বলেন, জুবায়ের আমাকে যখন বিয়ে করে, দুনিয়াতে তখন তার ব্যবহারের ঘোড়া ব্যতীত ধন-সম্পদ বলতে আর কিছু ছিল না। তিনি বলেন, আমি তার ঘোড়ার ঘাস সংগ্রহ করতাম, ঘোড়া মাঠে চরাতাম, পানি পান করানোর জন্য খেজুর আঁটি পিষতাম, পানি পান করাতাম, পানির বালতিতে দানা ভিজাতাম। তার সব কাজ আমি নিজেই আঞ্জাম দিতাম। আমি ভাল করে রুটি বানাতে জানতাম না, আনসারদের কিছু মেয়েরা আমাকে এ জন্য সাহায্য করত। তারা আমার প্রকৃত বান্ধবী ছিল। সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দান করা জুবায়েরের জমি থেকে মাথায় করে শস্য আনতাম, যা প্রায় এক মাইল দূরত্বে ছিল।”  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  বলেন, যদি নারীরা পুরুষের অধিকার সম্পর্কে জানত, দুপুর কিংবা রাতের খাবারের সময় হলে, তাদের খানা না দেওয়া পর্যন্ত বিশ্রাম নিত না।”

বিয়ের পর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে উম্মে আকেলার উপদেশ: আদরের মেয়ে, যেখানে তুমি বড় হয়েছ, যারা তোমার আপন জন ছিল, তাদের ছেড়ে একজন অপরিচিত লোকের কাছে যাচ্ছ, যার স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে তুমি কিছু জান না। তুমি যদি তার দাসী হতে পার, সে তোমার দাস হবে। আর এসব  বিষয়ের প্রতি খুব নজর রাখবে।

  • ১- অল্পতে তুষ্টি থাকবে।
  • ২– তার তার অনুসরণ করবে ও তার সাথে বিনয়ী থাকবে।
  • ৩–  তার চোখ ও নাকের আবেদন পূর্ণ করবে।
  • ৪– তার অপছন্দ হালতে থাকবে না, তার অপ্রিয় গন্ধ শরীরে রাখবে না।
  • ৫–  তার ঘুম ও খাবারের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখবে।
  • ৬– মনে রাখবে, ক্ষুধার তাড়নায় গোস্বার উদ্রেক হয়, ঘুমের স্বল্পতার কারণে বিসন্নতার সৃষ্টি হয়।
  • ৭–  তার সম্পদ হেফাজত করবে, তার সন্তান ও বৃদ্ধ আত্মীয়দের সেবা করবে।
  • ৮– মনে রাখবে, সব কিছুর মূল হচ্ছে সম্পদের সঠিক ব্যবহার, সন্তানদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা।

 

পরিবার বিষয়ক প্রবন্ধ –সৌভাগ্যময় ঘর

$
0
0

4cbc5d5286d9b76a3e020000

লেখকঃ ড. সালেহ ইবন আবদিল্লাহ ইবন হুমাইদ | অনুবাদ : মোঃ আমিনুল ইসলাম |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

পর্ব - ১ | পর্ব - ২

بسم الله الرحمن الرحيم

ভূমিকাঃ

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে ইসলামের পথে পরিচালিত করেছেন এবং আমাদেরকে তার অনুসারী বানিয়েছেন; আল্লাহ যদি আমাদেরকে হেদায়াত না করতেন, তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না; আমি আল্লাহ সুবহানাহু তা‘আলার প্রশংসা করছি এবং তাঁর নি‘য়ামতের ব্যাপারে তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি; আর তাঁর নিকট তাঁর অনুগ্রহ ও করুনা বৃদ্ধির আবেদন করছি; আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, যিনি একক, যাঁর কোনো শরীক নেই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যাঁকে তিনি হেদায়েত ও সত্য দীনসহ সুসংবাদ বাহক ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেছেন; তিনি সত্যের দিকে আহ্বান করেছেন এবং কল্যাণের পথ প্রদর্শন করেছেন; আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ ও কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যে ব্যক্তি তাঁর হেদায়েতের অনুসরণ করবে তার উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।

অতঃপর

হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, তোমাদের রবের নির্দেশকে সমীহ কর, তোমাদের দীন ও আমানতসমূহকে হেফাযত (সংরক্ষণ) কর এবং তোমরা তোমাদের দায়িত্বসমূহ পালন কর; আর তোমরা তোমাদের নিজেদের ব্যাপারে ও তোমাদের পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং তোমাদের নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মীমাংসা করে নাও।

অনেক মানুষ সৌভাগ্যের অনুসন্ধান করে; আর অন্বেষণ করে শান্তি, স্থিতি এবং দেহ ও মনের প্রশান্তি; যেমনিভাবে সে দুর্ভাগ্য ও অস্থিরতার কারণসমূহ, দুশ্চিন্তার উদ্দীপকসমূহ এবং বিশেষ করে পারিবারিক কলহ থেকে দূরে থাকার ব্যাপারে চেষ্টাসাধনা করে।

তবে তাদের জানা উচিত যে, এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, তাঁর উপর ভরসা এবং সকল বিষয় তাঁর প্রতি সোপর্দ করা ব্যতীত এসব বাস্তবায়ন করা যাবে না, আর সাথে সাথে তিনি যেসব নিয়মনীতি ও উপায় প্রণয়ন করেছেন, সেগুলোকে গ্রহণ করতে হবে।

 পরিবার গঠন ও দাম্পত্য জীবনে সৌহার্দ্যের গুরুত্ব: 

এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর উপর যে বিষয়টি সবচেয়ে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে তা হলো পরিবার গঠন ও তাকে সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখা। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর প্রজ্ঞায় পরিবারকে পুরুষ ও নারী নির্বিশেষ সকল মানুষের জন্য তৈরি করেছেন প্রত্যাবর্তনস্থল হিসেবে; যাতে সে অবস্থান করবে এবং সেখানে প্রশান্তি অনুভব করবে; আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর বান্দাদের প্রতি এ অনুগ্রহ প্রকাশ করে বলেন:

﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِۦٓ أَنۡ خَلَقَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا لِّتَسۡكُنُوٓاْ إِلَيۡهَا وَجَعَلَ بَيۡنَكُم مَّوَدَّةٗ وَرَحۡمَةًۚ إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَأٓيَٰتٖ لِّقَوۡمٖ يَتَفَكَّرُونَ ٢١ ﴾ [الروم: ٢١]

“আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং সৃজন করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালবাসা ও সহমর্মিতা। নিশ্চয় এতে বহু নিদর্শন রয়েছে সে সম্প্রদায়ের জন্য, যারা চিন্তা করে।” - (সূরা আর-রূম, আয়াত: ২১ )।

হ্যাঁ, আল্লাহ বলেছেন: ‘যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়’; তিনি বলেন নি: ‘যাতে সে তার সাথে বাস করে’, সুতরাং আল্লাহর এ বাণীর দাবী হচ্ছে যে, পরিবারের আচার-আচরণ হবে স্থিতিশীল আর অনুভূতি হবে প্রশান্তির কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে সর্বোচ্চ অর্থে শান্তি ও নিশ্চিন্ততা প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকেই তার সঙ্গীর মধ্যে অস্থিরতার সময় প্রশান্তি এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে আনন্দ অনুভব করবে।

দাম্পত্য জীবনের সম্পর্কের মূলভিত্তি হল: ভালোবাসা, ঘনিষ্টতা ও সখ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত সাহচর্য ও মিলন। এ সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে, বিস্তৃতি অনেক দূর ব্যপ্ত, স্বয়ং ব্যক্তির সাথে তার আত্মার যে সম্পর্ক, এটা তার সাথে খুব চমৎকারভাবে তুলনাযোগ্য, যা আমাদের প্রতিপালকের কিতাব বর্ণনা করেছে, তিনি বলেছেন:

﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

“তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।” - ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭ )।

তাছাড়া এই সম্পর্ক ছেলে ও মেয়েদের শিক্ষা এবং লালনপালন দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে যা গঠন করে, তা স্নেহপূর্ণ মাতৃত্ব ও শ্রমনির্ভর পিতৃত্বের ছায়াতল ছাড়া হতে পারে না।

এ সম্মানিত পারিবারিক পরিবেশের চেয়ে আর কোন পরিবেশ অধিক পবিত্র হতে পারে?

মুসলিম পরিবার প্রতিষ্ঠার খুঁটিসমূহ

সম্মানিত পাঠক:

এমন অনেক বিষয় রয়েছে যার উপর মুসলিম পরিবারের অবকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে; যার মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্ক এবং যা মেনে চললে তা থেকে দূরে থাকে বিচ্ছিন্নতার ঝড়ো হাওয়া ও ভঙ্গ ও কর্তিত হওয়ার তুফান। সে সব খুঁটিসমূহের অন্যতম হচ্ছে:

১. আল্লাহর উপর পূর্ণ ঈমান ও তাঁর তাকওয়া অবলম্বন:

যে সব খুঁটির উপর মুসলিম পরিবার দাঁড়িয়ে থাকে, তন্মধ্যে সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: ঈমানের রশিকে শক্তভাবে আকড়ে ধরা ... আল্লাহ ও পরকালের প্রতি ঈমান; অন্তর যা লুকিয়ে রাখে, সে বস্তু সম্পর্কে যিনি জানেন তাকে ভয় করা; তাকওয়া ও আত্মপর্যবেক্ষণকে অপরিহার্য করে নেয়া; আর যুলুম থেকে এবং সত্য অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অন্যায়ের আশ্রয় নেওয়া থেকে দূরে থাকা। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ ... ذَٰلِكُمۡ يُوعَظُ بِهِۦ مَن كَانَ يُؤۡمِنُ بِٱللَّهِ وَٱلۡيَوۡمِ ٱلۡأٓخِرِۚ وَمَن يَتَّقِ ٱللَّهَ يَجۡعَل لَّهُۥ مَخۡرَجٗا ٢ وَيَرۡزُقۡهُ مِنۡ حَيۡثُ لَا يَحۡتَسِبُۚ وَمَن يَتَوَكَّلۡ عَلَى ٱللَّهِ فَهُوَ حَسۡبُهُۥٓۚ ... ٣ ﴾ [الطلاق: ٢،  ٣] 

“ ... এর দ্বারা তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসের উপর ঈমান রাখে, তাকে উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। আর যে কেউ আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য (উত্তরণের) পথ করে দেবেন, আর তিনি তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে দান করবেন রিযিক। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। ...” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ২ - ৩)।

আর এই ঈমানকে শক্তিশালী করবে: আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের ব্যাপারে চেষ্টা করা, তার ব্যাপারে যত্নবান থাকা এবং সে ব্যাপারে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পরস্পরকে উপদেশ দেওয়ার ব্যবস্থা করা; তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণীটি নিয়ে ভেবে দেখ, তিনি বলেছেন:

« رحم الله رجلا قام من الليل فصلى وأيقظ امرأته فصلت , فإن أبت نضح في وجهها الماء ( يعني : رش عليها الماء رشا رفيقا ) , ورحم الله امرأة قامت من الليل فصلت وأيقظت زوجها فصلى , فإن أبى نضحت في وجهه الماء » . (رواه أحمد و أبو داود و النسائي و ابن ماجه ) .

“আল্লাহ রহম করুন এমন পুরুষ ব্যক্তির প্রতি, যে ব্যক্তি রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্ত্রীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্ত্রী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়। আর আল্লাহ রহম করুন এমন নারীর প্রতি, যে রাতে ঘুম থেকে উঠে, অতঃপর সালাত আদায় করে এবং সে তার স্বামীকে জাগিয়ে দেয়, তারপর সেও সালাত আদায় করে; অতঃপর সে (স্বামী) যদি ঘুম থেকে উঠতে আপত্তি করে, তাহলে তার মুখমণ্ডলের উপর হালকাভাবে পানি ছিটিয়ে দেয়।”[1]

স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কটি পার্থিব ও বস্তুগত কোনো সম্পর্ক নয়; নয় চতুষ্পদ জন্তুর প্রবৃত্তির মত কোনো সম্পর্ক; বরং তা হল আত্মীক ও সম্মানজনক একটি সম্পর্ক; আর যখন এই সম্পর্কটি নির্ভেজাল ও যথাযথ হবে, তখন তা মৃত্যুর পর পরকালীন জীবন পর্যন্ত সম্প্রসারিত হবে; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿جَنَّٰتُ عَدۡنٖ يَدۡخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنۡ ءَابَآئِهِمۡ وَأَزۡوَٰجِهِمۡ وَذُرِّيَّٰتِهِمۡۖ ﴾ [الرعد: ٢٣]

“স্থায়ী জান্নাত, তাতে তারা প্রবেশ করবে এবং তাদের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদের মধ্যে যারা সৎকাজ করেছে তারাও।” - ( সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৩ )।

২. সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা:

যে জিনিসটি এ পবিত্র দাম্পত্য সম্পর্ককে হেফাযত ও তত্ত্বাবধান করে, তা হল পরস্পর সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন করা; আর এটা ততক্ষণ পর্যন্ত বাস্তবে পরিণত হবে না, যতক্ষণ না প্রত্যেক পক্ষ তার ভাল-মন্দ সম্পর্কে বুঝতে পারবে। বস্তুত ঘর ও পরিবারের ব্যাপারে সার্বিক পূর্ণতার বিষয়টি সুদূর পরাহত, তাই পরিবারের সদস্য কিংবা অন্যদের মধ্যে সকল বৈশিষ্ট্যের পরিপূর্ণতা লাভ করার আশা করাটা মানব স্বভাবে নাগালের বাইরের বিষয়।

দাম্পত্য জীবন তথা পরিবার সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দর জীবন যাপনে স্বামীর ভূমিকা:   

সুস্থ বিবেক এবং পরিপক্ক চিন্তার দাবী হচ্ছে, কতিপয় অসহিষ্ণুতাকে গ্রহণ করা এবং অসুখকর বিষয় থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে রাখার ব্যাপারে মনকে তৈরী করে রাখা। কারণ, পুরুষ হল পরিবারের কর্তা, তার নিজের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা নারীর চেয়ে অধিক হবে এটাই দাবি। কেননা, পুরুষ জানে যে, নারী তার সৃষ্টিগত ও স্বভাব-প্রকৃতির দিক থেকে দুর্বল; যখন তাকে প্রত্যেক বিষয়ে জবাবদিহির সম্মুখীন করা হবে, তখন সে সব বিষয়ে জবাব দিতে অক্ষম হয়ে পড়বে; আর তাকে সোজা করার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করার বিষয়টি তাকে ভেঙ্গে ফেলার দিকে নিয়ে যাবে, আর তার ভেঙ্গে যাওয়া মানে তাকে তালাক দেওয়া; নবী মুস্তাফা সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যিনি খেয়াল-খুশির অনুসরণ করে কোনো কথা বলেন না, (বরং যা বলেন আল্লাহর পক্ষ থেকেই বলেন) তিনি বলেন,

« استوصوا بالنساء فإن المرأة خلقت من ضلع وإن أعوج شيء في الضلع أعلاه , فإن ذهبت تقيمه كسرته , وإن تركته لم يزل أعوج فاستوصوا بالنساء » . ( رواه البخاري و مسلم ) .

“তোমরা নারীদের ব্যাপারে উত্তম উপদেশ গ্রহণ কর। কারণ, নারী জাতিকে পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে; আর পাঁজরের হাড়গুলোর মধ্যে উপরের হাড়টি অধিক বাঁকা; সুতরাং তুমি যদি তা সোজা করতে যাও, তাহলে তা ভেঙ্গে ফেলবে; আর যদি এমনি ছেড়ে দাও, তাহলে সব সময় তা বাঁকাই থেকে যাবে; কাজেই নারীদের সাথে কল্যাণমূলক কাজ করার উপদেশ গ্রহণ কর।”[2] সুতরাং নারীর মধ্যে বক্রতার বিষয়টি মৌলিকভাবেই সৃষ্টিগত; অতএব, আবশ্যক হলো সহজসুলভ আচরণ করা এবং ধৈর্য ধারণ করা।

তাই পুরুষের উপর কর্তব্য হল, তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে অসহিষ্ণু আচরণের প্রকাশ ঘটবে, সে ক্ষেত্রে তার সাথে দীর্ঘ বিতর্কে জড়িয়ে না পড়া; আর সে যেন তাদের মধ্যকার বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকসমূহ থেকে দৃষ্টি এড়িয়ে চলে এবং তার কর্তব্য হল তাদের মধ্যকার ভাল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করা, আর এর মধ্যে সে অনেক ভালো কিছু পাবে।

অনুরূপ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

«  لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً ( أي : لا يبغض و لا يكره ) إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ  » . ( رواه مسلم ) .

“কোন মুমিন পুরুষ কোনো মুমিন নারীকে ঘৃণা ও অপছন্দ করবে না; যদি সে তার কোনো স্বভাবকে অপছন্দ করেও, তাহলে সে তার অপর একটি স্বভাবকে পছন্দ করবে।”[3] আর সে যেন এ ক্ষেত্রে অধিক পরিমাণে ধীর-স্থিরতা অবলম্বন করে; সে যদি তার অপছন্দনীয় কোনো কিছু দেখে, তাহলে এটাই শেষ কথা হিসেবে গ্রহণ না করে, কারণ সে জানে না কোথায় রয়েছে কল্যাণের মাধ্যম ও ভালোর উৎস।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ ... وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء: ١٩]  

“ ... আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯ )।

আর শান্তি কিভাবে হবে? আর প্রশান্তি ও হৃদ্যতা কোত্থেকে আসবে? যখন পরিবারের কর্তা কঠোর প্রকৃতির, দুর্ব্যবহারকারী ও সংকীর্ণমনা হন; যখন তাকে নির্বুদ্ধিতা পরাভূত করে; আর তাড়াহুড়া, সন্তুষ্টির ক্ষেত্রে ধীরতা ও রাগের ক্ষেত্রে দ্রুততার বিষয়টি তাকে অন্ধ করে তুলে; যখন সে প্রবেশ করে, তখন বেশি বেশি খোটা দেয়; আর যখন বের হয়, তখন সে কুধারণা করে? অথচ এটা জানা কথা যে, উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপন এবং সৌভাগ্যের উপায়-উপকরণসমূহ কেবল উদারতা এবং ভিত্তিহীন যাবতীয় ধ্যানধারণা ও সন্দেহ থেকে দূরে থাকার মধ্য দিয়েই অর্জিত হতে পারে। আর আত্মমর্যাদা বা ব্যক্তিত্বের অহংবোধ কখনও কখনও কিছু সংখ্যক মানুষকে কুধারণা পোষণ করার দিকে নিয়ে যায়... তাকে নিয়ে যায় বিভিন্ন কথাবার্তার অপব্যাখ্যা কিংবা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মধ্যে সন্দেহ তৈরী করতে। আর তখন তা কোনো নির্ভরযোগ্য কারণ ছাড়াই ব্যক্তির জীবনকে বিস্বাদ করে দেয় এবং মনকে অস্থির করে তুলে। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ وَلَا تُضَآرُّوهُنَّ لِتُضَيِّقُواْ عَلَيۡهِنَّۚ ﴾ [الطلاق: ٦]

“আর তাদেরকে উত্যক্ত করবে না সংকটে ফেলার জন্য।” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ৬)।

আর কিভাবে এ কাজটি একজন লোক তার স্ত্রী সম্পর্কে করতে পারে, অথচ নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« خيركم خيركم لأهله وأنا خيركم لأهلي » . ( رواه الترمذي و ابن ماجه  ) .

“তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, তোমাদের মধ্যে যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম; আর আমি তোমাদের মধ্যে আমার স্ত্রীর নিকট উত্তম।”[4]

দাম্পত্য জীবন তথা পরিবার সংরক্ষণ ও সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে সুন্দর জীবন যাপনে স্ত্রীর ভূমিকা:   

মুসলিম নারীর জেনে রাখা উচিত যে, সৌভাগ্য, ভালোবাসা ও অনুকম্পা তখনই পরিপূর্ণতা লাভ করবে, যখন সে সচ্চরিত্রবান ও দ্বীনদার হবে; সে তার নিজের জন্য উপকারী ইতিবাচক দিকগুলো জেনে নিবে; যাতে সে তার সীমা অতিক্রম ও লঙ্ঘন না করে; সে তার স্বামীর আহ্বানে সাড়া দিবে; কারণ, তাকে পরিচালনার ব্যাপারে স্বামীর উপর দায়িত্ব রয়েছে, স্বামী তাকে হেফাযত করবে, সংরক্ষণ করবে এবং তার জন্য ব্যয় করবে; সুতরাং স্ত্রীর উপর আবশ্যক হলো, স্বামীর আনুগত্য করা, স্বামীর জন্য সে তার নিজকে সংরক্ষণের নিশ্চয়তা বিধান করা এবং স্বামীর সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ করা; আর স্ত্রী তার নিজের কাজ-কর্ম সুন্দরভাবে আঞ্জাম দিবে ও তা যথাযথভাবে পালন করবে এবং সে তার নিজের ও সংসারের প্রতি যত্নবান হবে; সে হবে পবিত্রা স্ত্রী, মমতাময়ী মাতা, তার স্বামীর সংসারের রক্ষণাবেক্ষণকারিনী দায়িত্বশীলা, যে দায়িত্ব ও কর্তব্যের ব্যাপারে তাকে জবাবদিহী করতে হবে। সে তার স্বামীর ভালো ও সৌন্দর্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতি দিবে, তার অবদান ও উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে জীবন-যাপনের বিষয়টিকে অবজ্ঞা ও অস্বীকার করবে না; এই ধরনের অবজ্ঞা প্রদর্শন ও অস্বীকার করার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্ক করেছেন, তিনি বলেছেন:

« أريت النار فإذا أكثر أهلها النساء يكفرن » . قيل : أيكفرن بالله ؟ قال : « يكفرن العشير ويكفرن الإحسان ؛ لو أحسنت إلى إحداهن الدهر ثم رأت منك شيئا قالت : ما رأيت منك خير قط » . ( رواه البخاري ) .

“আমাকে জাহান্নাম দেখানো হয়; (তখন আমি দেখি) তার অধিবাসীদের অধিকাংশই স্ত্রীলোক, যারা কুফরী করে। জিজ্ঞাসা করা হল: তারা কি আল্লাহর সঙ্গে কুফরী করে? তিনি বললেন: “তারা স্বামীর অবাধ্য হয় এবং ইহসান (সদ্ব্যবহার) অস্বীকার করে; তুমি যদি দীর্ঘকাল তাদের কারও প্রতি ইহসান করে থাক, এরপর সে তোমার সামান্য অবহেলা দেখলেই বলে, আমি কখনও তোমার কাছ থেকে ভাল ব্যবহার পাইনি।”[5]

সুতরাং আবশ্যক হল ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা এবং অপরাধ বা ভুল-ভ্রান্তির প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা ... স্বামী উপস্থিত থাকলে তার প্রতি দুর্ব্যবহার করবে না, আর স্বামী অনুপস্থিত থাকলে, স্বামীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না।

এর মাধ্যমেই পারস্পরিক সন্তুষ্টি অর্জিত হবে, সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব স্থায়ী হবে এবং আন্তরিকতা, ভালবাসা ও সহমর্মিতা প্রাধান্য বিস্তার করবে। নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভাষায়:

« أيما امرأة ماتت وزوجها عنها راض دخلت الجنة  » . (رواه الترمذي و ابن ماجه) .

“যে নারীই তার প্রতি তার স্বামী সন্তুষ্ট থাকা অবস্থায় মারা যাবে, সে নারী জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[6]

সুতরাং হে মুসলিম জাতি! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং জেনে রাখ যে, পারস্পরিক সহযোগিতা ও একতা অর্জন করার মাধ্যমে সৌভাগ্য পরিপূর্ণতা লাভ করবে, শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ তৈরি হবে এবং তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে এমন এক মর্যাদাবান ঘরে, যা ভালাবাসার দ্বারা পরিপূর্ণ, পারস্পরিক বুঝাপড়ার দ্বারা সমৃদ্ধ ... মাতৃত্বের সহানুভূতিশীলতা ও পিতৃত্বের করুণার মাঝে (বিদ্যমান) ... তারা অবস্থান করবে অনেক দূরে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও বিতর্কের শোরগোল এবং একে অন্যের সাথে বাড়াবাড়ি থেকে; যাতে করে সেখানে থাকবে না কোনো প্রকার অনৈক্য, মতবিরোধ ও দুর্ব্যবহার, কাছে কিংবা দূরে। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿... رَبَّنَا هَبۡ لَنَا مِنۡ أَزۡوَٰجِنَا وَذُرِّيَّٰتِنَا قُرَّةَ أَعۡيُنٖ وَٱجۡعَلۡنَا لِلۡمُتَّقِينَ إِمَامًا ٧٤ ﴾ [الفرقان: ٧4]

“ ... হে আমাদের রব! আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি দান করুন, যারা হবে আমাদের জন্য চোখজুড়ানো। আর আপনি আমাদেরকে করুন মুত্তাকীদের জন্য অনুসরণযোগ্য।”- (সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৭৪)।

উপসংহার

পরিশেষে- আমার মুসলিম ভাই ও বোন! আল্লাহ তোমাদেরকে তাওফীক দিন:

নিশ্চয়ই পরিবারের সংস্কার হল গোটা সমাজের নিরাপত্তার উপায়; এমন সমাজকে সংস্কার করা অসম্ভব, যাতে পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়েছে; কিভাবেই বা সম্ভব, অথচ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা পারিবারকে নিয়ামত হিসেবে আমাদের কাছে অনুগ্রহ হিসেবে তুলে ধরেছেন। যে নেয়ামতটি হচ্ছে পরিবারের পরস্পর বন্ধন, মিলন ও চিরাচয়িত সম্পর্ক ..। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেন:

﴿ وَٱللَّهُ جَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ أَزۡوَٰجٗا وَجَعَلَ لَكُم مِّنۡ أَزۡوَٰجِكُم بَنِينَ وَحَفَدَةٗ وَرَزَقَكُم مِّنَ ٱلطَّيِّبَٰتِۚ أَفَبِٱلۡبَٰطِلِ يُؤۡمِنُونَ وَبِنِعۡمَتِ ٱللَّهِ هُمۡ يَكۡفُرُونَ ٧٢ ﴾ [النحل: ٧٢] 

“আর আল্লাহ তোমাদের থেকে তোমাদের জোড়া সৃষ্টি করেছেন; আর তোমাদের যুগল থেকে তোমাদের জন্য পুত্র-পৌত্রাদি সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম জীবণোপকরণ দান করেছেন। তবুও কি ওরা মিথ্যাতে বিশ্বাস করবে এবং ওরা আল্লাহর অনুগ্রহ অস্বীকার করবে?” - ( সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৭২ )।

নিশ্চয়ই স্বামী-স্ত্রী ও তাদের মধ্যকার মজবুত সম্পর্ক এবং পিতা-মাতা ও তাদের কোলে বেড়ে উঠা সন্তান-সন্ততি- এ বিষয় দু’টি বর্তমান জাতি ও ভবিষ্যৎ জাতি হিসেবে বিবেচ্য। তাই এটা বলা যায় যে, শয়তান যখন পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করার ব্যাপারে সফল হবে, তখন এর মাধ্যমে সে কেবল একটি সংসারকেই ধ্বংস করবে না, কোনো সীমাবদ্ধ অনিষ্টতাই সংঘটিত করবে না বরং তা গোটা জাতিকে বড় ধরনের ক্ষতি ও দ্রুততর অনিষ্টতার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। আর বর্তমান বাস্তবতা তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।

সুতরাং আল্লাহ ঐ পুরুষ ব্যক্তিকে রহম করুন, যিনি প্রশংসনীয় চরিত্র ও উৎকৃষ্ট মনের অধিকারী, উদার, কোমল, দয়ালু, তার পরিবারের প্রতি স্নেহপরায়ণ এবং তার কাজের ব্যাপারে বিচক্ষণ; যিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না, কঠোরতা আরোপ করে যুলুম করেন না এবং দায়িত্বের ব্যাপারে উদাসীনতার পরিচয় দেন না।

আর আল্লাহ ঐ নারীর প্রতি রহম করুন, যিনি ভুল-ত্রুটি খোঁজে বেড়ান না, বেশি শোরগোল করেন না, সততাপরায়ণা, আনুগত্যপরায়ণা এবং অদৃশ্য অংশের হেফাজতকারিনী, যেভাবে আল্লাহ হেফাজত করেছেন।

সুতরাং হে স্বামী ও স্ত্রীগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; আর হে মুসলিমগণ! তোমরাও আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করবে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দিবেন।

(আল্লাহ রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি এবং তাঁর পরিবার-পরিজন ও তাঁর পবিত্র স্ত্রীগণের প্রতি; আরও রহমত ও শান্তি বর্ষণ করুন তাঁর সাহাবীগণ এবং কিয়ামতের দিন পর্যন্ত যারা তাঁদেরকে উত্তমভাবে অনুসরণ করবে তাদের প্রতি)।

 سبحانك اللهم و بحمدك , أشهد أن لا إله إلا أنت أستغفرك و أتوب إليك .

(হে আল্লাহ! তোমার প্রশংসাসহ তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি; আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তোমার নিকট তাওবা করছি)।


[1] হাদিসটি সহীহ, যা বর্ণনা করেছেন: আহমদ, আল-মুসনাদ: ২/২৫০, ৪৩৬; আবূ দাউদ: ১৩০৮; নাসায়ী: ৩/২০৫; ইবনু মাজাহ: ১৩৩৬; আর ইবনু খুযাইমা হাদিসটিকে বিশুদ্ধ বলেছেন (১১৪৮); হাকেম: ১/৩০৯; আর যাহাবী র. তা সমর্থন করেছেন।

[2] বুখারী, আল-জামে‘উস সহীহ (৫১৮৬); মুসলিম, আস-সহীহ (১৪৬৮)

[3] মুসলিম, আস-সহীহ (১৪৬৯);

ফায়দা: হাফেয ইবনু হাজার র. যা বলেছেন, তার সারকথা হল: হাদীসের মধ্যে সহানুভূতির মাধ্যমে স্ত্রীকে পুনর্গঠনের ইঙ্গিত রয়েছে; সুতরাং সে তাতে অতিরঞ্জন করবে না, যাতে সংসার ভেঙ্গে যায়; আর সে তাকে একেবারে ছেড়ে দেবে না; যাতে সে তার বক্রতার উপরেই চলতে থাকবে। আর এর বিধিবদ্ধ নিয়ম হল: যখন স্ত্রী তার স্বভাবগত ত্রুটিটি বার বার পুনরাবৃত্তি ঘটাবে, আর তা তাকে সরাসরি অবাধ্যতাকে গ্রহণ করার দিকে অথবা আবশ্যকীয় বিষয় বর্জন করার দিকে নিয়ে যাবে; এমতাবস্থায় সে তাকে বক্রতার উপর ছেড়ে দেবে না। পক্ষান্তরে যখন তার বক্রতাটি কোনো বৈধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে হয়, তখন সে তাকে তার উপর ছেড়ে দেবে। - দেখুন: ফাতহুল বারী, ৯/২৫৪।

[4] হাদিসটি সহীহ; তা বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (৩৮৯২); ইবনু মাজাহ (১৯৭৭); ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ (১৩১২)

[5] বুখারী, আল-জামে‘উস সহীহ (৫১৯৭)

[6] হাদিসটি বর্ণনা করেছেন তিরমিযী (১১৬১) এবং তিনি তাকে ‘হাসান’ বলেছেন; ইবনু মাজাহ (১৮৫৪); হাকেম, ৪/১৭৩ এবং তিনি বলেছেন: হাদিসটির সনদ সহীহ (বিশুদ্ধ)।

Viewing all 385 articles
Browse latest View live