Quantcast
Channel: QuranerAlo.com – কুরআনের আলো ইসলামিক ওয়েবসাইট
Viewing all 385 articles
Browse latest View live

পরিবার বিষয়ক প্রবন্ধ –স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব

$
0
0

4cbc5d5286d9b76a3e020000

লেখকঃ ড. সালেহ ইবন আবদিল্লাহ ইবন হুমাইদ | অনুবাদ : মোঃ আমিনুল ইসলাম |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

পর্ব - ১ | পর্ব - ২

بسم الله الرحمن الرحيم

ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টি করেন, অতঃপর সুঠাম করেন, যিনি নির্ধারণ করেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেন; আমি তার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি। তিনি শেষে ও প্রথমে সকল প্রশংসার প্রাপ্য মালিক। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, যাঁর কোনো শরীক নেই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি নির্বাচিত নবী ও বান্দা; আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ এবং যে ব্যক্তি তাঁর দা‘ওয়াতের মাধ্যমে দা‘ওয়াত দান করে ও যে ব্যক্তি তাঁর পদ্ধতির অনুসরণে জীবনযাপন করে, সে ব্যক্তিসহ উল্লেখিত সকলের উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।

অতঃপর:

জেনে রাখুন, আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিন— আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম মহান নিয়ামত ও নিদর্শন হল ঘর-সংসার, যা আশ্রয়স্থল ও শান্তি নিকেতন; তার ছায়াতলে মানবগোষ্ঠী ভালবাসা ও অনুকম্পা, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা এবং মহৎ জীবন ও শালীনতা লাভ করবে ... তার কোলে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বিস্তার লাভ করবে এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতা শক্তিশালী হবে। অন্তরের সাথে অন্তর যুক্ত হবে ... এবং মনের সাথে মনের আলিঙ্গন হবে; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

“তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।” - ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭ )।

এই মজবুত সম্পর্ক ও উন্নত সংসারের মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটবে এবং ঐসব পুরুষ ব্যক্তিগণ বেড়ে উঠবে, যাদেরকে আমানতস্বরূপ মহান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; আর ঐসব নারীদেরকে শিক্ষা দেওয়া হবে, যারা বংশমূল তথা জাতির ভবিষ্যতকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে।

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্বের কতিপয় কারণ

জীবনের বাস্তবতা এবং মানুষ (যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; আর যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ভাল জানেন) সে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে কখনও কখনও (জীবনের বাস্তবতায়) এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাতে দিক-নির্দেশনা কাজ করে না এবং ভালবাসা ও প্রশান্তি সুদৃঢ় হয় না; যার কারণে কখনও কখনও দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখা কষ্টকর ও কঠিন হয়ে যায়। ফলে তাতে দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না এবং তার দ্বারা নবীন সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সমর্থ হয় না। আর এ বিশৃঙ্ল ও অনৈক্যের অবস্থা বা পরিস্থিতিসমূহের কারণসমূহ কখনও কখনও হয়ে থাকে আভ্যন্তরীণ আবার কখনও কখনও হয় বহিরাগত।

যেমন কখনও কখনও এ সমস্যার উত্থান হয়: স্বামী-স্ত্রীর অভিভাবক অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্য অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, অথবা স্বামী-স্ত্রীর সকল ছোট বড় কর্মকাণ্ডের পশ্চাদ্ধাবন; আবার কখনও কখনও পরিবারের কোনো কোনো অভিভাবক এবং পরিবারের বড়দের পক্ষ থেকে তাদের অধিনস্থদের উপর এত বেশি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হয় যে, তা কখনও কখনও বিচারকের নিকট বিচার নিয়ে যাওয়ার পর্যন্ত গড়ায়; ফলে আড়ালে ঢাকা রহস্যসমূহ প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং গোপন বিষয়সমূহ উম্মোচন হয়ে যায়, আর এগুলো হয় নিছক ছোট-খাট বিষয় অথবা তুচ্ছ কিছু কারণে; যার উৎপত্তি হয়ত অনুপযুক্ত অথবা প্রজ্ঞাশূন্য হস্তক্ষেপ অথবা তাড়াহুড়া ও দ্রুততা অবলম্বন বা গুজব ও আজে-বাজে কথায় কান দেওয়া ও সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা।

আর কখনও কখনও সমস্যার উৎসস্থল হয়: দীনের ব্যাপারে দূরদর্শিতার স্বল্পতা ও মহানুভব শরী‘য়তের বিধিবিধানসমূহের ব্যাপারে অজ্ঞতা এবং পুঞ্জীভূত কুঅভ্যাস ও দুর্বল চিন্তাধারা লালন করা।

ফলে কোনো কোন স্বামী বিশ্বাস করে বসে যে, তালাকের দ্বারা হুমকি দেওয়া অথবা তা উচ্চারণ করা হল দাম্পত্য বিরোধ ও পারিবারিক সমস্যার একটি সঠিক সমাধান; সুতরাং সে তার প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় এবং তার নির্দেশ প্রদান ও নিষেধাজ্ঞার সময়ে, এমনকি তার সকল অবস্থায় (স্ত্রীর সাথে) কথাবার্তার ক্ষেত্রে তালাকের শব্দগুলো ব্যতীত অন্য কিছু জানে না বা বুঝে না; আর সে এও জানে না যে, এর দ্বারা সে প্রকারান্তরে আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাস হিসেবে গ্রহণ করেছে; সে তার কর্মকাণ্ডে অপরাধী বা পাপী হচ্ছে, তার সংসার ধ্বংস করছে এবং তার পরিবার-পরিজন হারাচ্ছে।

হে মুসলিমগণ! এটাই কি দীনের ফিকহ তথা সুক্ষ্ম জ্ঞান হতে পারে?!

নিশ্চয়ই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতি যে তালাকের বিধান রয়েছে তার উদ্দেশ্য দাম্পত্য সম্পর্কের বন্ধন বা রশি কর্তন করা নয়, বরং বলা যায় যে, এ পদ্ধতির তালাক হচ্ছে এই সম্পর্ক সাময়িকভাবে আটকে রাখা এবং প্রতীক্ষা, চিন্তাভাবনা ও সংশোধনের একটি পর্যায়; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ ... لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخۡرُجۡنَ إِلَّآ أَن يَأۡتِينَ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖۚ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ فَإِذَا بَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ فَارِقُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖ ... ﴾ [الطلاق: ١،  ٢]

“ ... তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও বের হবে না, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা; যে আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সে নিজেরই উপর অত্যাচার করে। আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন। অতঃপর তাদের ইদ্দত পূরণের কাল আসন্ন হলে তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে দেবে, না হয় তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ করবে। ...” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১-২)।

এটাই হচ্ছে শরী‘য়ত। বরং বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; নিশ্চয়ই সুন্নাত পদ্ধতিতে তালাক প্রদানের বিধানটি প্রতিকারের সর্বশেষ অস্ত্র এবং এর পূর্বে অনেকগুলো উপায় রয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের কতিপয় উপায়

আমার মুসলিম ভাই ও বোন:

যখন বিরোধের আলামত, অবাধ্যতা, মতানৈক্যের লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তখন তালাক বা তালাকের হুমকি প্রদান করা তার প্রতিকার নয়।

প্রতিকারের জন্য যা দাবি করা হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল: ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা এবং স্বভাব-প্রকৃতির ক্ষেত্রে ভিন্নতার বিষয়টি অনুধাবন করা; সাথে আরও জরুরি হল অনেক বিষয়ে উদারতার পরিচয় দেওয়া এবং দেখেও না দেখার ভান করা; কারণ সব সময় সে যা পছন্দ ও কামনা করে, তার মধ্যে মঙ্গল ও কল্যাণ হয় না, বরং কখনও কখনও সে যা পছন্দ ও কামনা করে না, তার মধ্যেই কল্যাণ হয়; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ ... وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء: ١٩] 

“আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯ )।

কিন্তু যখন সমস্যা প্রকাশ পাবে, পারস্পরিক দায়বদ্ধতার বন্ধনে শিথিলতা দেখা দিবে এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা, তার স্বভাব চরিত্রে অহমিকা এবং তার দায়িত্ব থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রকাশ পাবে; যেমন- ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া, স্বামীর অধিকারের ব্যাপারে কমতি করার বিষয় এবং স্বামীর মর্যাদাকে অবজ্ঞা করার বিষয় প্রকাশ করা, তখন ইসলামে এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সুস্পষ্ট; তাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই তালাক প্রসঙ্গ আসবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাবে বলেন:

﴿ ...  وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَكُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡهِنَّ سَبِيلًاۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيّٗا كَبِيرٗا ٣٤ ﴾ [النساء: ٣٤]

“ ... আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, মহান।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৪ )।

তাই বুঝা গেল যে, উক্ত অবস্থার প্রতিকার হবে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, অধিকারসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এবং আল্লাহর গজব ও ঘৃণা থেকে ভয় প্রদর্শন করার মাধ্যমে; সাথে আরও প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শন করা।

আর কখনও কখনও অহমিকা ও অবাধ্যতার মোকাবিলায় শয্যা বর্জন ও বয়কট করা হচ্ছে এর প্রতিকার; আপনারা লক্ষ্য করুন যে, শয্যা বর্জন করার অর্থ শয়নকক্ষ বর্জন করা নয়; ... তা হল শয্যা বর্জন করা, ঘর বয়কট করা নয় ... পরিবার বা সন্তান বা অপরিচিত লোকজনের সামনে নয়।

উদ্দেশ্য হল প্রতিকার করা, ঘোষণা করা অথবা অপমান করা অথবা গোপন বিষয় প্রকাশ করা নয়; বরং উদ্দেশ্য হল বর্জন ও বয়কটের মাধ্যমে অবাধ্যতা ও অহংকারের মোকাবিলা করা, যা পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি ও সমতার দিকে পরিচালিত করে।

আর কখনও কখনও কিছু কঠোর ও রূঢ় মনোভাবের মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে; কারণ, কিছু মানুষ এমনও রয়েছে, যাদেরকে সোজা করার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহার ও ভদ্র কথায় কোনো কাজ হয় না; বরং তারা এমন শ্রেণীর মানুষ যাদেরকে অধিকাংশ সময় নম্র ব্যবহার ও সহিষ্ণুতা অবাধ্য করে তোলে ... সুতরাং যখন কঠোরতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখন অবাধ্য ব্যক্তি থেমে যাবে এবং বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি শান্ত হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, কখনও কখনও কিছু চাপ প্রয়োগের আশ্রয় নেয়াটাও কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে; আর কেনই বা সে তার আশ্রয় নিবে না, অথচ দায়িত্বের প্রতি বৈরী ভাব ও স্বভাব-প্রকৃতি থেকে বের হওয়ার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে যাচ্ছে?

আর সকল বিবেকবান ব্যক্তির নিকট বিদিত যে, কঠোরতা যখন সংসারের জন্য তার শৃঙ্খলা ও মজবুত বন্ধনকে ফিরিয়ে দিবে এবং পরিবারকে ফিরিয়ে দিবে ভালবাসা ও হৃদ্যতা, তখন তা নিঃসন্দেহে তালাক ও বিচ্ছেদের চেয়ে উত্তম; তা হবে ইতিবাচক, শিক্ষামূলক ও অর্থবহ সমাধান; ঘায়েল করা ও প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তার দ্বারা অবাধ্যতাকে দমন করা হয় এবং বিশৃঙ্খলাকে সংযত করা করা হয়।

আর যখন স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশঙ্কা করবে, তখন আল-কুরআনুল কারীম তার প্রতিকারের দিক নির্দেশনা প্রদান করে তাঁর বাণীর মাধ্যমে, আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ وَإِنِ ٱمۡرَأَةٌ خَافَتۡ مِنۢ بَعۡلِهَا نُشُوزًا أَوۡ إِعۡرَاضٗا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يُصۡلِحَا بَيۡنَهُمَا صُلۡحٗاۚ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ ... ﴾ [النساء: ١٢٨]

“আর কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাদের কোনো গোনাহ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই শ্রেয়।” - (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৮ );

প্রতিকার হবে আপোস-নিষ্পত্তি ও শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে, তালাক ও সম্পর্ক বাতিলের মাধ্যমে নয়। আবার কখনও কখনও বিবাহ বন্ধনকে সুরক্ষার জন্য আর্থিক অথবা ব্যক্তিগত অধিকারের কিছু কিছু বিষয় ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে।

﴿ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ  ﴾ [আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম]। অবাধ্যতা, দুর্ব্যবহার, বিদ্বেষ ও তালাকের চেয়ে আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম।

আমার মুসলিম ভাই ও বোন:

এটা একটা গতিশীল আবেদন এবং আল্লাহর দীনের ফিকহের দিক থেকে ও তাঁর বিধিবিধানের উপর ভিত্তি করে আচার-আচরণের একটি সংক্ষিপ্ত স্মারক; সুতরাং তার থেকে মুসলিমগণ কোথায় যাচ্ছে?

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধের ব্যাপারে কেন সালিস নিয়োগ করা হয় না?  এ সমাধান থেকে কেন সংস্কারকগণ বিরত থাকে? সে কি প্রকৃত সংশোধনের ব্যাপারে অমনোযোগী, নাকি পরিবার ভাঙ্গন ও সন্তানদেরকে বিভক্ত করার ব্যাপারে উৎসাহী?

নিশ্চয়ই আপনি তাকে নির্বুদ্ধিতা, বাড়াবাড়ি, আল্লাহর ভয় ও তাঁর নজরদারী থেকে দূরুত্বে অবস্থান, তাঁর বিধিবিধানের অধিকাংশকে প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা রেখার ব্যাপারে ছিনিমিনি খেলা ছাড়া অন্য কিছু মনে করবেন না।

ইমাম ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান প্রমূখ গ্রন্থকারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন:

« ما بال أقوام يلعبون بحدود الله . يقول أحدهم : قد طلقتك . قد راجعتك . قد طلقتك ؟ أيلعب بحدود الله و أنا بين أظهركم » . ( رواه ابن ماجه و ابن حبان  ) .

“কিছু লোকের কি হল যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে; তাদের কেউ কেউ বলে: আমি তোমাকে তালাক দিলাম, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনলাম, আমি তোমাকে তালাক দিলাম? সে কি আল্লার নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, অথচ আমি তোমাদের মাঝেই রয়েছি?”[1]

দ্বন্দ্ব নিরসনের সর্বশেষ উপায়

দ্বন্দ্ব নিরসনের ব্যাপারে যখন সকল উপায় ব্যর্থ হবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখা যখন কঠিন ও কষ্টকর হয়ে যাবে, এমনকি যখন তার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অভিষ্ট লক্ষ্য ও মহান তাৎপর্য বাস্তবায়ন করা না যায়, তখন শরী‘য়তের উদারতা ও তার বিধানসমূহের পরিপূর্ণতার প্রমাণ হচ্ছে যে, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য উপায় রাখা হয়েছে। তবে মুসলিমগণের অনেকেই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতির তালাকের সম্পর্কে অজ্ঞ এবং আল্লাহর সীমারেখা ও তাঁর শরী‘য়তের প্রতি লক্ষ্য রাখা ছাড়াই তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে থাকে।

ঋতুবর্তীকালীন সময়ে তালাক দেয়া হারাম, (একসাথে) তিন তালাক প্রদান করা হারাম এবং এমন ঋতুমুক্তকালীন সময়ে তালাক প্রদান করাও হারাম, যাতে উভয়ের মাঝে মিলন (সহবাস) হয়েছে; সুতরাং এ ধরনের সকল তালাক বিদ‘আত ও হারাম (নিষিদ্ধ)। এ ধরনের তালাকদাতার পাপ হবে; কিন্তু আলেমগণের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে।

যে সুন্নাত পদ্ধতির তালাক সম্পর্কে অবহিত হওয়া মুসলিমগণের উপর ওয়াজিব, তা হলো:  ঋতুমুক্তকালীন সময়ে মাত্র এক তালাক প্রদান করা যাতে উভয়ের মিলন (সহবাস) হয়নি, অথবা গর্ভকালীন সময়ের মাঝে তালাক প্রদান করা।

এ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদান করা নিঃসন্দেহে একটি প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বেশ কিছু সময় পায়, সে সময়ে তারা চিন্তা-ভাবনা কিংবা পর্যালোচনা করতে পারে।

আর এই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদানকারীকে ঋতুমুক্তকালীন সময়ের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে; আর হতে পারে যে, তখন তার মন পরিবর্তন হবে, হৃদয় জগ্রত হবে এবং আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের জন্য নতুন কোনো উপায় করে দেবেন, ফলে তাদের সম্পর্ক তালাক পর্যন্ত গড়াবে না।

আর ইদ্দতের সময়কাল, — চাই তা মাসিক জনিত ইদ্দত হউক, অথবা নির্দিষ্ট মাসসমূহের ইদ্দত হউক, অথবা গর্ভস্থ সন্তানের প্রসব সংশ্লিষ্ট ইদ্দত হউক— এ সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও আত্মপর্যালোচনার যথেষ্ট সুযোগ থাকে; যা কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভালবাসার বন্ধন ও দাম্পত্য সম্পর্ককে মিলিয়ে দিতে পারে।

আর মুসলিমগণ যা জানে না তন্মধ্যে অন্যতম হল: স্ত্রীকে যখন রেজ‘য়ী (প্রত্যাবর্তনযোগ্য) তালাক দেওয়া হবে, তখন তার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল স্বামীর ঘরে অবস্থান করা; সে বের হবে না এবং তাকে বের করে দেওয়া হবে না।

বরং আল্লাহ তা‘আলা তাকে (স্বামীর ঘরকে) তার (স্ত্রীর) জন্য ঘর হিসেবে বরাদ্দ দিয়ে দিলেন; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ ﴾ [الطلاق: ١]

“তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না” - (সূরা আত-তালাক, আয়াত:১);

এই আয়াতটি (ঘরে) অবস্থান করার বিষয়টিকে দৃঢ়তার সাথে তাদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। সুতরাং তার স্বামীর ঘরে তার অবস্থান করার মানে তার পুনরায় প্রত্যাবর্তনের একটা পথ, ভালবাসার সহনুভূতি উত্থাপন করার ক্ষেত্রে আশার সূচনা এবং সম্মিলিত জীবনযাপনের বিষয়টি স্মরণ করানো। ফলে এই অবস্থায় তালাকের হুকুমের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অবস্থান দূরে প্রতীয়মান হলেও চোখের দৃশ্যপট থেকে তার অবস্থান স্বামীর নিকটে।

আর এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য হল তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অশান্ত ঝড়কে শান্ত করা, হৃদয়ে নাড়া দেওয়া, অবস্থানসমূহ পুণ পর্যালোচনা এবং ধীরে-সুস্থে নিজ সংসার, শিশু ও পরিবারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ লাভ। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ ... لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ ﴾ [الطلاق: ١ ]

“ ... আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন।” - ( সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১ )।

সুতরাং হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর ... এবং তোমাদের ঘর-সংসারসমূহকে হেফাযত কর; আর তোমাদের দীনের বিধানসমূহ জানতে ও বুঝতে শিখ ... আর আল্লাহর সীমারেখা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখ এবং তা লঙ্ঘন করো না; আর তোমারা তোমাদের নিজেদের মাঝে (সম্পর্কের) সংশোধন ও সংস্কার করে নাও।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দীনের ব্যাপারে সঠিক বুঝ এবং শরী‘য়তের ব্যাপারে দূরদর্শিতা দান করুন; হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার কিতাবের হিদায়াতের মাধ্যমে উপকৃত করুন; আর আপনার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আচার-আচরণ আমাদেরকে দান করুন।


[1] সুনানু ইবনে মাজাহ: ২০১৮; সহীহু ইবনে হিব্বান: ৪২৬৫


আত্মীয়তার সম্পর্ক

$
0
0

beautiful-flowers

লেখক : আখতারুজ্জান মুহাম্মাদ সুলাইমান  | সম্পাদনা : মুহাম্মদ শামসুল হক সিদ্দিক

আল্লাহ তাআলা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হচ্ছে :―

وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ. (سورة الرعد : 21)

এবং যারা বজায় রাখে ঐ সম্পর্ক, যা বজায় রাখতে আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন।[i]

তিনি নিকট আত্মীয়দের অধিকার  আদায়ে উৎসাহিত করেছেন। আল্লাহ বলেন :

 وَآَتِ ذَا الْقُرْبَى حَقَّهُ. (سورة الإسراء : 26)

আত্মীয় স্বজনকে তার হক দান কর।[ii]

আল্লাহ তাআলা হাদিসে কুদসীতে ‘সম্পর্ক’-কে লক্ষ্য করে বলেন :―

من وصلك وصلته ومن قطعك قطعته. (رواه البخاري : 5529)

যে ব্যক্তি তোমাকে ঠিক রাখবে, আমি তাকে মিলিয়ে রাখব আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে, আমি তাকে ছিন্ন করব।

আর সম্পর্ক ছিন্ন করা থেকে খুব সর্তক করেছেন এবং একে পৃথিবীতে বিঃশৃংখলা সৃষ্টি বলে সাব্যস্ত করেছেন ।

 আল্লাহ বলেন:

فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ ( محمد: 22)

ক্ষমতা লাভ করলে সম্ভবত : তোমরা পৃথিবীতে বি:শৃংখলা সৃষ্টি করবে এবং আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে । (সূরা মুহাম্মাদ: ২২)

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :―

لا يدخل الجنة قاطع. (رواه البخاري : 5525)

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।

 আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার ফজিলত :

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার অনেক ফজিলত রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু উল্লেখ করা হল।

  1. সম্পর্ক বজায় রাখা রিজিক বৃদ্ধি এবং দীর্ঘজীবী হবার কারণ এবং উভয়ের মাঝে বরকতের কারণ। আনাস রা. রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করে বলেন:

من أحب أن يبسط له فى رزقه وينسأ له فى أثره فليصل رحمه. (رواه البخاري : 5527)

যে ব্যক্তি তার রিজিক প্রশস্ত হওয়া এবং মৃত্যুর সময় পিছিয়ে দেয়া কামনা করে, তার উচিত আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা । (বুখারি: ৫৫২৭)

এ কাজ জান্নাতে প্রবেশের কারণ হবে। আবু আইয়ুব আনসারী রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, হে আল্লাহর রাসূল ! আমাকে এমন আমল বলে দিন যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। তখন রাসূল (সা) বলেন,

تعبد الله ولا تشرك به شيئاً وتقيم الصلوة وتؤتي الزكاة وتصل الرحم. (رواه البخاري : 1309)

আল্লাহর এবাদত কর, তার সাথে কোন কিছু শরিক করো না। নামাজ ভাল করে আদায় কর এবং জাকাত দাও। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রাখ।[iii]

দুনিয়া এবং আখেরাতে সৌভাগ্য এবং তাওফীক পাওয়ার কারণ হল আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা।

 সম্পর্কের স্তর :

এ সম্পর্ক বজায় রাখার কিছু স্তর রয়েছে। সর্বোচ্চ স্তর হল : জান-মাল দ্বারা সাহায্য করা। এবং কল্যাণ কামনা করা। আর সর্বন্বি স্তর হল, সালাম দেয়া। এই দুইটির মাঝখানে আরো অনেক স্তর রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করছেন:

بلوا أرحامكم ولو بالسلام.

সালাম-এর মাধ্যমে হলেও তোমরা তোমাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখ।

আর অপর দিকে এর উঁচু স্তর হল, যে তোমার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে, তুমি তার সাথে সম্পর্ক জুড়বে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

ليس الواصل بالمكافئ ولكن الواصل الذي إذا قطعت رحمه وصلها. (رواه البخاري : 5532)

সমান সমান আচরণ দ্বারা সম্পর্ক স্থাপনকারী হওয়া যায় না। কিন্তু, তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা হলে, তখনও যদি সে সম্পর্ক ঠিক রাখে, তাহলেই তাকে প্রকৃত সম্পর্ক স্থাপনকারী বলা যাবে। অর্থাৎ, আত্মীয়তার সম্পর্ক পূর্ণ বজায় রাখা তখনই হবে, যখন কোন সম্পর্ক ছিন্ন করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির সাথে সম্পর্ক জুড়ে রাখা হবে।[iv]

 সম্পর্কের সীমারেখা বা সংজ্ঞা :

আত্মীয়তার সম্পর্কের কোন নির্দিষ্ট সীমানা বা সংজ্ঞা নেই। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী তা নির্ধারিত হয়। প্রচলিত রীতি যেটাকে সম্পর্ক বজায় রাখা মনে করে সেটা ধর্তব্য। আর যেটাকে সম্পর্ক ছিন্ন করা মনে করে সেটা বর্জনীয়। আত্মীয়তার পার্থক্য ও মর্যাদা অনুযায়ী সম্পর্কের মাঝে পার্থক্য হয়ে থাকে, পিতার সম্পর্ক আর দূর সম্পর্কের চাচাত ভাইয়ের সম্পর্ক এক হয় না।

অবস্থা অনুযায়ী এ সম্পর্কের পার্থক্য ঘটে। রুগি এবং মুখাপেক্ষীর সম্পর্ক ধনী এবং সুস্থের সমান হয় না। বড়-ছোটর সম্পর্কও এক হয় না। অনুরূপভাবে স্থান অনুযায়ী সম্পর্কের মাঝে পার্থক্য ঘটে। যে দেশের মাঝে আছে আর যে দেশের বাইরে আছে, তাদের সম্পর্ক এক রকম হয় না।

সম্পর্কের নিদর্শন হল পরস্পর সাক্ষাৎ এবং অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়া, সালাম দেয়া, ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ করা, পত্র লেখা ইত্যাদি।


১. রা’দ : ২১

২. বনী ইসরাঈল : ২৬

৩. বুখারী : ১৩০৯

৪. বুখারী: ৫৫৩২

বাচ্চাদের সাথে কথা বলা

$
0
0

লেখিকাঃ রেহনুমা বিনত আনিস

 

বাচ্চারা খুব বুদ্ধিমান হয়। তাই তাদের সাথে বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিগ্রাহ্য কথা না বললে ওরা সহজেই বুঝতে পারে ওদের নির্বোধ ভাবা হচ্ছে। তখন হয় ওরা বিরক্ত হয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে নতুবা যে ওদের নির্বোধ ভেবে কথা বল্ল তার প্রতি শ্রদ্ধা। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা ওদের যে শিক্ষা দিতে আগ্রহী সে উদ্দেশ্য ব্যর্থ্ হয়। তাই আমাদের উচিত তাদের সাথে এমনভাবে কথা বলা যেন ওরা বুঝতে পারে আমরা তাদের নিজেদের সমকক্ষ ভাবছি এবং তাদের মতামতের মূল্যায়ন করছি। ওদের মোটামোটি মূল ব্যাপারটা সততা এবং আন্তরিকতার সাথে বুঝিয়ে দিলে ওরা আর খুব বেশী জানতে চায়না। বাকীটা ওরা নিজেরাই বুঝে নেয়। কিন্তু আমাদের সমাজে আমরা বাচ্চাদের সাথে সরাসরি কথা না বলে ধামাচাপা দিয়ে বা দায়সারা গোছের কথা বলে বা অনেক ক্ষেত্রে অন্য কথা বলে কথা ঘুরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলি কারণ তখন ওদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায় এবং ওরা ভুল জায়গায় তথ্য অনুসন্ধান করতে যায়।

আমরা মূলত বাচ্চাদের সাথে যেসব বিষয়ে কথা বলি তাকে কয়েকটা ক্যাটাগরীতে বিভক্ত করা যায়, যেমন- পারিবারিক সম্পর্ক, পরিচিতজনদের সাথে ব্যবহার, অপরিতচিতজনদের সাথে সাবধানতা, জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা, জীবনদর্শন, দায়িত্বসচেতনতা, চাহিদা, নিয়মনীতি এবং শাসন।

প্রথমত বাচ্চাদের কাছে পারিবারিক সম্পর্কগুলো স্পষ্টভাবে তুলে ধরা প্রয়োজন এবং এই কাঠামোতে তাদের অবস্থান তাদের কাছে পরিস্কার করে দেয়া দরকার। যেমন আমার যখন ছোটভাই হোল। একদিন সকালবেলা উঠে শুনি আমার সাড়ে ছয় বছরের রাজত্ব খতম। দাদু বলল, “তুমি তো কালো, দেখতেও সুন্দর না, এখন তোমার ফুটফুটে ফর্সা একটা ভাই হয়েছে, তোমাকে এখন আর আব্বু আম্মু ভালোবাসবে না, আমরা সবাই নতুন বাচ্চাটাকে আদর করব”। বাবামা’র বয়স এবং অভিজ্ঞতার অভাব ছিল। ওরাও ব্যাপারটাকে পাত্তা দিলনা। তদুপরি আমাকে নানীর সাথে আলাদা রুমে পাঠিয়ে দেয়া হোল। অথচ আমিই নামাজ পড়ে দোয়া করেছিলাম যেন আমার একটা ছোটভাই হয়। সেই আমার সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা! সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমার শিশুমনে প্রচন্ড আঘাত করল। ব্যাস, আর পায় কে? আহমদ বেচারা নেহাৎ ভদ্র ভালোমানুষটি বলে আমার সমস্ত অত্যাচার বছরের পর বছর মুখ বুজে সহ্য করে গিয়েছে। আজ এত বছর পর ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব মোহাম্মদের চেয়েও বেশী যদিও মোহাম্মদ আমার বারো বছরের ছোট হওয়ায় ওর প্রতি অনেকক্ষেত্রে মায়ের দায়িত্ব পালন করা হয়েছে আমার। কিন্তু আহমদের প্রতি আমার এই অত্যাচার একটু সচেতন হলেই এড়ানো যেত।

আমি যখন বুঝতে পারলাম যে রাদিয়ার ঠিক একই ব্যবধানে ভাই বা বোন হতে যাচ্ছে সাথে সাথে আমি ওকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার উদ্যোগ নিলাম। ওকে বললাম, “সাকিবের একটা বোন আছে বলে ও হিসানের সাথে খেলতে পারে, ওরা দু’জন একসাথে গল্প করতে পারে। কিন্তু ওরা যখন চলে যায় তখন তো তোমার আর খেলার বা গল্প করার কেউ থাকেনা। এখন যদি আমাদের বাসায় একটা বেবী আসে তাহলে তুমি ওর সাথে খেলতে পারবে, গল্প করতে পারবে- এটা কেমন হয়?” ও বলল, “লাগবেনা, সাকিব হিসান আসলে ওদের সাথে খেলব আর নাহলে তোমার সাথেই খেলব”।

ক’দিন পর ওকে বললাম, “ধর, আল্লাহ যদি একটা বেবী পাঠিয়ে দেন তাহলে কি করব?” ও জিজ্ঞেস করল, “আল্লাহ যদি দেন তাহলে তো না বলা যাবেনা, না?” আমি বললাম, “না”। ও তখন বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে, ওকে বারান্দার পাশে যে সুপারী গাছটা আছে ওখানে রেখে দিও। তাহলে বারান্দা দিয়ে আমি ওকে খাবার দিতে পারব”। ওকে সিদ্ধান্ত নেবার সুযোগ দিয়ে আমি ওকে নিজের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী এবং দায়িত্বশীল হয়ে ওঠার ব্যবস্থা করে দিলাম।

কিছুদিন পর ওকে বললাম, “বৃষ্টি পড়লে তো বেবীটা ভিজে যাবে তখন কি করবে?” রাদিয়া চিন্তা ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নিল যে বেবীটাকে সুপারী গাছ থেকে ট্রান্সফার করে বারান্দায় রাখলে খুব বেশী সমস্যা নেই। এ’সময় আমার প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট দেখা দিল। ও জিজ্ঞেস করলে বুঝিয়ে বললাম, “বেবীটাকে আল্লাহ বলেছেন বড় হওয়া পর্যন্ত কিছুদিন আম্মুর ভিতরে থাকতে। কিন্তু বেবীটা ভীষণ দুষ্ট। শুধু লাফালাফি করে আর আম্মু নিশ্বাস নিতে পারিনা”। সে সাথে সাথে বড়বোনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেল, “অ্যাই বেবী, এত দুষ্টুমী করবেনা। শোন, আমি তোমাকে গান শোনাই, তুমি ঘুমাও। খবরদার আম্মুকে জ্বালাবেনা!”

এভাবে আস্তে আস্তে সে একজন অদেখা অচেনা আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে লাগল, তার আগমনের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করল যে ওকে সম্মান করবে, ওর কথা শুনবে, ওর সাথে খেলবে, গল্প করবে। রিহাম আসার কিছুদিন আগে সে ঘোষনা দিল, “বেবীকে ঘরের ভেতরে রাখা যাবে যদি বেবী আব্বুর সাথে ঘুমায়। আমি তোমার পাশেই ঘুমাব”। এই শর্তে রিহামকে ঘরে আনা হোল।

ঘরে আনার পর আম্মা একটু দাদীসুলভ হা-হুতাশ শুরু করতে চেয়েছিলেন, “আহা! রাদিয়ার তো আর আদর নাই!” সেই প্রথম আমি আম্মাকে কড়া করে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, “আম্মা, এই বাচ্চা নিয়ে আমি কি কষ্ট করেছি আপনি দেখেছেন। দুইমাস বয়সের বাচ্চা নিয়ে আমি চাকরী করতে গিয়েছি। বুয়া ছিলনা, দিনরাত বাচ্চা নিয়ে চাকরী করে ঘরে এসেও বাচ্চা নিয়েই থাকতাম। আর আপনি যদি আজকে ওকে বুঝাতে আসেন যে ওকে ওর মা ভালোবাসেনা, আপনার সাথে আমার বিশাল সমস্যা হয়ে যাবে। আমি যেন কাউকে রাদিয়ার সাথে এ’ধরণের কথা বলতে না শুনি”।রাদিয়াকে বুঝিয়ে বললাম, “এটা তোমার বেবী, সুতরাং ওকে দেখাশোনা, শাসন করার দায়িত্ব তোমার”। সেও তখন খুশী হয়ে ভাইকে আপন করে নিল। এটা ছিল আমার এ’যাবৎকালের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ যেহেতু আমি চাইনি আমার মেয়ে সেরকম অসহায় বোধ করুক যা আমাকে আমার ভাইকে বন্ধু ভাবার পরিবর্তে শত্রু ভাবতে শিখিয়েছিল।

আমি যেহেতু চাকরী করতাম, আমি জানতাম আমার পক্ষে আমার কোন সন্তানকেই সার্বক্ষণিক চোখে চোখে রাখা সম্ভব হবেনা। তাই ওদের ছোটবেলা থেকেই আমি বাগানে নিয়ে যেতাম। দেখাতাম মানুষের নানামুখী আচরণ। কেউ কেউ সুন্দর ফুল দেখলে প্রশংসাসূচক কিছু বলে চলে যান, কেউ একটু গন্ধ শুঁকে দেখেন, কেউ একটু ছুঁয়ে দেখেন, কেউ ফুলটাকে গাছ থেকে ছিঁড়ে ফেলেন, আর কেউ কেউ নির্দয়ভাবে ফুলটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে আনন্দ উপভোগ করেন। আমি তাদের শেখালাম কেউ তাদের আন্তরিকভাবে ভালোবাসবে, কেউ আদর করবে কিন্তু তাতে স্বার্থের গন্ধ থাকবে, কেউ তাদের ভালোবাসবেনা আর কেউ তাদের ক্ষতি করতে চাইবে। সুতরাং তাদের মেনে নিতে হবে যে পৃথিবীতে সবাই ভালো হয়না, সবাই খারাপও হয়না। কিন্তু যতদিন জানা না যায় কে কেমন ততদিন নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ইনোসেন্স খুব ভালো জিনিস, কিন্তু এই ইনোসেন্স যদি কাউকে সহজ শিকারে পরিণত করে তাহলে তার কোন মূল্য নেই। একটা কার্টুনে ভারী মূল্যবান কথা শুনেছিলাম, পরে Platoon ছবিটিতে একই কথার পুণরাবৃত্তি শুনেছিলাম, “The first victim of war is innocence”. আপনি ততদিনই নিষ্পাপ হওয়া পোষাতে পারেন যতদিন এটা আপনার নিরাপত্তার পরিপন্থি না হয়। আজকের যুগে শিশুদের ভুলিয়ে রেখে নিরাপদ রাখা আর সম্ভব নয়। সুতরাং তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তাদের নিজেদেরই সচেতন করে তুলতে হবে। এক বান্ধবী বলেছিলেন ওনার মা ওনাকে ছোটবেলা থেকেই এই ধারণা দিয়ে বড় করেছেন যে শ্বাশুড়ীরা মায়ের মতই বৌদের আপন করে নেয়, বৌ আসার সাথে সাথে নিজের আঁচল থেকে চাবি খুলে বৌকে তুলে দেয়। তাই তিনি যখন শ্বশুরবাড়ী গিয়ে দেখলেন যে শ্বাশুড়ী মারমুখী তিনি কিছুতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলেন না যে কি হোল এবং আদৌ সংসার করবেন কি’না ভেবেই তিনি অনেকখানি সময় ব্যায় করেছেন যা হয়ত আরো ফলপ্রসুভাবে কাজে লাগানো যেত। ছেলেমেয়েদের বোঝানো উচিত যে ভালো আত্মীয়স্বজন পাওয়া গেলে ভালো নতুবা যে যেমন তাকে সেভাবেই মেনে নিতে হবে। তাঁরা আমাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করুন বা না করুন বা যেমন আচরণই করুন, আমরা নিজেদের আচরণ এবং কাজগুলোই মূল্যায়ন করে নির্ণয় করার চেষ্টা করব যে আমরা কতটুকু ভালো বা খারাপ। তাহলে আর কারো অন্যায় আমাদের মানবসত্ত্বা থেকে আমাদের বিচ্যূত করতে পারবেনা।

সময় পেলেই আমাদের সন্তানদের সাথে বিবিধ জ্ঞানবিজ্ঞানবিষয়ক কথাবার্তা বলা উচিত যেন তারা চিন্তার খোরাক পায় এবং আজেবাজে বিষয় বা সময় নষ্ট করার মত ব্যাপারগুলো থেকে তাদের বিরত রাখা যায়। এই আলোচনার ফাঁকেফাঁকে তাদের বয়ঃসন্ধিক্ষণে যেসব পরিবর্তন আসবে তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করা উচিত যেন তারা ঘাবড়ে না যায়, যেন তারা বুঝতে পারে কেন যেই ছেলে বা মেয়েটির সাথে কাল পর্যন্ত খেলা দোষণীয় ছিলোনা তার পাশে বসা যাবেনা বা তার সাথে কথাবার্তায় সংযত হতে হবে, তারা যখন পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা শুরু করবে তখন সে যেন বাবামায়ের সাথে এ’ব্যাপারে সরাসরি কথা বলতে পারে এবং তাদের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নেয়ার সুযোগ পায় এই পথ খোলা রাখা খুব জরুরী। কারণ আমি প্রায়ই ছেলেমেয়েদের দেখেছি এসব ব্যাপারে বন্ধুবান্ধবের সাথে আলাপ পরামর্শ করতে, বলাইবাহুল্য এই বন্ধুর জানার বা ভাবার পরিধি বাবামায়ের সমকক্ষ নয় সুতরাং আমার সন্তান ভুলপথে পরিচালিত হতে পারে যদি না আমি তার সাথে এ’ব্যাপারে খোলাখুলি কথা বলি, তাকে বোঝাই এই আকর্ষণ অস্বাভাবিক নয় তবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সঠিক সময় এবং সঠিক মানুষটিকে না পাওয়া পর্যন্ত।

আমার বিয়ের পর আমি দেখে অবাক হয়ে গেলাম যে আম্মা প্রতিদিন ফজরের সময় এতবড় ছেলেকে নামাজ পড়ার জন্য ডাকতে আসেন, যে ছেলেকে উনি নিজেই আলিম বানিয়েছেন! তার কিছুদিন পর শুরু হোল জেরা, আমি প্রতি ওয়াক্তে নামাজ পড়ি কি’না, ওনার ছেলে কোন কোন সময় ফাঁকি দেন। উনি এমনকি পুত্র এবং পুত্রবধুর সহকর্মীদের ফোন করে জিজ্ঞেস করতেন আমরা কর্মস্থলে ঠিকভাবে নামাজ পড়ি কি’না। আমার মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করত, “আম্মা, আমরা কি নামাজ আপনার জন্য পড়ি না আল্লাহর জন্য? আপনাকে ফাঁকি দেয়া কোন ব্যাপার না যেহেতু আমরা ছ’টায় বের হই রাতে অনেক সময় বারোটা সাড়ে বারোটায় ফিরি। কিন্তু নামাজ যার জন্য তাঁকে তো ফাঁকি দেয়ার কোন জায়গা নেই। তাহলে আপনি এত প্যারানয়েড হচ্ছেন কেন?” কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি।

পক্ষান্তরে আমি আমার সন্তানদের বুঝিয়ে দিয়েছি ওদের কাজের দায়িত্ব ওদের, আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতাও ওদের। ফলাফল হল, মাঝেমাঝে ওয়াক্তের কথা মনে করিয়ে দিতে হয় বটে (যেহেতু ক্যানাডায় আজান দেয়না) তবে রাদিয়া মোটামুটি নিজ দায়িত্বে নামাজ পড়ে। পর্দা করার সিদ্ধান্তও সে নিজেই নিয়েছিল যদিও আমি ওকে বলেছিলাম সে চাইলে আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে পারে কিন্তু শুরু করলে আর ছাড়তে পারবেনা যেহেতু এটা আল্লাহর নির্দেশ মানার ব্যাপার। সে আটবছর বয়সেই নিজ দায়িত্বে পর্দা শুরু করে। ওদের ছোটবেলা থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছি কোন ব্যাপারগুলো permissible এবং কোনগুলো নিষিদ্ধ, কোন কাজের কি ফলাফল। প্রতিবেশীদের কাছে শুনেছি রাদিয়া তাঁদের বাচ্চাদের বোঝায় কি করা উচিত এবং কোনটা না করা উচিত আর রিহাম তো আমার সামনেই সবার ওপর পন্ডিতি করে! ওরা অন্যায় করলে আমি ওদের ডেকে বুঝিয়ে দেই কেন তাদের বকা বা শাস্তি দেয়া হোল। কারণ আমি তাদের মারলে কোন কাজ হবেনা যদি ওরা না বোঝে ওরা ভুলটা কোথায় করল। বোঝানোর পর আমি ওদেরই জিজ্ঞেস করি ওরা শাস্তিটা সঠিক মনে করে কি’না। এতে করে তারা নিজেরদের কাজের দায়দায়িত্ব নেয়ার ব্যাপারে সচেতন হয়।

আমি বাচ্চাদের বাসার সব কাজে জড়িত করার চেষ্টা করি যেন ওরা অনুভব করে এটা ওদের বাসা এবং এখানে সবার প্রতি এবং সবকিছুর প্রতি ওদের দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব ছাড়া leadership qualities গড়ে তোলা কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমার বাবা বলত প্রত্যেক ব্যক্তির, সে হোক ছেলে বা মেয়ে, সবধরণের কাজ করার অভ্যাস এবং অভিজ্ঞতা থাকা দরকার। আমার এস এস সি পরীক্ষার পর তিনমাসের ছুটিতে বাবা আমাকে রান্না আর কম্পিউটার রপ্ত করার জন্য বসিয়ে দিল। বাংলাদেশে এসে ঘরের renovation চলাকালীন সময় বাবা এবং মিস্ত্রীদের সাথে থেকে প্ল্যানিং, কন্সট্রাকশনের কাজ, ফার্নিচার বানানোর কাজ, ঘরবাড়ী এবং কাঠের জিনিস রঙ করা, একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা- এসব ব্যাপারে অংশগ্রহণ এবং সহযোগিতা করতে গিয়ে শেখা হয়েছে অনেক কিছু যা পরে কাজে লেগেছে। তাই আমিও আমার মেয়েকে সব কাজ করতে দেই যেন আমাকে ফ্যাশনমাফিক বলতে না হয়, “আমার বাচ্চারা তো কিছু পারেনা!” পারবেনা কেন? প্রথমে ভুল করবে, কিছু জিনিস নষ্ট করবে, খুব বেশী সুন্দর হয়ত হবেনা- তারপর একসময় ঠিকই পারবে। কিন্তু পারেনা পারেনা করে করতে না দিলে তো সে কখনোই শিখবেনা! তাছাড়া সবাই মিলে কাজ করতে করতেই তো সে শিখবে বাবামায়ের প্রতি সহানুভূতি, ভাইবোনদের প্রতি দায়িত্ব, পারিবারিক মায়ামমতা এবং সবাই মিলে কিছু শেয়ার করার আনন্দ!

আজকাল এটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে যে বাবামা মনে করেন বাচ্চাদের বাসায় কোন দায়িত্ব দেয়া মানে তাদের প্রতি অবিচার করা। তাঁরা সবাইকে এত বেশী স্বাধীনতা দেন যে ভাইবোন পর্যন্ত একজন আরেকজনের সাথে কিছু ভাগাভাগি করতে রাজী হয়না, পরস্পরের প্রতি কোন দায়িত্ব বা সহানুভূতি অনুভব করার প্রয়োজন মনে করেনা। কিন্তু বাচ্চাদের সাথে কথা বলার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কেনাকাটার ক্ষেত্রে সংযম। আজকাল দেখা যায় আমরা বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় সব জিনিসই দেই যেন “চাহিবামাত্র দিতে বাধ্য থাকিবে”। কিন্তু একটা বাচ্চা কিছু চাইলে তার সাথে আলাপ করা দরকার সে এটা কেন চায়, এটা দিয়ে সে কি করবে, এর উপকারীতা ও অপকারিতাগুলো কি কি, জিনিসটি আদৌ তার প্রয়োজন আছে কি’না এবং এই টাকায় সে আর কি করতে পারে। এতে করে ওরা স্বার্থপর হবার পরিবর্তে needs এবং wants এর মধ্যে তফাত করতে শিখবে, অন্যের প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের ওপর অগ্রাধিকার দিতে শিখবে। সর্বোপরি আমি তাদের মৃত্যু সম্পর্কে বলি যেন তারা বুঝতে পারে যে এই জীবনের মূল্য কেবল পরবর্তী জীবনের পাথেয় সঞ্চয়ের জন্যই, সুতরাং এখানে সব পেয়ে যেতে হবে বা না পেলে হতাশ হতে হবে এই ধারণা তাদের স্পর্শ করেনা।

তবে কথা বলার সবচেয়ে বড় দিক হোল শোনা। আমাদের সন্তানেরা কি বলতে চায়, কি জানতে চায়, তাদের মনে কি প্রশ্ন তা আমাদের শুনতে হবে, জানতে হবে এবং যে শিশুটির স্বভাব যেমন সেভাবেই তার সাথে কথা বলতে হবে। যেমন বাবা আমাকে ডাকত “রেহনুমা বিনত ত্যাড়া”। আমাকে সুন্দর করে বললে আমি তার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত। কিন্তু কেউ আমার দিকে একটু বাঁকা করে তাকালো তো সব শেষ। আমার এই স্বভাব না বোঝার কারণে মা’র সাথে আমার অপূরণীয় দুরত্বের সৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। আমি আমার দুই সন্তানের মধ্যেই দেখি রাদিয়া ওর বাবা আর বড়মামার মত নিয়ম মেনে চলা, অনুগত, ভালো মানুষ। কিন্তু রিহাম আমার মতই উচ্ছৃংখল, ত্যাড়া। সুতরাং রাদিয়াকে বোঝানো অনেক সহজ ওর কাছে আমাদের আশা-আকাংখা কি। কিন্তু রিহামকে পাম্প দিয়ে বলতে হয়, “যদি তুমি অমুক কাজটা কর তাহলে তোমাকে আম্মু স্পেশাল আদর করব আর যদি তমুক কাজটা কর তাহলে আম্মু আর তোমার সাথে কথা বলবনা”।

সুতরাং বাচ্চাদের সাথে কথা বলার জন্য সময় ব্যায় করতে হবে, আগে থেকে স্ক্রিপ্ট তৈরী করে বসতে হবে যেন একটা শব্দও এদিক ওদিক না হয়, যেন ওদের সমস্ত প্রশ্নের জবাব প্রস্তুত থাকে আর প্রস্তুত না থাকলে যেন আমরা সৎসাহস নিয়ে বলতে পারি, “আমি পরে জেনে তোমাকে জানাব”, ওরা যেন অবহেলিত বোধ না করে এবং সবচেয়ে বড় কথা এই কথাবার্তার মাধ্যমে যেন ওরা অনুভব করে যে ওরা ব্যাপারগুলো স্পষ্ট বুঝতে পারছে এবং ওদের বাবামা ওদের ভালোবাসে বলেই এই কথাগুলো ওদের বলা হচ্ছে।

(সংগৃহীত)

 মূল লেখাটির লিঙ্ক  

প্রতিবেশীর অধিকার ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব

$
0
0

আমরা আজ যে সমাজ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত তাতে আমাদের অনুভূতিগুলোও দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে অবিশ্বাস আর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখাই যেন আজকালকার যুগের সবার চিন্তাধারার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইট পাথরের দালানে থাকা আমরাও যেন অনুভূতিহীন কলের পুতুল। পাশের দরজার প্রতিবেশীর বিপদে আপদে, তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হওয়া তো আজকাল দুরের কথা, কেউ কাউকে চিনিই না অনেক সময়। এরপরও কি আমরা দাবী করতে পারি আমরা সত্যিকারের মুসলমান? আসুন দেখি প্রতিবেশীদের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসুল আমাদেরকে কি বলেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا

অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোন কিছুকে তাঁর অংশী করো না, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। ( সূরা নিসা: ৩৬)

এই সম্পর্কিত হাদিস সমূহ-

১) ইবনে উমার ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জিব্রাইল আমাকে সব সময় প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করে থাকেন। এমনকি আমার মনে হল যে, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারেস বানিয়ে দেবেন।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৪ ও মুসলিম ২৬২৪)

২) আবূ যার (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “হে আবূ যার! যখন তুমি ঝোল (ওয়ালা তরকারি) রান্না করবে, তখন তাতে পানির পরিমান বেশী কর। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর বাড়িতে রীতিমত পৌছে দাও। (মুসলিম ২৬২৫)

৩) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়।” জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন ব্যক্তি? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৬)

৪) মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে  থাকে না। উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, হে মুসলিম মহিলাগণ! কোন প্রতিবেশিনী যেন তার অপর প্রতিবেশিনীর উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে না করে; যদিও তা ছাগলের পায়ের ক্ষুর হক না কেন। (সহীহুল বুখারী ২৫৬৬ ও মুসলিম ১০৩০)

৫) উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীকে তার দেওয়ালে কাঠ (বাঁশ ইত্যাদি) গাড়তে নিষেধ না করে। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বললেন, কী ব্যাপার আমি তোমাদেরকে রসূল (সাঃ)-এর সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরাতে দেখছি! আল্লাহর কসম! নিশ্চয় আমি এ (সুন্নাহ)কে তোমাদের ঘাড়ে নিক্ষেপ করব (অর্থাৎ এ কথা বলতে থাকব)। (সহীহুল বুখারী ২৪৬৩,৫৬২৭ ও মুসলিম ১৬০৯)

৬) উক্ত রাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহেমানের খাতির করে। এবং যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, নচেৎ চুপ থাকে।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৮,৩৩৩১, মুসলিম ৪৭, ১৪৬৮)

৭) আবূ শুরায়হ খু্যায়ী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার কর। যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহেমানের খাতির করে। এবং যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা নীরব থাকে।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৯,৬১৩৫, মুসলিম ৪৮)

৮) আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, “হে আল্লাহর রসূল! আমার দু’জন প্রতিবেশী আছে।(যদি দু’জনকেই দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে) আমি তাঁদের মধ্যে কার নিকট হাদিয়া (উপঢৌকন) পাঠাব?’ তিনি বললেন, “যার দরজা তোমার বেশী নিকটবর্তী, তার কাছে (পাঠাও)।” (সহীহুল বুখারী ৬০২০,২২৫৯, আবূ দাউদ ৫১৫৫)

৯) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর নিকট সর্ব উওম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উওম। আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশী সর্ব উওম, যে তার প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে সর্বাধিক উওম।” (তিরমিযী ১৯৪৪, আহমাদ ৬৫৩০, দারেমী ২৪৩৭)

এখনো কি আমরা আমাদের প্রতিবেশীর ভালমন্দের খবর নেব না?

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার

$
0
0

অনুবাদ ও গ্রন্থনা: আব্দুল্লাহিল হাদী

.

দীর্ঘ দিন সীমাহীন কষ্ট ও অবর্ণনীয় যাতনা সহ্য করে মা সন্তানকে গর্ভে ধারণ করেন। মায়ের পেটে সন্তান যতই বৃদ্ধি পেতে থাকে তার কষ্টের মাত্রা ততই বাড়তে থাকে। মৃত্যু যন্ত্রনা পার হয়ে যখন সন্তান ভূমিষ্ট হয় তখন এ নবজাতককে ঘিরে মায়ের সব প্রত্যশা এবং স্বপ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে। এই নবজাতকের ভিতর সে দেখতে পায় জীবনের সব রূপ এবং সৌন্দর্য। যার ফলে দুনিয়ার প্রতি তার আগ্রহ এবং সম্পর্ক আরো গভীরতর হয়। পরম আদর-যত্নে সে শিশুর প্রতিপালনে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। নিজের শরীরের নির্যাস দিয়ে তার খাবারের ব্যাবস্থা করে। নিজে কষ্ট করে তাকে সুখ দেয়। নিজে ক্ষুর্ধাত থেকে তাকে খাওয়ায়। নিজে নির্ঘূম রাত কাটায় সন্তানের ঘুমের জন্য। মা পরম আদর আর সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে সন্তানকে ঘিরে রাখে সর্বক্ষণ। সন্তান কোথাও গেলে আল্লাহর নিকট দুআ করে যেন তার সন্তান নিরাপদে ঘরে ফিরে আসে। সন্তানও যে কোন বিপদে ছুটে আসে মায়ের কোলে। পরম নির্ভরতায় ভরে থাকে তার বুক। যত বিপদই আসুক না কেন মা যদি বুকের সাথে চেপে ধরে কিংবা স্নেহ মাখা দৃষ্টিতে একবার তাকায় তাহলে সব কষ্ট যেন নিমিষেই উধাও হয়ে যায়। এই হল মা।

.
 আর পিতা? তাকে তো সন্তানের মুখে এক লোকমা আহার তুলে দেয়ার জন্য করতে হয় অক্লান্ত পরিশ্রম। মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হয়। সহ্য করতে হয় কতধরণের কষ্ট এবং ক্লেশ। সন্তানের জন্যই তো তাকে কখনো কখনো কৃপনতা করতে হয়। কখনো বা ভীরুতার পরিচয় দিতে হয়। সন্তান কাছে গেলে হাঁসি মুখে তাকে বুকে টেনে নেয়। তার নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য সে যে কোন ধরণের বিপদের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে। ইত্যাদি কারণে আমাদের অস্তিত্বের প্রতিটি কোণা পিতা-মাতার নিকট ঋণী। আর তাই তো আল কুরআনে আল্লাহ তা’আলার ইবাদতের পরই পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণ করার কথা উচ্চারিত হয়েছে বার বার। ইরশাদ হচ্ছেঃ

 .

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً إِمَّا يَبْلُغَنَّ عِنْدَكَ الْكِبَرَ أَحَدُهُمَا أَوْ كِلاهُمَا فَلا تَقُلْ لَهُمَا أُفٍّ وَلا تَنْهَرْهُمَا وَقُلْ لَهُمَا قَوْلاً كَرِيماً

“তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত করবে না এবং পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করবে; তাদের একজন অথবা উভয়ে উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলেও আদেরকে বিরক্তি সূচক কিছু বলো না। এবং তাদেরকে ভর্র্ৎসনা করো না; তাদের সাথে কথা বলো সম্মান সূচক নম্র কথা।” (সূরা বনী ইসরাঈলঃ ২৩)

.

আল কুরআনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার, প্রখ্যাত সাহাবী অবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রাঃ) বলেনঃ আল কুরআনে এমন তিনটি আয়াত আছে যেখানে তিনটি জিনিস তিনটি জিনিসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। একটি ছাড়া অন্যটি অগ্রহণযোগ্য।সে তিনটি আয়াত হলঃ

১) আল্লাহ তাআলা বলেন,

হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর এবং আনুগত্য কর তার রাসূলের। এবং (তাদের বিরুদ্ধাচারণ করে) নিজেদের আমল বিনষ্ট কর না। (সূরা মুহাম্মাদ: ৩৩)

কেউ যদি আল্লাহর আনুগত্য করে কিন্তু রাসূলের আনুগত্য না করে তাহলে তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।

.

২) আল্লাহ তায়ালা বলেন,

এবং তোমরা সালাত (নামায) আদায় কর এবং যাকাত দাও। (সূরা বাক্বারাঃ ৪৩)

কেউ যদি নামায পড়ে কিন্তু যাকাত দিতে রাজী নয় তাহলে তাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণীয় নয়।

.
৩) আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ

“আমার কৃতজ্ঞতা এবং তোমার পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় কর।” (সূরা লোকমানঃ ১৪)

কেউ যদি আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করে কিন্তু পিতা-মাতার কৃতজ্ঞতা আদায় না করে তবে তা আল্লাহর নিকট প্রত্যাখ্যাত।

.

সে কারণেই মহাগ্রন্থ আল কুরআনে একাধিকবার আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশের সাথে সাথে পিতা-মাতার আনুগত্য করার প্রতি নির্দেশ এসেছে। ধ্বনীত হয়েছে তাদের সাথে খারাপ আচরণ করার প্রতি কঠিন হুশিয়ারী। তা যে কোন কারণেই হোক না কেন। ইরশাদ হচ্ছেঃ

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئاً وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَاناً

“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। এবং তার সাথে কাউকে শরীক কর না আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর।” (সূরা নিসাঃ ৩৬)

.

আল্লাহ তাআলা আরো ইরশাদ করেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حُسْناً

“আমি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছি তার পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে।” (সূরা আনকাবূতঃ ৮)

.

তিনি আরও বলেনঃ

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ حَمَلَتْهُ أُمُّهُ وَهْناً عَلَى وَهْنٍ وَفِصَالُهُ فِي عَامَيْنِ أَنِ اشْكُرْ لِي وَلِوَالِدَيْكَ إِلَيَّ الْمَصِيرُ

“আর আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) কষ্টের পর কষ্ট বরণ করে গর্ভে ধারণ করে এবং তার দুধ ছাড়ানো হয় দুই বছরে। সুতরাং আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। প্রত্যাবর্তন তো আমারই নিকট।” (সূরা লোকমানঃ ১৪)

উল্লেখিত আয়াতগুলোতে স্পষ্টভাবে পিতা-মাতার মর্যাদা এবং তাদের প্রতি সন্তানদের অধিকারের প্রমাণ বহন করছে।

.
প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হাদীস থেকেঃ নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর হাদীস থেকেও এ ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়ঃ

 

১) পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টিঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ

“পিতা-মাতার সন্তুষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি আর পিতা-মাতার অসন্তষ্টির উপরই আল্লাহর সন্তুষ্টি নির্ভর করছে।” (ত্ববারানী কাবীর-সহীহ)

.

২) ফিরে যাওতাদের মুখে হাঁসি ফোটাওঃ আবদুল্লাহ ইবন আমর ইবন আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, জনৈক সাহাবী নবী করীম (সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বললেন, আমি আপনার কাছে এসেছি হিজরত করার জন্য শপথ করতে। আমি যখন আসি আমার পিতা-মাতা কাঁদছিলেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন,

“তাদের কাছে ফিরে যাও, এবং যেমন তাদেরকে কাঁদিয়েছিলে এখন তাদেরকে গিয়ে হাঁসাও।” (আবু দাউদ, নাসাঈ,ইবন মাজাহ-সহীহ)

.

৩) তার পা ধরওখানেই তোমার জান্নাতঃ মুয়া’বিয়া ইবন জাহাম সুহামী নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে জিহাদে যাওয়ার অনুমতি চাইলে তিনি তাকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বললেন,

“যাও, তোমার আম্মার সেবা কর।” কিন্তু তিনি জিহাদে যাওয়ার জন্য বার বার অনুরোধ জানাতে থাকলে তিনি বললেন, “হায় আফসোস! তোমার মার পা ধরে থাক। ওখানেই তোমার জান্নাত।” (মুসনাদ আহমাদও ইবন মাজাহ্)

.

৪) পিতার তুলনায় মার অধিকার তিনগুণ বেশীঃ সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী সাহাবী আবূ হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত,

একলোক রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকট এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল, আমার উত্তম সংস্রব পাওয়ার জন্য কে সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত? তিনি বললেন, তোমার মা।” লোকটি আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার মা।” সে আবার প্রশ্ন করল, তারপর কে? তিনি বললেন, “তোমার পিতা।” (বুখারী-মুসলিম)

অত্র হাদীস প্রমাণ বহন করে, পিতার তুলনায় মা তিনগুণ সদাচারণ পাওয়ার অধিকারী। কারণ, গর্ভে ধারণ, ভুমিষ্ট ও দুগ্ধদানের ক্ষেত্রে কেবল মাকেই অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয়। পিতা কেবল সন্তান প্রতিপালনে স্ত্রীর সাথে অংশ গ্রহণ করে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ ত।আলা ইরশাদ করেনঃ

.

وَوَصَّيْنَا الْأِنْسَانَ بِوَالِدَيْهِ إِحْسَاناً حَمَلَتْهُ أُمُّهُ كُرْهاً وَوَضَعَتْهُ كُرْهاً وَحَمْلُهُ وَفِصَالُهُ ثَلاثُونَ شَهْراً

 “আমি তো মানুষকে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারণের নির্দেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে (সন্তানকে) গর্ভে ধারণ করেছে কষ্টের সাথে এবং প্রসব করেছে কষ্টের সাথে। তাকে গর্ভে ধারতে ও তার স্তন ছাড়াতে সময় লাগে ত্রিশ মাস।” (আহক্বাফঃ ১৫)

 .

৫) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তানের প্রতি আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাকাবেন নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোকের প্রতি আল্লাহ তা’আলা তাকাবেন না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

.

৬) পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান জান্নাতে প্রবেশ করবে নাঃ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেনঃ

তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে প্রবেশ করবে না। তাদের মধ্যে একজন হল, পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান। (সহীহ-নাসঈ, আহমাদ, হাকেম)

৭) তবুও অবাধ্যতা নয়ঃ মু’য়ায (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,

রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে দশটি বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তা হলো, আল্লাহর সাথে শিরক করবে না যদিও তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয় এবং আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়া হয়। এবং পিতা-মাতার অবাধ্য হবে না যদিও তারা তোমাকে তোমার পরিবার, এবং সম্পদ ছেড়ে চলে যেতে বলে…(মুসনাদ আহমাদ)

 

 নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এবং তাঁর মাঃ

পিতা-মাতার সাথে কিরূপ আচরণ করতে হবে সে ব্যাপারে ইতি পূর্বে প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর একাধিক হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। এখন দেখব নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তার মা-জননীর প্রতি বাস্তব জীবনে আমাদের জন্য কী আদর্শ রেখে গেছেন।

সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে,

হুদায়বিয়া সন্ধির সময় প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহাবীদের সাথে নিয়ে যাচ্ছিলেন। সাথে আছে এক হাযার ঘোড় সাওয়ার। মক্কা ও মদীনার মাঝে আবওয়া নামক স্থানে তাঁর প্রাণ প্রিয় মা-জননী চির নিদ্রায় শায়িত আছেন। সে পথ দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি যাত্রা বিরতী করে তাঁর মা’র কবর যিয়ারত করতে গেলেন। কবরের কাছে গিয়ে তিনিকাঁন্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তার চর্তুদিকে দাঁড়িয়ে থাকা সাহাবীগণও কাঁদতে লাগলেন। অতঃপর তিনি বললেন, আমি আল্লাহর দরবারে আমার মা’র জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার অনুমতি চেয়েছিলাম কিন্তু অনুমতি দেয়া হয়নি। কিন্তু তার কবর যিয়ারতের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করলে তিনি তাতে অনুমতি দেন। সুতরাং তোমরা কবর যিয়ারত কর। কারণ, কবর যিয়ারত করলে পরকালের কথা স্মরণ হয়।”(সহীহ মুসলিম)

.

ইবরাহীম (আঃ) এবং তার পিতা-মাতাঃ

ইবরাহীম (আঃ) এর পিতা-মাতা কাফের ছিল। তারপরও তিনি তাদের সাথে অত্যন্ত- বিনয় ও ভদ্রতা সুলোভ আচরণ করতেন। তিনি তার পিতাকে শিরক পরিত্যাগ করে এক আল্লাহর ইবাদত করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছেনঃ

.

يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لا يَسْمَعُ وَلا يُبْصِرُ وَلا يُغْنِي عَنْكَ شَيْئاً

আব্বাজান, আপনি কেন এমন জিনিসের ইবাদত করছেন যা শুনে না, দেখে না এবং আপনার কোন উপকারও করতে পারে না? কিন্তু সে তা শুধু প্রত্যাখ্যানই করল না বরং তাকে মেরে-পিটে তাড়িয়ে দেয়ার হুমকি দিল। তখন তিনি শুধু এতটুকুই বলেছিলেনঃ

قَالَ سَلامٌ عَلَيْكَ سَأَسْتَغْفِرُ لَكَ رَبِّي إِنَّهُ كَانَ بِي حَفِيّاً

“আপনাকে সালাম। আমি আপনার জন্য আল্লাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করব।” (সূরা মারইয়ামঃ ৪৭)

 

ইয়াহয়া (আঃ): 

.

আল্লাহ তা’আলা তার প্রশংসা করে বলেনঃ সে তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচারী ছিল।” (সূরা মারইয়ামঃ ১৪)

 

এভাবে অনেক নবীর কথা আল কুরআনে উল্লেখ করে আল্লাহ তা’আলা বিশ্ববাসীর সামনে অনুকরণীয় আদর্শ উপস্থাপন করেছেন।

আমাদের পূর্ব পুরুষগণ পিতা-মাতার সাথে সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। এসমস্ত মহামনিষীদের মধ্যে আবু হুরাইরা (রাঃ), আবদুল্লাহ্ ইবন্ মাসঊদ (রাঃ), ইবন্ হাসান তামীমী (রহঃ), ইবন আউন মুযানী (রহঃ) প্রমুখের নাম ইতিহাসখ্যাত।

 

পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপঃ

পিতা-মাতার অবাধ্যতার বিভিন্ন রূপ হতে পারে যা হয়ত অনেক মানুষের কাছেই অজানা।

১) পিতা-মাতার উপর নিজেকে বড় মনে করা। অর্থ-সম্পদ, শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান-প্রতিপত্তিতে পিতা-মাতার চেয়ে বেশী অথবা অন্য যে কোন কারণেই হোক না কেন নিজেকে বড় বড় মনে করা।

২) পিতা-মাতাকে পিতা-মাতাকে সহায়-সম্বলহীন এবং নিঃস্ব অবস্থায় ফেলে রাখা এবং যার কারণে তারা মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পাততে বাধ্য হয়।

৩) বন্ধু-বান্ধব, স্ত্রী-পুত্র বা অন্য কাউকে, এমনকি নিজের প্রয়োজনকেও পিতা-মাতার উপর অগ্রাধিকার দেয়া তাদের নাফরমানীর অন্তর্ভূক্ত।

৪) পিতা-মাতাকে শুধু নাম ধরে বা এমন শব্দ প্রয়োগে ডাকা যা তাদের অসম্মান ও মর্যাদাহানীর ইঙ্গিত দেয়।

৫) পিতা-মাতার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে ধমকের সুরে কথা বলা।

৬) তাদের সেবা-শুশ্রূষা না করা এবং শারিরীক বা মানষিক দিকের প্রতি লক্ষ না রাখা। বিশেষ করে বৃদ্ধ বয়সে বা রোগ-ব্যাধিতে তাদের প্রতি অবহেলা প্রদর্শন করা।

 

ভিডিও লেকচারঃ

পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার সম্পর্কে নিচের ১০ মিনিটের ভিডিওটি দেখতে পারেন।

পরিশেষেঃ

 প্রতিটি জ্ঞানবান মানুষের কাছে আহ্বান জানাবো, আসুন, পিতা-মাতার ব্যাপারে অবহেলা করার ব্যাপারে সাবধান হই। তাদের প্রতি প্রর্দশন করি সর্বোচ্চ সম্মান জনক আচরণ। কারণ এর মাধ্যমেই আমাদের পার্থিব জীবন সুন্দর হবে। গুনাহ-খাতা মাফ হবে। পরকালে মিলবে চির সুখের নিবাস জান্নাত।

মহিমাময় আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানাই হে পরওয়ারদেগার, আমাদেরকে আমাদের পিতা-মাতার সাথে চির শান্তির নীড় জান্নাতে একত্রিত করিও। এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা। আমীন !

আপনার সন্তানকে অভিশাপ দেবেন না

$
0
0

Ovishap

মাত্র কয়েকদিন আগের ঘটনা। আমাদের পাড়ার আব্দুল্লাহর মা পানিতে ডুবে মরা কিশোর সন্তানটিকে বুকে জড়িয়ে পাগলপারা হয়ে কাঁদছেন। মায়ের বাঁধভাঙ্গা কান্না আর বিলাপ শুনে উপস্থিত কারো পক্ষেই চোখের পানি সংবরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তিনি কাঁদছেন আর বিলাপ করে বলছেন, ‘ও বাবুর আব্বু তুমি আমাকে মেরে ফেল। আমিই তোমার সন্তানকে হত্যা করেছি। গতকালই ওর জ্বালা সহ্য করতে না পেরে আমি বলেছি, ‘তুই মরিস না; মরলে দশটা ফকিরকে খাওয়াতাম।’

হ্যা, সত্যিই তিনি আগেরদিন ছেলেটির দুরন্তপনায় অস্থির হয়ে এমন বলেছিলেন। তখন একজন পাগলেরও ভাবার অবকাশ ছিল না যে গর্ভধারিণী মা সত্যিই তার সন্তানের অমঙ্গল কামনা করছেন। কিন্তু অসচেতনভাবে কামনা করা দুর্ঘটনাও কখনো সত্য হয়ে দেখা দিতে পারে। আব্দুল্লাহর মা গতকাল রাগের মাথায় যে কথা উচ্চারণ করেছিলেন কে জানত আজই তা বাস্তব হয়ে দেখা দেবে।

ঘটনা হলো, সেদিন দুপুরে ছেলেটি তার মায়ের সঙ্গে শুয়ে ছিল। তিনটার দিকে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে একরকম জিদ করেই সে মায়ের কাছ থেকে ছুটে গিয়েছিল বৃষ্টিতে ভিজতে। বাড়ির বাইরে এসে সে আশপাশের সমবয়সী আরও কয়েকটি কিশোরকে পেয়ে যায়। সবাই মিলে কোন বুদ্ধিতে যেন দল বেঁধে যায় পাশের মহল্লার একটি নতুন পুকুরে গোসল করতে। সেখানে গিয়ে সবার আগে সে-ই লাফ দেই পুকুরে। অবুঝ কিশোর ঠিক বুঝতে পারেনি লাফ দিলে পুকুরের প্রায় গভীরে গিয়ে পৌঁছবে সে। যেখানে সাঁতার না জানা একটি কিশোরের জন্য অপেক্ষা করছে অবধারিত মৃত্যু। ঘটনা যা হবার তাই হল। বাচ্চাগুলোর চোখের সামনেই সে পানিতে ডুবল। ওরা ভাবল সে বুঝি তাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে। কিছুক্ষণ পর তারা ওকে না পেয়ে ভয়ে আশপাশের লোকদের ডেকে আনল। ততক্ষণে অবশ্য তার ক্ষুদেকায় দেহ থেকে প্রাণপাখি উড়াল দিয়েছে।

মা তার সন্তানকে অবর্ণনীয় কষ্টে গর্ভে ধারণ করেন। অমানুষিক কষ্টে পৃথিবীর আলো-বাতাসে আনেন। তারপর নিজের ভালোবাসা আর ত্যাগের সবটুকু উজাড় করে অসহায় একটি শিশুকে যথাক্রমে সুস্থ, সবল, সজ্ঞান ও স্বাবলম্বী করে তোলেন। সন্তান মানুষ করতে গিয়ে বাবা-মাকে যে কতটুকু কষ্ট সহ্য করতে হয় তা শুধু বাবা-মায়েরাই জানেন। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে এ কষ্ট আরও বেশি। এখানে রোজ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে লড়াই করে মানুষকে টিকে থাকতে হয়।

অভাবের কারণে একজন নবীন মাকেও একহাতে সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব আর অপরহাতে বুকের ধন সন্তানটিকে আগলাতে হয়। অনেক মা আছেন যারা সময়মত বাচ্চার খাবারটিও যোগাতে পারেন না রুচিমত। বিশেষত যেসব বাচ্চা জন্মের পর মায়ের বুকের দুধ পায় না। দরিদ্র পরিবারে এসব শিশুকে যে কত কষ্টে মা জননী বড় করে তোলেন তা একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। এ সময় মায়েদের অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রয়োজন হয়।

অথচ প্রগলভ চরিত্রের অনেক মা’কে এ সময় ধৈর্যহারাও হতে দেখা যায়। অনেক মা সন্তানের ওপর বিরক্ত হয়ে তাকে অবলীলায় অভিশাপ দিয়ে দিয়ে বসেন। স্নেহময়ী জননী হয়তো তার জীবনের বিনিময়ে হলেও সন্তানের যে কোনো অনিষ্ট রোধ করতে চাইবেন। কিন্তু তিনিই আবার রাগের মাথায় অবচেতনে আদরের সন্তানটির অনিষ্ট কামনা করে বসেন। গ্রাম-বাংলায় প্রায়ই দেখা যায় সন্তানদের দুরন্তপনা বা দুষ্টুমিতে নাকাল হয়ে অনেক মা সরাসরি বাচ্চার মৃত্যু কামনা করে বসেন। ‘তুই মরিস না’, ‘তুই মরলে ফকিররে একবেলা ভরপেট খাওয়াতাম’, ‘আল্লাহ, আমি আর পারিনে’, ‘এর জ্বালা থেকে আমাকে নিস্তার দাও’- এ জাতীয় বাক্য আমরা অহরহই শুনতে পাই। বিশেষত কৈশোরে এসে গ্রাম-বাংলার শিশুদের দুরন্তপনা কখনো সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। ফলে কিশোর সন্তানকে উদ্দেশ করেই সাধারণত মায়েরা এমন অসহিষ্ণু বাক্যোচ্চারণ করে থাকেন। তাই এ সময় মাকে অনেক বেশি ত্যাগ ও ধৈর্যের পারাকাষ্ঠা দেখাতে হয়।

ইসলামের সার্বজনীন আদর্শের ধারাবাহিকতায় এ বিষয়টি সম্পর্কেও আমরা দিকনির্দেশনা পাই তারই কাছে। এ ব্যাপারেও ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়। ইসলাম কখনো কারো বিরুদ্ধে অভিশাপ দেয়া বা বদ দু‘আ করাকে সমর্থন করে না। আপন সন্তানকে তো দূরের কথা জীবজন্তু এমনকি জড় পদার্থকে অভিশাপ দেয়াও সমর্থন করে না। জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

سِرْنَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فِى غَزْوَةِ بَطْنِ بُوَاطٍ وَهُوَ يَطْلُبُ الْمَجْدِىَّ بْنَ عَمْرٍو الْجُهَنِىَّ وَكَانَ النَّاضِحُ يَعْتَقِبُهُ مِنَّا الْخَمْسَةُ وَالسِّتَّةُ وَالسَّبْعَةُ فَدَارَتْ عُقْبَةُ رَجُلٍ مِنَ الأَنْصَارِ عَلَى نَاضِحٍ لَهُ فَأَنَاخَهُ فَرَكِبَهُ ثُمَّ بَعَثَهُ فَتَلَدَّنَ عَلَيْهِ بَعْضَ التَّلَدُّنِ فَقَالَ لَهُ شَأْ لَعَنَكَ اللَّهُ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- « مَنْ هَذَا اللاَّعِنُ بَعِيرَهُ ». قَالَ أَنَا يَا رَسُولَ اللَّهِ . قَالَ « انْزِلْ عَنْهُ فَلاَ تَصْحَبْنَا بِمَلْعُونٍ لاَ تَدْعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَوْلاَدِكُمْ وَلاَ تَدْعُوا عَلَى أَمْوَالِكُمْ لاَ تُوَافِقُوا مِنَ اللَّهِ سَاعَةً يُسْأَلُ فِيهَا عَطَاءٌ فَيَسْتَجِيبُ لَكُمْ ».

বাতনে বুওয়াত যুদ্ধের সফরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে পথ চলছিলাম। তিনি মাজদী ইবন ‘আমর জুহানীকে খুঁজছিলেন। পানি বহনকারী উটগুলোর পেছনে আমাদের মধ্য থেকে পাঁচজন, ছয়জন ও সাতজন করে পথ চলছিল। উকবা নামক এক আনসারী ব্যক্তি তাঁর উটের পাশ দিয়ে চক্কর দিল এবং তাকে থামাল। তারপর তার পিঠে উঠে আবার তাকে চলতে নির্দেশ দিল। উটটি তখন একেবারে নিশ্চয় হয়ে গেল। তিনি তখন বললেন ধুত্তুরি। তোর ওপর আল্লাহর অভিশাপ। এ শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, নিজের উটকে অভিশাপদাতা এই ব্যক্তিটা কে? তিনি বললেন, আমি হে আল্লাহর রাসূল। তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ‘তুমি এর পিঠ থেকে নামো। তুমি আমাদের কোনো অভিশপ্তের সঙ্গী করো না। তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে, তোমাদের সন্তান-সন্তুতির এবং তোমাদের সম্পদের বিরুদ্ধে দু‘আ করো না। তোমরা আল্লাহর পক্ষ থেকে এমন মুহূর্তের জ্ঞানপ্রাপ্ত নও, যখন যা কিছুই চাওয়া হয় তিনি  তোমাদের তা দিয়ে দেবেন।’ [মুসলিম : ৭৭০৫]

হাদীসের ব্যাখ্যায় মোল্লা আলী কারী রহ. বলেন, অর্থাৎ তোমরা কোনো মুহূর্তেই নিজের বিরুদ্ধে, নিজের সন্তান বা সম্পদের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করো না। কারণ, হতে পারে যে সময় তুমি দু‘আ করছো, তা দিনের মধ্যে ওই সময় যখন যা-ই দু‘আ করা হোক না কেন তা কবুল করা হয়। তোমরা তো এ সময় সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে জ্ঞান প্রাপ্ত নও। (মুবারকপুরী, মিরআতুল মাফাতীহ : ৭/৭০৩)

হাদীসটি বর্ণনা করে আরেক ব্যাখ্যাকার বলেন,

فالحديث يدل على النهي عن كون الإنسان يدعو على أهله وماله، وذلك عندما يحصل له غضب فيحصل منه الدعاء، وهو مشتمل أيضاً على بيان العلة والحكمة في ذلك، وأنه قد يكون هذا الدعاء يوافق ساعة إجابة فيستجاب للإنسان فيما سأل من الشر أو من الشيء الذي لا ينبغي لأهله وماله.

‘হাদীসটি রাগের মাথায় মানুষের তার পরিবার ও সম্পদের বিরুদ্ধে দু‘আ করার নিষিদ্ধতা প্রমাণ করে। হাদীসটি এর কারণও তুলে ধরে। আর তা হলো, এ দু‘আটি কবুলের বিশেষ মুহূর্তে পড়ে যেতে পারে। ফলে মানুষের সবই কবুল হয়ে যায় চাই তা ভালো হোক বা মন্দ, যা সে তার পরিবার বা সম্পদের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা করে না।’ [আবদুল মুহসিন, শারহু সুনান আবী দাউদ : ৮/২৮৮]

নিজের সন্তানের বিরুদ্ধে দু‘আ করার অর্থ তো নিজেই নিজেকে হত্যার তথা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া। আর এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

 وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ – البقرة: ١٩٥

‘আর তোমরা নিজ হাতে নিজদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না।’ [ সূরা আল-বাকারা, আয়াত : ১৯৫]

অতএব প্রতিটি মাকে ভেবে দেখতে হবে, আমার রাগের মাথায় উচ্চারণ করা বাক্য যদি সত্যে পরিণত তাহলে কেমন লাগবে? আমি কি তা সহ্য করতে পারব? এ জন্য রাগের মাথায়ও কখনো সন্তানের অমঙ্গল কামনা করা যাবে না। প্রসঙ্গত বলা দরকার যে শুধু মায়েদেরই নয়, আমাদের সবারই উচিত নিজের, নিজের সন্তান ও সম্পদের বিরুদ্ধে বদদু‘আ করা থেকে সংযত হওয়া। রাগের সময় সংযম ও সহিষ্ণুতার পরিচয় দেওয়া।

আর মেয়েদের সবিশেষভাবে বলতে চাই, মা, আপনি অনেক সয়েছেন, অনেক সবর করেছেন, আরেকটু সবর করুন। রাগের মাথায় সন্তানকে অভিশাপ দেয়া থেকে সংযত থাকুন। আল্লাহ আপনার সহায় হোন। আমীন।

মানুষ কষ্ট দিলে মনের ক্ষত সারাবেন যেভাবে

$
0
0

colorful-flowers-wallpaper_422_84115

মূল প্রবন্ধ : ইয়াসমিন মোজাহেদ | ভাষান্তর : মোঃ মুনিমুল হক |  সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

যখন ছোট ছিলাম, পৃথিবীটাকে মনে হতো একেবারেই নির্ঝঞ্ঝাট এবং খুব পরিপাটি একটা জায়গা। কিন্তু বড় হয়ে দেখলাম ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। ভাবতাম সবকিছুই ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ আমার মনে হতো, কারও প্রতি কখনো কোনোরূপ অন্যায় করা যাবে না। কোনো অন্যায় যদি হয়েই যায়, তাহলে সকল ক্ষেত্রেই সুবিচারের জয় হবে। নিজের এই নীতিবোধ অনুযায়ী, সবকিছু যেমনটি হওয়া উচিত তেমনটি ঠিক রাখার জন্য অনেক সংগ্রাম করেছি জীবনে। কিন্তু এই সংগ্রাম করতে গিয়ে জীবনের একটি মৌলিক সত্যকে উপেক্ষা করছিলাম আমি। আমার শিশুসুলভ আদর্শবাদের কারণে আমি বুঝতেই পারিনি, সৃষ্টিগতভাবেই এই পার্থিব জগতটা ত্রুটিযুক্ত। ঠিক যেভাবে আমরা মানুষরা সৃষ্টিগতভাবে অপূর্ণ, ত্রুটিযুক্ত। সবসময় অঘটন আর ঝামেলা লেগেই থাকে আমাদের জীবনে। এসব ঝামেলাই জড়িয়ে, জেনেই হোক, না-জেনেই হোক, ইচ্ছা কি অনিচ্ছায় হোক, অনিবার্যভাবেই আমরা মানুষের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলি। বাস্তব হলো, পৃথিবীটা সবসময় ন্যায়নীতি দিয়ে চলে না।

তার মানে কি এই যে, আমরা অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই থামিয়ে দেবো, সত্যের পক্ষে হাল ছেড়ে দেবো? অবশ্যই না। এর মানে হলো, আমরা অবশ্যই এই পৃথিবী এবং আর সবকিছুকে কোনো কাল্পনিক বা অবাস্তব মানদণ্ডে বিচার করতে যাবো না। তবে এমনটি না-করাও সহজ না। কীভাবে আমরা এতো ত্রুটিময় এই পৃথিবীতে টিকে থাকবো, যেখানে মানুষ প্রতিনিয়ত পরস্পরকে হতাশায় ডুবাচ্ছে, এমনকি নিজ পরিবারের লোকেরাই মনে আঘাত দিয়ে মনটা ভেঙ্গে দিচ্ছে? সবচেয়ে কঠিন বিষয়টি হলো, আমাদের প্রতি কেউ অন্যায় করলে কীভাবে আমরা সেই অপরাধকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে আমরা নিষ্ঠুর না হয়েও দৃঢ় হতে পারি? অথবা কীভাবে দুর্বল না হয়েও মনের কোমলতাকে বজায় রাখতে পারি? কখন আমরা কোনো কিছুকে আঁকড়ে ধরে রাখবো? আর কখন সেটিকে বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবো? কখন বেশি বেশি যত্ন দেখালে তা বাড়াবাড়ি হয়ে যায়? কারও প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ভালোবাসা বলে কি কোনো জিনিস আছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদেরকে প্রথমে নিজেরদের জীবনের গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমাদের খুঁজে দেখতে হবে, আমরাই প্রথম বা শেষ কিনা, যারা কষ্ট এবং অন্যায়ের শিকার। যে মানুষগুলো আমাদের আগে পৃথিবীতে ছিল তাদের জীবনের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাদের সংগ্রাম এবং তাদের বিজয় নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে। আমাদের বুঝতে হবে, কষ্ট ছাড়া কখনোই কোনো অগ্রগতি আসেনি এবং সাফল্যের একমাত্র পথ হলো সংগ্রাম। উপলব্ধি করতে হবে, জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো কষ্টভোগ করা এবং অন্যদের দেওয়া দুঃখকষ্ট এবং ক্ষতিকে জয় করা।

আমাদের নবীদের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তসমূহ স্মরণ করলে আমরা দেখতে পাই যে, দুঃখকষ্ট ভোগ করা শুধু আমাদের জন্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। মনে রাখবেন, নূহ (আ) তাঁর জাতির লোকদের দ্বারা ৯৫০ বছর ধরে অত্যাচারীত হয়েছিলেন। কুরআন আমাদের বলে :

“তাদের পূর্বে নূহের সম্প্রদায়ও অস্বীকার করেছিল। তারা আমার বান্দাকে অস্বীকার করেছিল এবং এবং বলেছিল, ‘পাগল।’ আর তাকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।”
[সূরা আল-কামার; ৫৪ : ৯]

নূহের (আ) উপর এত বেশী অত্যাচার করা হয়েছিল যে:

“তিনি তার পালনকর্তাকে ডেকে বললেনঃ আমি পরাভূত, অতএব, তুমি সাহায্য করো।” [আল-কামার; ৫৪ : ১০]

নবীর (সা) কথাই মনে করে দেখুন, কীভাবে তাঁকে পাথর মেরে রক্তাক্ত করা হয়েছিল। কীভাবে তাঁর সাহাবীদের প্রহার করা হয়েছিল। কীভাবে তারা অনাহারে দিন পার করেছিলেন। অন্য মানুষরাই তাদেরকে এভাবে কষ্ট দিয়েছিল। এমনকি আমরা অস্তিত্বে আসার পূর্বেই ফেরেশতারা মানুষের এই ধরণের চারিত্রিক দিকটি বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ্‌ যখন বললেন যে, তিনি মানুষ সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন, তখন ফেরেশতারা প্রথম যে প্রশ্নটি করেছিল তা ছিল মানুষের ক্ষতিকর সম্ভাবনা সম্পর্কে। আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেন :

“আর স্মরণ করুন, যখন আপনার রব ফেরেশতাদের বললেন : ‘নিশ্চয়ই আমি যমিনে একজন খলিফা সৃষ্টি করছি’, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে তাতে ফাসাদ করবে এবং রক্ত প্রবাহিত করবে? আর আমরা তো আপনার প্রশংসায় তাসবীহ্‌ পাঠ করছি এবং আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই আমি জানি যা তোমরা জানো না।’ ” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ৩০]

মানুষ জাতির একে অপরের বিরুদ্ধে ঘৃণিত অপরাধ সংঘটনের এই প্রবণতা একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। তবে আমাদের অনেকেই অনেক সৌভাগ্যবান। আমাদের অধিকাংশকেই কখনো এমন কোনো দুঃখকষ্টের শিকার হতে হয়নি অন্যরা প্রতিনিয়তই যার শিকার হচ্ছে। আমাদেরকে অনেককেই কোনোদিন নিজের চোখে দেখতে হবে না যে, আমাদের পরিবার পরিজনের কাউকে নির্যাতন করে খুন করা হচ্ছে। তারপরও এমন মানুষ খুব কমই আছে, যারা বলতে পারে, তারা কোনোদিনও কোনোভাবে অন্য কারও দ্বারা কষ্ট পায়নি। সুতরাং, যদিও আমাদের অনেকেই কোনোদিন জানবে না অনাহারে ক্ষুধার যন্ত্রণায় মরার কষ্টটা কী; নিজের চোখের সামনে নিজের বাড়িঘর ধ্বংস করতে দেখার অনুভূতিটা কেমন, তথাপি আমার অনেকেই জানি আহত হৃদয়ের কান্নার অনুভূতিটা কেমন।

আচ্ছা, এসব কি এড়ানো সম্ভব? আমার মনে হয়, কিছুটা হলেও সম্ভব। আমরা কখনোই সকল দুঃখকষ্টকে এড়াতে পারব না। তবে আমদের প্রত্যাশা, আমাদের প্রতিক্রিয়া এবং আমাদের মনোযোগকে পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে অনেক ধ্বংসযজ্ঞই এড়ানো সম্ভব।

উদাহারনস্বরূপ বলা যায়, আমদের আশা, ভরসা, বিশ্বাস — সবকিছুকে অন্য একজন মানুষের উপর সমর্পণ করাটা একেবারেই অবস্তবিক এবং ডাহা বোকামি। আমদের মনে রাখতে হবে, ভুল করা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব। তাই আমাদের চূড়ান্ত বিশ্বাস, আস্থা, এবং প্রত্যাশা শুধুমাত্র আল্লাহ্‌র প্রতি সমর্পণ করা উচিত। আল্লাহ্‌ বলেন :

“যে ব্যক্তি তাগূতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান আনে, অবশ্যই সে মজবুত রশি আঁকড়ে ধরে, যা ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্‌ সর্বশ্রোতা এবং সর্বজ্ঞ।” [আল-বাকারাহ্‌; ২ : ২৫৬]

“আল্লাহ্‌র প্রতি ঈমান এমন মজবুত এক রশি যা ছিন্ন হবার নয়।” — শুধু এই কথাটি যদি আমরা স্মরণে রাখি, তাহলে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

একথা বলার অর্থ কিন্তু এই নয় যে, আমরা ভালোবাসবো না বা ভালোবাসলেও কম করে বাসবো। তবে কীভাবে ভালোবাসবো সেটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কাউকেই বা কোনো কিছুকেই সর্বোচ্চ ভালোবাসা যাবে না। অন্তরে আল্লাহ্‌ ব্যতীত আর কোনো কিছুকেই অগ্রাধিকার দেওয়া যাবে না। আর আল্লাহ্‌ ব্যতীত কোনো কিছুকেই এত বেশী ভালোবাসা যাবে না যাতে করে ওই বস্তু ছাড়া জীবন চলা আমাদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই ধরনের “ভালোবাসা” ভালোবাসাই নয়। এটা এক ধরনের পূজা করা। এই ভালোবাসায় কষ্ট ছাড়া আর কিছু নেই।

তারপরও যদি কেউ এমন করে ভালোবাসে এবং অন্যের দ্বারা আঘাত বা কষ্ট পায়, তাহলে অনিবার্য পরিণতিটা কী দাঁড়ায়? সবচেয়ে কঠিন কাজটা আমরা কীভাবে করতে পারি? কীভাবে আমরা অন্যকে ক্ষমা করতে শিখব? কীভাবে মনের ক্ষতগুলোকে সারিয়ে তুলে, তাদের সাথে সদাচরণ বজায় রাখব যারা নিজেরাই আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে না?

আবূ বাক্‌র (রা) এর ঘটনাটি ঠিক এমন পরিস্থিতির একটি চমৎকার উদাহরণ। যখন তাঁর মেয়ে, ‘আয়েশা (রা) সম্পর্কে জঘন্যতম অপবাদ রটানো হলো, তিনি জানতে পারলেন, এই অপবাদটা রটিয়েছিল মিস্‌তাহ্‌ নামে তারই এক চাচাতো ভাই যাকে তিনি বহুদিন ধরে আর্থিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে আসছিলেন। সঙ্গত কারণেই আবূ বাক্‌র অপবাদ আরোপকারীর সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। সামান্য সময় পরেই আল্লাহ্‌ নিম্নোক্ত আয়াত অবতীর্ণ করলেন :

“আর তোমাদের মধ্যে যারা মর্যাদা ও প্রাচুর্যের অধিকারী, তারা যেন এমন কসম না করে যে, তারা নিকটাত্মীয়দের, মিসকীনদের ও আল্লাহ্‌র পথে হিজরতকারীদেরকে কিছুই দেবে না। আর তারা যেন তাদের ক্ষমা করে এবং তাদের দোষক্রটি উপেক্ষা করে। তোমরা কি কামনা করো না যে, আল্লাহ্‌ তোমাদের ক্ষমা করে দেন? আর আল্লাহ্‌ বড়ই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” [আন-নূর; ২৪:২২]

এই আয়াত শুনেই আবূ বাক্‌র (রা) বুঝতে পারলেন যে, তিনি নিজেই আল্লাহ্‌র ক্ষমা চান। তাই তিনি শুধু সেই লোককে সাহায্য দেওয়া চালুই করলেন না, এখন আগের চেয়ে বেশি করে দিতে লাগলেন।

মু’মিন হওয়ার মূলেই হলো এইভাবে ক্ষমা করে দেওয়া। এই ধরণের মু’মিনদের বর্ণনা দিয়ে আল্লাহ্‌ বলেন :

“আর যারা গুরুতর পাপ ও অশ্লীল কার্যকলাপ থেকে বেঁচে থাকে এবং যখন রাগান্বিত হয় তখন তারা ক্ষমা করে দেয়।” [আশ-শূরা; ৪২:৩৭]

‘আমি নিজেও  ভুল করি, অন্যদের কষ্ট দেয়’ — নিজের সম্পর্কে এই ধরণের সচেতনতা বোধ দ্বারা অন্যকে তাৎক্ষনিকভাবে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতাটা উদ্বুদ্ধ হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এই বিষয়টির মাধ্যমেই আমাদের বিনম্রতা উজ্জীবিত হওয়া উচিত যে, আমারা প্রতিদিন পাপ করার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতি অন্যায় করছি। আল্লাহ্‌র সাথে তুলনা করলে মানুষ তো কিছুই না। তারপরও বিশ্বজগতের প্রতিপালক, আল্লাহ্‌ আমাদের প্রতিনিয়ত ক্ষমা করে দিচ্ছেন। তাহলে ক্ষমা না করে মানুষকে বেঁধে রাখার আমরা কে? নিজেরা যদি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা পাওয়ার আশা করি, তাহলে আমরা অন্যদেরকে ক্ষমা করতে পারি না কেন? আর এ কারণেই নবী (সা) আমাদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন :

“যারা অন্যের প্রতি দয়া করে না, আল্লাহ্‌ও তাদের প্রতি দয়া করবেন না।” [মুসলিম; অধ্যায় ৩০, হাদীস নং ৫৭৩৭]

আল্লাহ্‌র দয়া লাভের আশা যেন আমাদের অন্যদের প্রতি দয়া করতে উদ্বুদ্ধ করে এবং একদিন সেই দুনিয়ার নিয়ে যায় যা বাস্তবিক অর্থেই নিখুঁত, ত্রুটিহীন, পরিপূর্ণ, অনুপম, অতুলনীয়।

বইঃ আক্বীকার বিধান ও নামকরন

$
0
0

AkikarBidhanONamkoronসংক্ষিপ্ত বর্ণনাঃ আক্বীকা ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। এই বিধান পালনের মাধ্যমে নেকী পেতে হলে তা সঠিকভাবে কুরআন ও সুন্নাহের আলোকে পালন করা আবশ্যক। আর এই বিধানটি সম্পর্কে আমাদের সমাজে অজ্ঞতা ও বিভ্রান্তি বিদ্যমান। তাই লেখক বিষয়টির ভয়াবহতা উপলব্ধিরদরুন এই বইয়ে আক্বীকার বিধান সম্পর্কে কুরআন সুন্নাহের আলকে দলীল ভিত্তিক আলোচনার পাশাপাশি আক্বীকার বিধান সম্পর্কিত দুর্বল ও জাল হাদিস গুলো উল্লেখ করেছেন যাতে সাধারন পাঠকগন এই দুর্বল ও জাল হাদিসগুলো জেনে তার উপর আমল করা বন্ধের মাধ্যমে নিজেদের উপকৃত করতে পারে।

প্রণয়নে: মুহাম্মাদ মুকাম্মাল হক আল-ফাইযী

আক্বীকার বিধান ও নামকরন

Mediafire: আক্বীকার বিধান ও নামকরন


আমাদের ঘরের মাঝের আগন্তুক

$
0
0

(ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ এনামুল হকের আইসিডিতে পরিচালিত হালাকার একটি আলোচনার লিখিত রূপ এই লেখাটি। লেখাটিতে আলোচনাকে পাঠযোগ্য করার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়েছে।)

agontuk

আজ আমি আপনাদের প্রথমে এক পৃষ্ঠার একটা ছোট লেখা পড়ে শোনাব। লেখাটা নাম না জানা কোন বিদেশী লেখকের। অনুবাদ আমার। এই প্রবন্ধটার নাম হচ্ছে ‘আগন্তুক’। এটা থেকেই আমরা আজকের মূল আলোচনায় যাব। এখানে লেখক বলছেন:

“আমার জন্মের কয়েক মাস আগে, আমার বাবার সাথে একজন আগন্তুকের দেখা হয়েছিল – যে আমাদের ছোট্ট শহরে তখন নতুন এসেছিল। শুরু থেকেই আমাদের বাবা ওই মুখর আগন্তুকের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট বোধ করেন এবং শীঘ্রই তাকে আমাদের সাথে এসে বসবাস করতে আমন্ত্রণ জানান। তার চেহারা বাহির থেকে দেখতে খুব আকর্ষণীয় মনে না হলেও সবাই তাকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিল এবং কয়েক মাস পর যখন পৃথিবীতে আমার আগমন ঘটল (অর্থাৎ ঐ লেখকের জন্ম হোল) তখন আর সবার সাথে, সেও আমাকে স্বাগত জানাল। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম তখন বাড়িতে এই আগন্তুকের অবস্থান নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন আসেনি। আমার কচি মনে পরিবারের সকল সদস্যের জন্য একেকটা আসন ছিল। আমার পাঁচ বছরের ছোট ভাই ইউসুফ ছিল আমার জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ।” ..

এখানে একটা মুসলিম পরিবারের কথা বলা হচ্ছে।

.. “আমার ছোট বোন সাদিয়া আমার খেলার সাথী ছিল। সে আমাকে, নিজেকে বড় ভাই ভাবার যোগ্যতা দান করে ও মানুষকে ক্ষ্যাপানোর বিদ্যা অর্জনে সহায়তা করে। আমার বাবা-মা ছিলেন সম্পূরক, পরিপূরক শিক্ষক। মা আমাকে আল্লাহকে ভালোবাসতে শেখান আর বাবা শেখান কী করে আল্লাহর আনুগত্য করতে হয়। কিন্তু ওই আগন্তুক আমাদের গল্প শোনাত। সে অদ্ভুত সুন্দর সব হৃদয়গ্রাহী গল্প বানাতে ও শোনাতে পারত – অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, কমেডি আরও কত কী! এসবই ছিল তার দৈনন্দিন সংলাপ। প্রতিদিন বিকালে সে আমাদের গোটা পরিবারকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার শ্রোতা হিসাবে ধরে রাখতে পারতো – আর সপ্তাহান্তে আমাদের জেগে থাকা সময়টুকুর প্রায় সবটুকু সে-ই নিয়ে নিতো। আমি যদি রাজনীতি, ইতিহাস বা বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতাম, সে তা জানাত। সে অতীত সম্পর্কে জানাত এবং মনে হতো বর্তমান সম্পর্কেও তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। সে এমন সব জীবন্ত ছবি আঁকতে পারত যে আমি প্রায়ই সেগুলো দেখে কাঁদতাম অথবা হাসতাম। সে আমাদের গোটা পরিবারের একজন বন্ধুর মতো ছিল। সে আমাকে, আমার বাবাকে ও ইউসুফকে আমাদের জীবনে দেখা প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ম্যাচে নিয়ে যায়। সে আমাদের সবসময় সিনেমা দেখতে উৎসাহ দিত। এমনকি বহু নামী-দামী মানুষের সাথে আমরা যেন পরিচিত হতে পারি, সে তারও ব্যবস্থা করে দিত। সে অনর্গল কথা বলতে পারত। আমার বাবা মনে হয় তাতে কিছু মনে করতেন না বা বিরক্ত হতেন না। কিন্তু আমরা বাকিরা যখন হাঁ করে তার বলা কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা শুনতাম, মা তখন মাঝে মাঝেই তার সভা থেকে উঠে যেতেন। নিজের ঘরে গিয়ে তিনি কুরআন পড়তেন। কখনো তিনি সন্তর্পণে আমাদের বলতেন, নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘ঈমানের সুন্দর দিক হচ্ছে সকল নিষ্ফল কাজ-কর্ম এড়িয়ে চলা’।”

আমরা হাদিস জানি, হয় উত্তম কথা বল নাহলে চুপ থাক; এর সাথে সকল নিষ্ফল কাজ এড়াতে বলেছেন আল্লাহর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

“এখন আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মা কী কখনো এমন দু’আ করতেন যে, ওই আগন্তুক যেন চলে যায়? আমার বাবা আমাদের পরিবারকে কিছু নৈতিক নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে পরিচালিত করতেন। কিন্তু এই আগন্তুক সেগুলোকে সম্মান করার কোন প্রয়োজন বোধ করত না। এমনিতে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন আচরণ আমাদের বাড়িতে বরদাস্ত করা হতো না, আমাদের তরফ থেকে তো নয়ই, আমাদের বন্ধুদের বা বড়দের তরফ থেকেও ওই ধরণের কোন আচরণ বরদাস্ত করা হতো না। কিন্তু আমাদের অনেকদিনের অতিথি কখনো এমন চার অক্ষরের শব্দ ব্যবহার করত যাতে আমার কানে শীশা ঢালার অনুভূতি হতো এবং আমার বাবা তখন অস্বস্তিতে গজগজ করতেন। তবে আমার জানামতে এই আগন্তুককে কখনো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।”

চার অক্ষরের শব্দ আমি এখানে বললাম না, ইংরেজীতে যাদের জ্ঞান আছে তারা বুঝতেই পারছেন কোন অশ্লীল শব্দ এটা।

“আমার বাবা কখনোই মদ স্পর্শ করেননি এবং কখনো বাড়িতে অ্যালকোহল অনুমোদন করেননি। এমনকি রান্নার জন্যও নয়।”

আগেই বলেছি এটা একটা বিদেশী লেখা, আমার কাছে এসেছে একজন শ্রীলংকান মুসলিমের তরফ থেকে।

“কিন্তু ওই আগন্তুক যেন মনে করত যে, আমাদের অন্য ধারার জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা আবশ্যক। সে আমাদের প্রায়ই বিয়ার ও অন্যান্য মদজাতীয় পানীয় সাধত। সে আমাদের বোঝাত সিগারেট বেশ মজার একটা জিনিস, চুরুট বেশ পুরুষালী আর পাইপ হচ্ছে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। সে খোলামেলাভাবে যৌনতা নিয়ে কথা বলত। তার মতামতগুলো ছিল চাঁছাছোলা, কখনো ইঙ্গিতবহ আর প্রায়শই বিব্রতকর। কিভাবে রসিয়ে রসিয়ে মেয়েদের সাথে আলাপ জমান যায় তাও সে আমাদের শিখিয়ে দিত। আমি এখন বুঝতে পারি, নারীপুরুষের সম্পর্কের ব্যপারে আমার মনে প্রোথিত প্রাথমিক ধারণাগুলো তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয় যে, এটা আমাদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ রহমতের ব্যপার ছিল যে ওই আগন্তুক আমাদের আরও বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। বারবার সে আমার বাবা-মার শেখান নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করত। তথাপি তাকে কদাচিৎ শাসন করা হতো বা চলে যেতে বলা হতো।”

অর্থাৎ, তাকে কখনোই শাসন করা হতো না বা চলে যেতে বলা হতো না।

“যখন থেকে সে আমাদের পরিবারের সাথে বসবাস শুরু করেছিল, তারপর প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন অবশ্য আমার বাবার কাছে সে তার আগমনের পরের প্রথম দিককার দিনগুলোর মতো প্রিয় নয়। কিন্তু তবুও এখনো আমি যদি কখনো আমার বাবা-মায়ের শোবার ঘরে প্রবেশ করি, তবে দেখি সে এক কোণায় বসে রয়েছে – কখন কেউ তার কথা শুনবে বা তার আঁকা ছবি দেখবে বা সে তার যাদু দিয়ে শ্রোতাদর্শককে বিমোহিত করবে সে অপেক্ষায়। আপনারা হয়ত তার নাম জানতে চাইবেন, আমরা তাকে টেলিভিশন বলে ডাকি।”

পুরো লেখাটা ছিল এই। আজকে আমাদের আলোচনাটাও আমাদের বাসার টেলিভিশন নিয়ে। যে জিনিসগুলো আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নিষেধ করি, সে জিনিসগুলো নাটক-সিনেমায় দেখানো হয়। বিয়ার, মদের বিজ্ঞাপন দেখেন নিশ্চয়ই আপনারা? ই.এস.পি.এন.-এ ক্রিকেট দেখার সময় সাথে দেখেন না এগুলো? বাবা-ছেলে-মেয়ে বসে একসাথে দেখেন। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ জিনিসও দেখেন। এখানে যা যা বলেছে তার একটা কথাও মিথ্যা না। এবং সে (টিভি) যখন এগুলো বলে, আমরা সবাই পাশাপাশিই বসে থাকি – একটু বিব্রত বোধ করি, কিন্তু হজম করে নেই। সে আমাদের সমস্ত ইসলাম বিরোধী, নৈতিকতা বিরোধী জিনিস বলে যায় এবং আমরা হজম করে নেই। আজকাল পেপারে দেখি: যে সমস্ত খুন হচ্ছে, (আমাদের বাসায় আলহামদুলিল্লাহ্‌ বার বছর টিভি নেই – তাই আমি দেখি না, কিন্তু) এগুলো নাকি সমকালীন সিরিয়ালগুলোর উপজীব্য! বাংলাদেশের পেপার খুললে কে কার স্বামী বা স্ত্রীকে মারলো, পরকীয়া প্রেম এগুলোই দেখা যায় – এটাই বলা হয়েছে এই লেখায়। আসুন, আমরা এখন আমাদের মূল আলোচনায় যাই।

আমরা “STRANGER IN OUR HOMES: TV AND OUR CHILDREN’S MIND” বইটা নিয়ে একটু কথা বলব। বইটার ভূমিকা ও সমাপ্তি লিখেছেন ইসলামের একজন পশ্চিমা ‘আলিম। উনি মালিকি মাযহাবের জোরালো সমর্থক ও সুফীবাদের প্রতি কিছুটা ঝোঁক আছে তার। আমি তার আক্কীদা-মানহায গ্রহণ না করলেও, সামাজিক ব্যপারগুলোতে তার কথাগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী বলে মনে করি। তার নাম: হামযা ইউসুফ হ্যানসন। ক্যালিফোর্নিয়াতে “যায়তুনা” বলে একটা মাদ্রাসা আছে তার। এই বইটা যায়তুনা ইন্সটিটিউট থেকে ২০০০ সালে বের করা হয়েছে। বইটার সামনে পিছনে তার লেখা আছে, কিন্তু মূল বক্তব্যটা সুজান আর. জনসন বলে একজন মহিলার। তিনি ডক্টর অফ মেডিসিন(MD), এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল প্রফেসর অফ পেডিয়্যাট্রিক্স, ডিভিশন অফ বিহেভিয়রাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পেডিয়্যাট্রিক্স। আমরা আজকে এই বইয়ে সংযুক্ত তার একটা লেখা নিয়ে কথা বলব, যা ১৯৯৯ সনের জানুয়ারির ৫ তারিখে সানফ্রানসিসকোতে তিনি একটা বক্তৃতার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন।

তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে, স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে, কেন তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ নাই, কেন কিছু জিনিস শিখছে, কিছু জিনিস শিখছে না – এসব বিষয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথমে বলছেন যে, মা হওয়ার আগে পর্যন্ত বিষয়টা তিনি সেভাবে বুঝতে পারেন নি। তিনি এক জায়গায় সাত বছর চাকরি করেছেন এবং আট থেকে বার বছর বয়সী যেসব বাচ্চাদের শিখতে অসুবিধা হয়, তাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন – শত শত বাচ্চাদের দেখেছেন, যারা মনোযোগ দেয় না বা পাঠ্য বিষয়গুলো ঠিকমত ধরতে পারে না; কিন্তু যেসব কাজে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির প্রয়োজন হয়, যেমন ছবি আঁকা, লেখালেখি বা জ্যামিতিক আকৃতি নিয়ে খেলা – এসবে তারা ভালো করছে। আবার অনেক বাচ্চাই অন্যদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না।

শিশু চিকিৎসক হিসাবে তিনি সবসময় টেলিভিশন দেখাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, কারণ এটা অনেক সময় হিংস্র জিনিস প্রচার করে। বাচ্চাদের কার্টুনে অনেক সময় নানা ধরনের জোরালো শব্দ থাকে, ‘বুম’, ‘ব্যাঙ’ ইত্যাদি। এমনকি আমরা যখন টম অ্যান্ড জেরি দেখতাম, সেখানেও ‘দুম-দুম-দুম-দুম’ করে পিটানোর শব্দ থাকত। আমরা মনে করি এটা তো বিনোদন, এগুলো তো সত্যি কিছু না – কিন্তু বাচ্চাদের মাথায় এই জিনিসগুলো ঢুকে যায়। এমনকি বিজ্ঞাপনেও যা দেখান হতো, সেগুলো নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন যে, ওগুলো ক্ষতিকর, ওগুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ। তার নিজের বাচ্চা জন্মানোর আগেও, এসব নিয়ে এধরনের তিনি চিন্তাভাবনা করতেন।

কিন্তু নিজের বাচ্চা হওয়ার পর, আস্তে আস্তে বুঝলেন যে, টিভিতে যা-ই দেখান হোক না কেন তা-ই আসলে বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর – এমনকি যদি জীব-জন্তু, গাছ-পালা দেখান হয় তাহলেও। আমরা অনেক সময় মনে করি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেল মনে হয় খুব উন্নতমানের প্রচার মাধ্যম – কিন্তু আসলে ব্যপারটা তা না। তার বাচ্চা হওয়ার পর টিভির আসল ক্ষতিটা কোথায়, সেটা তিনি বুঝতে শুরু করলেন। কী দেখান হচ্ছে সেটা মূল ব্যাপার ছিল না, কারণ, তিনি সচেতনভাবে সমস্ত মারামারি-হানাহানি-অশ্লীলতা বাদ দিতেন! কিন্তু তারপরও দেখলেন যে, তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সেটা দেখব আমরা।

আমরা অনেকেই এখন বাচ্চাদের “টিভি” ঘুষ দিয়ে থাকি। আজকাল অনেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। বাচ্চাদের জন্য তাদের সময় নাই। বেশী টাকার বা বড় মাইনের চাকরির প্রয়োজন – মৌলিক চাহিদা মেটাতে নয়, বরং মূলত দামী দামী “জিনিস” বা “আসবাবপত্র” সংগ্রহ করতেই দুজনের চাকুরী করা প্রয়োজন। আপনাকে যে সময়টাতে বাচ্চারা “মিস” করছে, ওই সময়টা আপনি ঘরে, টিভির সামনে, বসিয়ে রাখছেন তাদের।

আমাদের দেশ সাদা সাহেবরা শাসন করে গেছে, কিন্তু আমরা অনেক রক্ষণশীল ছিলাম। একটা মুসলিম পরিবারের  শোবার ঘরে কখনো তারা ঢুকতে পারেনি, এমনকি আমাদের বাড়িতেও কখনো ঢুকতে পারেনি। আমরা বলি, মুসলিম পরিবার হচ্ছে আপনার দুর্গ, এটা সবার জন্য উন্মুক্ত না। তারা কখনো আমাদের স্ত্রীদের সামনে আসেনি। আজকে কী হচ্ছে, শোবার ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় একজন সাদাচামড়ার সাহেব গান গাচ্ছে – আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতবহ গান – আপনার স্ত্রী দেখছেন না? আমরা কোথায় নিয়ে এসেছি তাদের কথাকে, সংষ্কৃতিকে!

শিশুবিশেষজ্ঞ সুজান বলছেন, কী দেখান হচ্ছে সেটা কোন ব্যাপার না। টিভির মাধ্যমে তার বাচ্চার আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেল। আপনারা দেখবেন, বাচ্চারা যখন টিভি দেখে, তখন তারা কিন্তু আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না; অর্ধেক মনোযোগ দিয়ে সে আপনাকে শুনছে, তার চোখ-কানের অর্ধেক ওইদিকে। সে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে, দাঁড়িয়েও শুনছে না আপনার কথা। তার আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। টিভি দেখার আগে, দেখার সময় ও পরে তার মানসিক ও শারীরিক নড়াচড়া পাল্টে যাচ্ছে। তিনি কিন্তু অমুসলিম মহিলা – সাধারণ পর্যবেক্ষণের কথা বলছেন – সব অবস্থাতেই তার বাচ্চার আচরণ পাল্টে গেছে, যা দেখে আসলে তিনি রীতিমত ‘ভয়’ পেয়েছেন।

তারপর উনি বলছেন, যখন বাচ্চা টিভি দেখত না তখন সে প্রকৃতির মাঝে থাকত, পোকামাকড়ের প্রতি কৌতহল প্রকাশ করত। গ্রামে গেলে দেখবেন আমাদের এদেশীয় বাচ্চারা জোনাকি পোকা নিয়ে কি করে – ধরবে, ধরে গ্লাসের ভেতর ঢুকাবে, দেখবে কতক্ষণ জ্বলে! তো, তার বাচ্চাও প্রকৃতির সাথে বড় হচ্ছিল। আমরাও তো ছোটবেলায় বালু দিয়ে, পানি দিয়ে খেলতাম, দুর্গ বানাতাম। তারপর সুজান বলছেন, তার বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে শান্তিতে ছিল – নিজেকে নিয়ে, নিজের শরীর নিয়ে, তার পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ে। যদি আপনি দেখেন একটা বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে খেলছে, দেখবেন সে আনমনে অনেক কিছু করে যাচ্ছে। আমাদের মায়েরা ছয় ছয়টা বাচ্চা প্রতিপালন করেছেন, কোথায় অত সময় দিতে পেরেছেন তারা? এখন তো ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার, ব্লেন্ডার আছে। তখন তো ওসব ছিল না। আমাদের মায়েরা আমাদের প্রতিপালন করেছেন কী করে? আমরা প্রকৃতির মাঝে বড় হয়েছি। কিন্তু আজকে আমাদের বাচ্চারা খোপের ভেতর বড় হচ্ছে এবং তাদের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন চাইলেই শহর ভেঙ্গে গ্রাম বানিয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল যেভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করতে বলেছেন, তার সাথে কিন্তু সুজানের উৎকন্ঠা ও চাওয়াগুলো মিলে যায় – তিনি খুব ইসলামিক একটা কথা বলেছেন না জেনেই।

তারপর তিনি বলছেন, যখন তার বাচ্চা টিভি দেখতে শুরু করল, সে তার প্রতি খুবই অমনোযোগী হয়ে গেল। উনি ডাকছেন অথচ বাচ্চার কোন সাড়া নই। চোখটা আঠার মতো লেগে আছে টিভিতে। সে তার চারপাশের পরিবেশের প্রতিও অমনোযোগী হয়ে গেল। ঘরে একজন মেহমান এলো – তার কথা বলার সময় নাই, তাকানোরও সময় নাই। আমাদের ছোটবেলায় ঘরে আপন মামা, চাচা আসলে আমরাই চা, শরবত নিয়ে গেছি; কাজের মানুষ না। এগুলোর সময় নেই তার। এখন আমাদের আরও যেটা হয়, ছোট বাচ্চাদের খাওয়ানোর উপায় হচ্ছে টিভি, ওদিকে তাকিয়ে বিজ্ঞাপন দেখছে আর গিলছে। খাবারের দিকে তার কোন মনোযোগ নাই, খাবার সে চাবাচ্ছে না; তার তো পেট খারাপ হবেই! কারণ আমাদের খাওয়াটা গন্ধ, স্পর্শ, রংসহ দেখতে যা লাগে – তা থেকে আমাদের মুখে পানি আসে, লালা আসে, ইচ্ছা জাগে খাওয়ার। আমরা চিবাই আর খাবারটা সহজে হজম হয়। কিন্তু টিভির দিকে তাকিয়ে ওভাবে গিললে, খাবার হজম হয় না। বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভোগে; দাঁত ওঠে না, চোখে দেখে না – কতরকম সমস্যা হচ্ছে না এখন? এগুলো কিন্তু অনেক কারণে হয়, এসব চিন্তা করার ব্যপার। মুসলিমরা চিন্তা করবে – আল্লাহ তাদের কেন জন্ম দিলেন, কী কারণে, কোনটা করলে সবচেয়ে ভালো হয় ইত্যাদি।

তারপর উনি বলছেন, আমি যখন টিভি বন্ধ করে দিতাম, সে বিরক্ত হত, ঘ্যানঘ্যান করত, কখনো চিৎকার করত, কখনো কাঁদতো – টিভিটা আবার ছেড়ে দেয়ার জন্য। তার খেলাধুলাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল, কোন নিয়মের ধার ধারত না সেতার নড়াচড়াও ঠিক ছিল না – বাচ্চাদের যেমন স্বাভাবিক হওয়ার কথা তেমন ছিল না। তার খেলায় নিজস্ব কল্পনা থাকত না। বিদেশীদেরও কিন্তু দেখবেন – আল্লাহ ওদের অনেক জায়গাজমি দিয়েছেন – তারা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করত খেলাধুলায়, গাছের ওপর ঘর বানাত ইত্যাদি। এই যে নিজের চিন্তা থেকে কিছু করা – এগুলোর কোন আগ্রহ রইলো না সুজানের বাচ্চার, যখন সে টিভি দেখতে শুরু করল। সে নিজে থেকে কিছু না করে টিভিতে যা দেখছে, ঠিক তার মতো করেই একটা কিছু করার চেষ্টা করছে।

এরপর উনি আট থেকে এগার বছরের ছয়টা বাচ্চাকে নিয়ে গবেষণা করলেন। আমরাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এক থেকে এগার/বার বছরের মধ্যে বাচ্চাদের মাথায় যেটা ঢুকে, সেটা বের করা যায় না। এই সময়টা আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের বাচ্চাদের যত্ন নিজে নেবেন, তাকে দ্বীন শেখাবেন, আল্লাহর কথা শোনাবেন, নবীর গল্প শোনাবেন, ইসলামের ইতিহাস শোনাবেন – আল্লাহর ওয়াস্তে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসপত্র তাদের কাছে উন্মোচিত করবেন না। কারণ এই সময় যা শিখবে, তা মাথা থেকে বের হবে না। আমার মনে আছে ওই রকম বয়সে আমার স্কুলের টিচার একটা কথা বলেছিলেন যা প্রকারান্তরে বোঝায় বিজ্ঞান ঠিক, কুরআন ভুল। অথচ উনি যা বলেছিলেন, তা কুরআনে কোথাও লেখা নেই। আমার মনে আছে আমার কেমন লেগেছিল তখন, আমার কিশোর মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে কী হয়? আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মনে হীনমন্যতা জন্মায়, পরবর্তীতে আমরা কিন্তু আর ইসলামকে শ্রদ্ধা করতে পারব না। আমাদের কাছে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসই প্রাধান্য পাবে। এ জন্য এই বয়সটা খুব যত্ন নেবেন বাচ্চাদের, তাদের সময় দেবেন, টিভির মতো আবর্জনা থেকে দূরে রাখবেন – ইসলামের বা সাধারণ সুন্দর সুন্দর গল্প বলবেন, টিভি বা কার্টুনের ঘুষ দিয়ে বসিয়ে রাখবেন না।

যাই হোক, তার গবেষণার বাচ্চাদের ব্যপারে উনি বলছেন, কোন শব্দ বা অক্ষর বলা হলে তারা সেটার মানসিক আকৃতি দিতে পারত না। এই জিনিসটা ব্যখ্যা করি, কল্পনার ভেতর কোন জিনিস দেখা। যেমন, যারা গাড়ি চালায়, যদি একটা ম্যাপ উল্টা থাকে আপনি মনে মনে ম্যাপটাকে সোজা করে পথটা বুঝে নিবেন। একে বলে স্প্যাশিয়াল অ্যাবিলিটি (SPATIAL ABILITY)। এটা মস্তিষ্কে গড়ে তুলতে হয়। মনের এই কল্পনাশক্তিটা জন্ম না নিলে এই দক্ষতাটা আসবে না। আর এটা আসবে না, যদি কেউ হাঁ করে বসে থেকে সারাদিন টিভি দেখে। যার এই দক্ষতা যত বেশি সে তত ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারবে। এরপর উনি বলছেন, যদি তিনি তাদের কয়েকটা অক্ষর দেখিয়ে একটা বের করতে বলতেন, তাহলে তারা সেটা পারত; কিন্তু না দেখালে তারা আর পারছে না। এই সকল বাচ্চারাই অনেক টিভি, ভিডিও দেখত আর কম্পিউটার গেম খেলত – কেন পারেনি তার মূল কারণ হচ্ছে এসব। আপনি মনে করবেন না কম্পিউটার গেম নিরাপদ, তা না কিন্তু! অনেক ‘ঢিসুম-ঢাসুম’ আছে। তখন উনি চিন্তা করতে শুরু করলেন টিভির সামনে বাচ্চাদের রাখলে কী সমস্যা হয় তাদের? সমস্যাটা হচ্ছে, মস্তিষ্কের জন্য আর করার কিছু থাকে না, এর চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার কিছু নাই। জানেন তো, মানুষের বাচ্চাকে দশ-বিশ বছর কোন কাজ করতে না দিলে, চেয়ারে বেঁধে রেখে দিলে সে কিন্তু আর দাঁড়াতেও পারবে না, হাঁটতে পারবে না – আল্লাহ মানুষকে এভাবেই বানিয়েছেন। গরু-ছাগলের বাচ্চা জন্মগতভাবেই ডাক দিতে, হাঁটতে, দৌড়াতে পারে কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে শেখাতে হয়। এই কারণে বলছেন, মানুষের বাচ্চা যখন টিভি দেখে, তখন সবকিছু তার মাথার ভেতরে ঢুকছে, সে নিজে চিন্তা করে কিছু বের করে না।

এরপর উনি বলছেন, শিশুদের দেখা, শোনা, স্বাদ নেয়া, গন্ধ নেয়া, স্পর্শ করা এই পঞ্চন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটা কাজে লাগে এমন ব্যপারে নিয়োজিত করতে হবে। এখানে আমি আমার নিজের জীবনের একটা গল্প বলি: আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন শীতকালে একবার সে আম খেতে চাইল। তার মা বলল এখন তো আম পাওয়া যাবে না। সে বলে উঠল, দোকানে গেলে পাওয়া যাবে না? এখন, এই বিষয়টা আসলে কী? তার মাথায় আছে পয়সা দিলে দোকানে সব পাওয়া যায়। একে আমরা বলি “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, অর্থাৎ আমার এক্ষুণি দরকার, এক্ষুণি চাই, তুমি যেখান থেকে পার এনে দাও। এটা কিন্তু চরিত্রটাকে নষ্ট করে দেয়। সে সবকিছু রেডিমেড পেতে, দেখতে ও কিনতে শেখে। অপরদিকে, সে যদি প্রকৃতির মাঝে থাকত তাহলে কী দেখত? প্রথমে দেখত আমের মুকুল আসছে, তারপর দেখত কিছু ঝরে গেছে আর কিছু রইল, তারপর আমের গুটি আসছে, সেখান থেকেও কিছু ঝরে গেল, এরপর কিছু কাঁচা আম এলো, তারপর বৈশাখের ঝড়ে কিছু ঝরে গেল কিছু রইল, যা টিকল সেটা পাকল, পাকার পর সেটা পাড়া হোল ও সবাই ভাগ করে খেলো। এর মাঝে কী নিহিত আছে? ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় জিনিসটা – সবর বা ধৈর্য! আজকাল দেখবেন আমাদের সবর নাই কারণ আমরা মনে করি পয়সা দিলেই তো সব পাওয়া যায়। আমরা একটা ধৈর্যহীন প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছি। পড়াশোনা করব তারপর ভালো রেজাল্ট হবে, তার চেয়ে নকল করলেই তো হয়ে যায়! এসবই কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” বা “তৎক্ষনাৎ তৃপ্তি” লাভের প্রবণতার ফল। আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন ছিল, “কোকোলা লজেন্স এক্ষুনি আনো”! এই কথাটা কিন্তু খুবই ইসলাম বিরোধী! কেন? আমাদের আল্লাহ কী বলেছেন? এই দুনিয়ায় সবকিছু পাবে না, দুনিয়া থেকে আমরা ততটুকু নিব, যতটুকু বাঁচার জন্য দরকার। সমস্ত প্রতিজ্ঞা আখিরাতের জন্য। এখন ধৈর্য ধরবেন, পরবর্তীতে পাবেন – এটা হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ আপনাকে যা এখানে নিষেধ করছেন, সেটা কিন্তু বলছেন জান্নাতে পাওয়া যাবে। দুনিয়া হচ্ছে ধৈর্যের ব্যপার, অপেক্ষা করার ব্যপার, “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস এটা।

এরপর লেখিকা বলছেন, বাচ্চাদের ইন্দ্রিয়গুলো স্পঞ্জের মতো হয়; যা দেখবে তাই শুষে নেয় এবং তাদের কোন একটা ইন্দ্রিয়কে বেশি উত্তেজিত করলে, অন্যগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। যদি শুধু চোখ আর কান এক জায়গায় আটকে দেয়া হয় তাহলে বাকিগুলো ব্যবহৃত না হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। সবকয়টা ইন্দ্রিয়ের দরকার আছে; সে প্রকৃতির কাছে যাবে, একটা কিছু ধরবে, একটা পিঁপড়া কামড় দেবে – এর দরকার আছে। একটা ফুলের ঘ্রাণ সুন্দর আরেকটার বাজে, এর দরকার আছে; একটা জিনিসের স্বাদ ভালো আর একটার স্বাদ কষটা, এর দরকার আছে। প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতার দরকার আছে। বাচ্চা বড় হবে ও সেই সাথে তার সব ইন্দ্রিয়গুলো গড়ে উঠবে – এটাই বলছেন তিনি। এরপর লেখিকা বলছেন, ছোটবেলায় সবকিছুই সে গ্রহণ করবে, এর মাঝে বাছবিচার করতে শিখবে না সে। শব্দের ব্যপারটাই ধরুন, প্রচন্ড সশব্দ মিউজিকে আপনি পাশের বাসায় বসে টিকতে পারছেন না, কিন্তু একটা বাচ্চা তার মাঝেই বসে আছে! এর মানে কী? সে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন আর স্বাভাবিক শব্দের মাত্রা তার ভালো লাগবে না। আর, স্পর্শের ইন্দ্রিয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা ও মাটি এই দুটা ছাড়া কোন বাচ্চা প্রাকৃতিকভাবে বড় হতেই পারে না। এই মহিলা বিধর্মী তাও বলছেন, মানুষ হওয়ার জন্য মায়ের স্পর্শে থাকতে হবে। মাটি ধরবে, মলিন হবে এবং মায়ের কাছে থাকবে – এসবকিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার।

এরপর আমরা লেখা শেষের প্রশ্নোত্তর পর্বটা একটু দেখবো। টিভি দেখার ফলে মনের উপর কি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে? টিভি দেখার কারণে যখন আপনি মনকে একখানে আটকে ফেলেন, তখন আপনি অন্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হন – যা মস্তিষ্কের বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করবে। একটা বাচ্চার সাথে যদি কথা বলা না হয়, খেলা না হয়, তাকে স্পর্শ করা না হয় তাহলে তার মস্তিষ্কের আকার ২০-৩০% ছোট হয়ে যায়। ছোঁবেন কখন, আপনি তো অফিসে! আপনার স্ত্রীও অফিসে। কথা বলারও সময় নেই। টেলিভিশনের কথা না, আপনার নিজের কথা বলার কথা বলছি আমরা। প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, একটা প্রাণীকে আটকে রেখে যদি অন্য প্রাণীদের খেলা দেখতে দেয়া হয় – টিভির মতো যেখানে আপনার নিজের নড়াচড়া নাই কিন্তু আপনি নড়াচড়া দেখছেন – তাহলে দেখা গেছে, প্রাণীটা যত বেশি দেখেছে, তত বেশি তার মস্তিষ্কের আকার কমে যাচ্ছে। এরপর ব্যাপারটা টিভির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে দেখা যাবে, টিভি শুধু দুইটা ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করে – দেখা আর শোনা। এতে করে আপনার চিন্তাশক্তি কমে যাচ্ছে, মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে, কল্পনাশক্তি কমে যাচ্ছে – আপনি লিখতে-পড়তে পারবেন না, আপনার কোন মনোযোগ থাকবে না!

এখানে একজন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি? শিশুচিকিৎসক সুজান পরামর্শ দিলেন,

১। যতটা সম্ভব টিভি বন্ধ করে রাখুন।

এটা খুবই সাধারণ কথা। আমাদের বাসায় বারো বছর টিভি চলে না। বাসায় দুইটা বাচ্চা আছে, একজন এগার বছর অন্যজন আট, জীবনে কোনদিন টিভি দেখেনি তারা। তাদের মস্তিষ্কের গ্রহণক্ষমতা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না – বড়টা নিজে নিজে কুরআন দেখতে দেখতে পড়তে শিখেছে। আসহাবে রাসূলের কাহিনী, ইবন কাসীর তার পড়া শেষ। কেন? তার তো “ইনপুট” দরকার! তার মস্তিষ্ক কিন্তু খালি! এবং তার কত প্রশ্ন – জীবন নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে! টেলিভিশন দেখা বাচ্চারা কিন্তু কোন প্রশ্ন করবে না। তার প্রশ্ন করার কিছু নাই, ওখানেই সে সব দেখছে।

২। বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাবেন – যেটা আমাদের মায়েরা, খালারা বা বড় ভাই-বোনেরা করেছে – বিশেষ করে ছবি ছাড়া বই।

আজকাল দেখবেন পুরো বইজুড়ে শুধু ছবি, এক লাইন লেখা। উনি কিন্তু উল্টা বলছেন, পুরোটা লেখা, একটু হয়ত ছবি থাকতে পারে। এতে কী হবে? সে কল্পনা করতে শিখবে। মুসলিম পরিবারে ছবি ছাড়া গল্প বলা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমরা যখন নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) গল্প বলি আমরা কি ছবি দেখাই? আর প্রচুর গল্প বলবেন।  ইনশাল্লাহ আমরা যারা মুসলিম আমরা নবী-রাসূলের গল্প, সাহাবীদের গল্প, কুরআন-হাদীসের গল্প বলব। আজকাল অনেক সাহিত্য আছে যেখান থেকে আমরা পড়তে পারি।

৩। প্রকৃতি! প্রকৃতি! প্রকৃতি!

যার যতটুকু সময় ও সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন, প্রকৃতির কাছে বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন। যতবার সম্ভব। প্রতিটি সম্ভাব্য ছুটিতে। এমনকি প্রতি সপ্তাহ শেষে যদি পারেন – ঘাস, মাটি, পোকা, বালু, কাদার ভেতর নিয়ে যাবেন। ধৈর্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে প্রকৃতি। একটা গাছ পুঁতল, পানি দিল কিন্তু গাছটা মরে গেল। গাছ মরতেই পারে। শিক্ষা না এটা? আমার একটা ছোট ভাই ছিল, আব্বা-আম্মার অনেক আদরের কিন্তু মারা গেছে। মরতে পারে না? প্রকৃতি আপনাকে ধৈর্য শিখাবে। আপনি ধাক্কা খাবেন না। বুঝবেন যে সবকিছু ধীরে ধীরে হয়। “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস হচ্ছে “ডিলেইড গ্রাটিফিকেশন” (বিলম্বে তৃপ্তি)। এর উদাহরণ কী? রোজা! সারাদিন অপেক্ষার শেষে পানি খেতে পারবেন। প্রকৃতি আপনাকে এই শিক্ষা দিবে। মানুষের চরিত্রে এটা গড়ে তোলা দরকার। “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক” – এটা কাফেরের দর্শন। আর ইসলামের মূল শিক্ষায় রয়েছে পরীক্ষা শেষের ফলাফল – কষ্ট করে ক্ষেতে বীজ বুনে, ফসলের জন্য যেমন আপেক্ষা করতে হয়। নগদ তেমন কিছুই পাবার নেই যেন, যতটুকু দরকার সেটুকু গ্রহণ করে আল্লাহ-নির্ধারিত নিয়মে ও আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটাতে পারলে, আপনার জন্য রয়েছে জান্নাত। আল্লাহর রাসূলের ওই হাদীস, সমুদ্রের পানিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে নিয়ে আসলে যা আঙ্গুলে লেগে থাকে সেটুকু দুনিয়ার জীবন। আর সমুদ্রে যেটুকু পানি রয়ে গেল, তা হোল আখিরাতের অনন্ত জীবন। তাহলে একজন মুসলিম কোন অবস্থায় এই দুনিয়ার জন্য আখিরাতকে নষ্ট করবে না। বরং, আখিরাতে প্রাপ্তির জন্য সে এখানে ধৈর্যধারণ করবে। সে এখানে ত্যাগ করবে, কষ্ট করবে, চোখমুখ বুঁজে থাকবে, সহ্য করে যাবে অনেক কিছু।

এরপর লেখিকা সুজান বলছেন, প্রকৃতি হচ্ছে পর্যবেক্ষণের বড় শিক্ষক। এর রঙগুলো দেখার মতো – আর তা সবগুলো ইন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত করে তোলে। একটা ফুল-ফোটা সর্ষেক্ষেত আর কিছু দিয়ে বর্ণনা করা যায়? এরপর উনি বলছেন, আজ অনেক বাচ্চা আছে যারা প্রকৃতির কাছে যেতে আগ্রহ পায় না, বলে ‘তোমরা যাও আমি এখানে বসে কার্টুন দেখি বা গেম খেলি।’ আছে না এমন? নড়তে চায় না। মুরগী (ফ্রাইড চিকেন) খেতে খেতে এরা মোটা হয়ে গেছে। ফাস্টফুড কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, মানে রান্নার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই – সেই ধৈর্যও নেই। এক্ষুণি দরকার আমার – সুতরাং পয়সা দিয়ে ফাস্টফুডের দোকান থেকে মুহূর্তে কিনে নিয়ে আসতে চাই!

যাহোক, উনি বলছেন অনেকসময় যারা টিভি দেখে, প্রকৃতিকে তাদের বোরিং মনে হয় কারণ তারা টিভির দ্রুতলয়ের অ্যাকশনে খুবই অভ্যস্ত হয়ে যায়। ‘টুং-টুং’, ‘ব্যাঙ’, ‘দুম-দুম’ গুলি ইত্যাদি শব্দ আছে না? এর বিপরীতে প্রকৃতিকে তাদের নীরব, অ্যাকশনবিহীন মনে হয়। প্রকৃতিতে যে কোন জিনিস কিন্তু ধীর, শান্ত, শান্তিপূর্ণ। সেখানে একটার পর একটা ঘটনা ধীরে ধীরে ঘটে, প্রকৃতির কর্মকান্ডের প্রত্যাশায় ধৈর্যের ব্যপার রয়েছে।

৪। আপনার নিজের ও বাচ্চার ইন্দ্রিয়ের প্রতি মনোযোগ দিন।

মাঝে মাঝে বাচ্চাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে দেখতে পায় কি না জিজ্ঞেস করবেন। এমন কিন্তু হয় যে একটা বাচ্চা এক চোখে দেখে না অনেকদিন – অথচ বাবা-মা জানেই না, কারণ সে অ্যাডজাস্ট করে নেয়। তাকে জিজ্ঞেস করবেন কোনটা কী রঙ বোঝার জন্য যে সে “কালার ব্লাইন্ড” কি না। সে সবরকম স্বাদ, গন্ধ চিনতে পারে কি না – অনেক মানুষ আছে সব ধরনের স্বাদ, গন্ধ পায় না। এগুলো নিজেরটা ও বাচ্চারটা পরীক্ষা করে দেখবেন।

৫। শিশুদের হাত, পা ও পুরো শরীর ব্যবহার করে অর্থবহ কাজ করতে দিন।

খেয়াল করবেন সে হাত, পা, সম্পূর্ণ শরীর ব্যবহার করছে কি না। তাকে মাঠে ঘাটে ছেড়ে দিন, ও দৌড়াক, আছাড় খাক, হাত-পা ছিলুক – এগুলো সব প্রয়োজনীয়!

এই ছিল শিশু বিশেষজ্ঞ সুজানের ৫টা পরামর্শ।

এরপর আমরা হামযা ইউসুফের লেখার অংশ দেখব। উনি ছয় বছর মৌরিতানিয়ায় থেকে দ্বীন শিক্ষা করেছেন। উনি কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষ – দ্বীন শিক্ষা করার জন্য মরুভূমিতে অত্যন্ত কষ্ট করেছেন। তিনি এই বইতে গসম্যান নামে একজন লেফটেন্যান্টের কিছু গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়েছেন যা আমরা দেখব:

১। টিভির ৪০% সহিংসতা করছে এমন চরিত্র, যাদের মানুষ আদর্শ মনে করে – যেমন, শাহরুখ খান।

২। এই সহিংসতাগুলো যারা করে, তাদের তিন ভাগের এক ভাগ খারাপ চরিত্রের কোন শাস্তি হয় না। এতে বাচ্চারা কী শিখে? আপনি খারাপ কাজ করে বেঁচে যেতে পারবেন। আর আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন তো খারাপ কাজ করা হিরোই ছিল – টেলিভিশনে রবিনহুড দেখাত তখন, সে তো ডাকাত ছিল!

৩। টিভিতে যেসব সহিংসতা দেখান হয় তার অর্ধেকের বেশিতে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে – যদি আসলেই কেউ এগুলো বাস্তবে করতে যায়, তবে সে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। পড়েন নাই পেপারে, এসব করতে গিয়ে বাচ্চারা নিজে মরে গেছে বা অন্যকে মেরে ফেলেছে?

৪। ৪০% সহিংসতার ভেতর আবার হাস্যরস থাকে। অর্থাৎ একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে কিন্তু আপনি হাসছেন।

৫। টিভিতে যা দেখান হয় তার মাঝে ৬০% সহিংসতা থাকে এবং ৬০%র বেশি অংশে আক্রমণাত্মক আচরণ থাকে – তবে এটা কিন্তু ১৯৯৯এর কথা। এখন আরও বেশি হবে। বাচ্চারা যদি দিনে দুই ঘন্টা করে কার্টুন দেখে তাহলে বছরে তারা ৫০০ সহিংস আচরণ দেখবে, যা তাদের ভেতর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্ম দেবে।

এখানে হামযা ইউসুফ নিজে আরও কিছু ডাটা দিচ্ছেন। আমেরিকায় ১৫-২০ বছর বয়সী যে সব বাচ্চারা মারা যায় তাদের মৃত্যুর কারণের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ‘খুন’। আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের মাঝে এটা প্রথম কারণ। আমেরিকায় প্রতি পাঁচ মিনিটে সহিংসতা ঘটানোর জন্য একটা বাচ্চাকে অ্যারেস্ট করা হয় এবং বন্দুকের ব্যবহার থেকে প্রতি তিন ঘণ্টায় একটা বাচ্চা মারা যায়। আমেরিকায় ৪৮৮১টা সন্ত্রাসী দল আছে যাদের সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে বড় হওয়া একটা বাচ্চার চেয়ে ওয়াশিংটন ডিসি বা শিকাগোতে বড় হওয়া একটা বাচ্চার খুন হওয়ার সম্ভাবনা ১৫গুণ বেশি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের কথা কেন বলছেন উনি? কারণ সেখানে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আই.আর.এ. আছে কিন্তু তাদের আক্রমণে বাচ্চারা মরে না, অথচ আমেরিকায় বাচ্চারা মরছে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে কিশোর বয়সীদের আত্মহত্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন? ৬০এর দশক থেকেই কিন্তু টিভি এসেছে! এরপর হামযা ইউসুফ বলছেন, দুই লক্ষ সত্তুর হাজার বাচ্চা প্রতিদিন স্কুলে বন্দুক নিয়ে আসে। আমাদের দেশে এরকম হয় না, কিন্তু আমাদের দেশেও কিশোর কিশোরকে মোবাইল ফোনের জন্য হত্যা করেছে। এটা পেপারে উঠেছে। “ওর আছে, আমার নাই!” – এ জন্য মেরে ফেলেছে! আমেরিকায় প্রতি ১৫টা বাচ্চার মাঝে একজনের বাবা অথবা মা কেউ একজন জেলে আছে। এই সব কিছুর পেছনে টিভি বিষয়ক ব্যপারকে দায়ী করা হচ্ছে।

এখন হামযা ইউসুফ যেখানে পড়াশোনা করেছেন, মৌরিতানিয়া, সেখানকার কথা বলছেন। আর সব ইসলামী সমাজের মতো এখানেও মৌখিক সংষ্কৃতি বিরাজ করত, অর্থাৎ শোনার মাধ্যমে মুখে মুখে প্রচারের প্রক্রিয়া ছিল; আমাদের কুরআন মুখস্ত করা, হাদীসের বিস্তার এ সবই মৌখিক সংষ্কৃতির মাধ্যমেই হয়েছে। আর মুরব্বীদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। আমরা এখন একটা মুরব্বীহীন সমাজে পরিণত হয়েছি। আগে পাড়ার সবচেয়ে অথর্ব বৃদ্ধকে দেখলেও ছেলেরা সিগারেট ফেলে দিত! আর এখন মুরুব্বীর মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ছে কিশোরেরা। এরপর উনি বলছেন যে, তার পড়াশোনার সময়কালে সেখানে টিভি ছিল না। দশ বছর পর উনি যখন সেখানে আবার গেলেন, তখন আগের দেশটা আর নেই! সেটা অন্যরকম হয়ে গেছে! কেন? যে আতিথেয়তা, মানুষের সাথে কথা বলা – উনি আগে পেয়েছিলেন – সেটা এখন আর নেই। এখন টিভির কারণে মানুষের আর সময় নেই তো, তাই! সেখানে মানুষের সাথে মেলামেশা, কথা বলা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং সবার মাঝে কিভাবে আমেরিকায় যাওয়া যায়, বড়লোক হওয়া যায় ও সেখানে গিয়ে টিভিতে যা কিছু দেখায় সব কিনে ফেলা যায় এই তাড়না প্রবল হয়েছে। আমাদের দেশে একই অবস্থা না এখন? একদম একই অবস্থা! আর একটা বিশাল পার্থক্য তিনি দেখেছেন যা হোল টিভির আবির্ভাবের বদৌলতে মানুষের মাঝে “পশ্চিমা আচরণ” বিরাজ করছে – অন্যের জন্য তাদের কাছে সময় কমে গেছে। বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য মানুষের কাছে এখন আর সময় নেই।

আমরা আজ এখানেই শেষ করছি। আমরা যেন এখান থেকে বোঝার চেষ্টা করি, চিন্তা করি আমরা কী হারিয়ে ফেলছি এবং আমরা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে টিভি আমাদের মাঝে যা এনে দিচ্ছে তা ইসলামবিরোধী ও অনৈসলামিক জীবনযাত্রা।

প্রতিলিপি লিখেছেন রাবেয়া রাওশিন।

এই লিংক থেকে আপনারা ডাউনলোড করে নিতে পারেন সম্পূর্ণ  অডিও লেকচারটি ।

আপনার সন্তান থেকে আপনি কী চান?

$
0
0

125098-christmas-gift

লেখকঃ আহমেদ রফিক

গাজিপুর থেকে ঢাকা ফিরছিলাম। বাসে উঠে বসলাম। কিছুক্ষন পর এক মুরব্বী উঠে আমার পাশেই বসলেন। আমি সালাম দিলাম। স্নিগ্ধ কোমল চেহারা। শ্বেত-শুভ্র লম্বা দাড়ি। দেখলেই শ্রদ্ধা করতে ইচ্ছা করে। বয়সের ভারে বেশ ন্যুজ বোঝা যায়। যেন জোর করেই লুকোনোর চেষ্টা। কালো প্যান্ট সাদা শার্ট পরা। ইন করা। হাতে একটি এক্সিকিউটিভ ফাইল। কাগজ-পত্র ভরা।

কিছুক্ষন পর তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বাবা আপনার নাম? নাম বললাম। জিজ্ঞেস করলেন কী করেন? সংক্ষেপে বললাম। জিজ্ঞেস করলেন, কোথায় থাকেন। বললাম। জানতে চাইলেন বাসায় কে কে আছে।

বললাম, আলহামদু লিল্লাহ সবাই আছে। বাবা-মা, স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে।

প্রশ্ন করলেন, ছেলে মেয়ে ক’টা? বললাম, আলহামদু লিল্লাহ আমার মোট ছয় ছেলে-মেয়ে। চারটা ছোট, আর দু’জন বড়।

মনে হয় তিনি পুরো কথাটা ধরতে পারেননি। বললেন, কী বলছেন?

বললাম, হ্যা চাচা, আমার নিজের চার ছেলে-মেয়ে। দুই মেয়ে, দুই ছেলে। আর বুড়ো দুই সন্তান হলেন আমার বাবা মা।

জিজ্ঞেস করলেন, বাবা মা কি আপনার সাথেই থাকেন?

বললাম, সব সময় থাকেন না। মানুষের ভীড়ে ঢাকা শহরে বাবার না কি দম বন্ধ হয়ে আসে। উনি গ্রামেই থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। তাই বাবা মা গ্রামেই থাকেন। কিন্তু নাতীদের টানে আবার গ্রামেও তাদের মন টেকে না। তাই এখন এখানেই আছেন। সারাক্ষন নাতী-নাতনীদের নিয়ে থাকেন। দেখছি, এখানেই ওনারা বেশ আনন্দে আছেন আলহামদু লিল্লাহ। তাই আমিও ওনাদেরকে আর গ্রামে যেতে দিতে চাই না। মাঝে-মধ্যে গ্রামের বাড়িঘর, জায়গা-জমি দেখা শোনার জন্য গিয়ে কিছু দিন থেকে আবার চলে আসবেন।

বললাম, চাচা আপনি আমার বাবার চেয়েও বয়সে অনেক বড় হবেন মনে হয়। আমাকে তুমি করে বলেন। আপনার মুখে ‘আপনি’ করে শুনতে আমার আন-ইজি লাগছে।

বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, থ্যাংক ইউ।

কথা বলতে বেশ ভালোই লাগছিলো ভদ্রলোকের সাথে। দেখলাম, উনি আর কিছু জিজ্ঞেস করছেন না। অগত্যা আমিই জানতে চাইলাম ওনার কথা। কী করেন, ছেলে-মেয়ে ক’টা, কী করে ইত্যাদি।

ছেলে-মেয়েদের কথা বললেন। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, অ্যামেরিকাতে থাকে। মেঝ ছেলে এই দেশেরই একজন উপ-সচিব। এর পর তার আরেকটি মেয়েও আছে। সে যুক্তরাজ্যে স্বামীর সাথে থাকে; সেখানকার নাম করা একটি কলেজের শিক্ষক। তিনি নিজে একটি সি.এ ফার্মে অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কাজ করেন।

এরপর কিছুক্ষন নিরবে কেটে গেলো। আমি মনে হয় অন্য কিছু চিন্তা করছিলাম, না যেন ফোনে কথা বলছিলাম।
হঠাৎ ফিরে দেখলাম ভদ্রলোক চোখ মুছছেন। পানি বেয়ে পড়ছে গণ্ড বেয়ে। আমি ভাবলাম, শরীরে কোনো আঘাত-টাঘাত পেয়েছেন হয়তো। বললাম, চাচা কী হয়েছে? বললেন, কিছু না বাবা।

আমি বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। কী করবো, কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। বললাম, চাচা কিছু মনে না করলে আমাকে বলুন কী হয়েছে? কিছুক্ষণ হাতের রুমালে চোখ চেপে রেখে, কী হয়েছে সেটা না বলে তিনি বললেন, ‘তোমার বাবা-মা সত্যিই সৌভাগ্যবান’।

বললাম, আলহামদু লিল্লাহ। দোয়া করবেন, যেন আজীবন ওনাদের খিদমত করে যেতে পারি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, চাচা আপনার এই বয়সে এভাবে বাসে দৌড়-ঝাপ করে চলাফেরা করতে কষ্ট হয় না? কেনই বা করেন? আপনার ছেলে-মেয়েরা তো সব সুপ্রতিষ্ঠিত, স্বচ্ছল!

বললেন, কষ্ট তো হয়ই বাবা, কিন্তু না করেও তো উপায় নেই!

বললাম, কেন, আপনার সন্তানরা…?

বললেন, তাদের সময় নেই খোজ খবর নেওয়ার। তারা তাদের নিজেদের জীবন-ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যাস্ত যে সময়ই পায় না। টাকা-পয়সাও পাঠায় না। আমার তো স্ত্রী আছে। আমার ও তার জীবনধারণের জন্য হলেও আমাকে এই বয়সে চাকুরি করতে হচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা বলে, আমি বসে থাকলে নাকি অসুস্থ অচল হয়ে পড়বো, ডায়াবেটিক প্রেসারে আক্রান্ত হবো। অতএব আমার খেটে খাওয়া উচিৎ।

আমি যেন বোবা হয়ে গেলাম। শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুজে পাচ্ছিলাম না। শুধু তাকিয়ে রইলাম কতোক্ষণ। অসহায়ের মতো। ভাবছিলাম এই আধুনিক বস্তুবাদী সেক্যুলার সমাজব্যবস্থার কথা। এখান থেকে কী তৈরি হচ্ছে! এতো মানুষকে জন্তু জানোয়ার বানানোর কারখানা হয়ে দাড়িয়েছে! কোথায় যাচ্ছি আমরা! কিসের পেছনে ছুটে চলছি। কোথায় হারিয়ে গেলো আমাদের শান্তির সুখ পাখিটি? কোথায়? কে দায়ভার নেবে এই অসহায় বৃদ্ধার? কে তাকে শান্তনা দেবে? কে রুমালটা এগিয়ে দেবে অন্তত, তার চোখের জলটুকু মোছার?

বললাম, চাচা দোয়া করেন ছেলে-মেয়েদের জন্য, আল্লাহ ওদেরকে সঠিক বুঝ দান করবেন। চাচা বললেন, দোয়া তো করি, কিন্তু দোয়া তো কবুল হচ্ছে না…।. বললাম চাচা দোয়া করতে থাকেন। দোয়া আল্লাহ নিশ্চয়ই কবুল করেন; যদি তা সঠিকভাবে হয়। এই দেখুন, আমার বাবাকে আমি ছোট সময় থেকে দেখেছি, তিনি আল্লাহর কাছে কেবল একটিই দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানকে খাটি মুসলিম বানাও, দ্বীনদার বানাও। আমি কতোটুকু দ্বীনদার খাটি মুসলিম হতে পেরেছি তা জানি না। ভুল-ত্রুটি, গুনাহ খাতা তো হর হামেশাই করে ফেলি। কিন্তু বাবা-মায়ের খেদমত করার চেষ্টা করি আপ্রান। এটা শুধু বাবা-মা’র সন্তুষ্টির জন্যই যে করি—তা নয়; বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করি মুলত। কারণ আমার দ্বীন, আমার ইসলাম আমাকে এটা শিখিয়েছে চাচা। আমার দ্বীনই আমাকে শিখিয়েছে যে, বাবা মা যে সন্তানের উপর সন্তুষ্ট নয় আল্লাহ তার উপর সন্তুষ্ট নন।

দেখুন চাচা, আমার বাবা অনেক পয়সাওয়ালা মানুষ ছিলেন না। অনেক আবদারই অনেক সময় পুরণ করতে পারেন নি। তথাকথিত নামি-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও লেখা-পড়া করাতে পারেননি হয়তো। সামর্থ্যে যতোটুকু ছিলো চেষ্টা করেছেন। আমি হয়তো অ্যামেরিকান কোনো ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হয়নি, অন্তত বাবা-মা’র চক্ষু-শীতলকারী সন্তান হতে পেরেছি, আলহামদু লিল্লাহ। আল্লাহর কাছে দোয়া করি, যেন আজীবন ওনাদের চক্ষু শীতলকারী হয়ে থাকতে পারি।

চাচা অপলক তাকিয়ে আছেন। বললাম, চাচা, আপনার দোয়াও নিশ্চয়ই কবুল হয়েছে। আপনি মনে করুন তো, আপনার সেই তরুণ বয়সের কথা। যখন আপনার সন্তানগুলো জন্মগ্রহণ করেছিলো। আপনি তাদের লেখা-পড়া, ভবিষ্যত নিয়ে কতো চিন্তিতো ছিলেন! কতো উদ্বিগ্ন! দোয়া কি করতেন না তখন? অবশ্যই করতেন। মনে করুন তো কী দোয়া করতেন?

চাচা বললেন, হ্যা বাবা! দোয়া করতাম তারা যেন বড় হয়, শিক্ষিত হয়। সমাজে আমার মুখ উজ্জ্বল করে। সম্মানজনক জীবন যাপন করতে পারে…।

বললাম, চাচা দেখেন, আপনার দোয়া কিন্তু কবুল হয়েছে! আপনি যা চেয়েছিলেন তা কিন্তু হয়েছে। তারা বড় শিক্ষিত হয়েছে, সমাজে আপনার মুখও উজ্জ্বল করেছে। ভালো করে মনে করে দেখেন চাচা, আপনার সন্তানদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে কিন্তু আপনি গুরুত্ব দেননি। তাদেরকে মহান স্রষ্টা আল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়াকে গুরুত্ব দেননি। কখনো হাত তুলে এই বলে কান্নাকাটি করেননি যে, হে আল্লাহ! তুমি আমার সন্তানদেরকে ভালো দ্বীনদার বানাও, ভালো মুসলিম বানাও, ঈমানদার বানাও। কখনো বলেননি, রব্বানা, হাব লানা মিন আযওয়াজিনা ওয়া যুররিয়্যাতিনা কুররাতা আ’ইউন, ওয়াজ ‘আলনা লিল মুত্তাকীনা ইমামা।

চাচা দেখুন, আমরা যারা পিতা-মাতা, আমরা কিন্তু দাতা নই, আয়োজক মাত্র। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে খাদ্য-খাবার, পোষাক আশাক যা কিছুই দেই না কেন, আমরা কিন্তু নিছক ব্যবস্থাপক। মুল দাতা হলেন মহান দয়ালু ও রিজিকদাতা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা। আমরা যদি মুল মালিকের প্রতি তাদেরকে কৃতজ্ঞ হতে না শিখাই, তাহলে কিভাবে আশা করতে পারি যে, তারা আমাদের প্রতি শেষ পর্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকবে?

চাচা এই যে বৃদ্ধ বাবা-মা’র যত্ন না নেওয়া এটা কি মানবতার জন্য একটি বিপর্যয় নয়?

চাচা বললেন, এটা শুধু বিপর্যয় নয়, মহা বিপর্যয়। এটা মানুষত্যের মর্যাদা থেকে মানুষের পশুর পর্যায়ে নেমে যাওয়ার নামান্তর।

এই অসভ্যতা কোত্থেকে আমাদের মুসলিম সমাজে এসেছে জানেন চাচা? এসেছে বস্তুবাদীতা থেকে, পশ্চিমা অসভ্যতা থেকে। মুসলিম দেশে কখনো কোনো মানুষ পালার খোয়াড় ছিলো না। আজ আমরা তাদেরকে আমাদের চরম পরম আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমাদের দেশেও এখন এই খোয়াড় ব্যবস্থা এসেছে। গুড়োদের খোয়াড়, বুড়োদের খোয়াড়। বাংলায় বললে কেমন যেন অসভ্যতা নগ্ন হয়ে ধরা পড়ে যায়। তাই আদুরে নামে এরা ইংলিশে বলে ‘ডে কেয়ার’ বা ‘ওল্ড হোম’।. শিশুকালে আপনি সন্তানকে ডে কেয়ারে রাখবেন, বুড়ো হলে তারা আপনাদেরকে ওল্ড হোমে রেখে আসবে।

দ্বীনদার না হওয়া সত্ত্বেও অনেকে হয়তো মানবিক বোধ থেকে বাবা মা’র খোজ-খবর রাখতে পারেন, দেখা-শোনা করতে পারেন। কিন্তু একজন দ্বীনদার সন্তানের কাছ থেকে বাবা সত্যি কেমন আদর-যত্ন ও সম্মান শ্রদ্ধা পেতে পারেন তা কেবল সেই বাবা-মা’রাই জানেন, যাদের দ্বীনদার সন্তান আছে।

ঢাকায় আমি আমার স্টপেজের কাছে এসে চাচার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বললাম, চাচা আপনি মুরব্বী মানুষ, অনেক কথা বলেছি, ভুলত্রুটি মাফ করে দিয়েন। চাচার চোখ আবার ছলছল করে উঠলো। ক্ষণিকের পরিচয়ে মনে হয় অনেক আপন হয়ে পড়েছিলাম। বাস থেকে নেমেও দেখলাম, চাচা তাকিয়ে আছেন জানালা দিয়ে। আবারো হাত নাড়লাম। দোয়া করলাম, হে আল্লাহ! তুমি ভালো রেখো চাচাকে।

এ সমস্যা শুধু বাসে দেখা হওয়া এই চাচারই নয়। তিনি এই সমাজের একটি দর্পনমাত্র। আমি এমন আরো অনেক দেখেছি। আপনিও দেখেছেন নিশ্চয়ই অনেক। আপনার একই বিল্ডিং এ, পাড়ায়, মহল্লায়, আত্মিয় ও বন্ধু বান্ধবের পরিবারে। মাতাল, হিরোইন, গাজা, ডাইল সহ নানা রকম মাদকসেবী সন্তানদের ঘটনা তো অহরহ দেখবেন আপনার চারপাশে। এদের কথা না হয় বাদই দিলাম।

আমার নানা বাড়ি এলাকায় এক উকিল সাহেব ছিলেন। নাম আতাহার আলী। ছেলেকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকায় লেখাপড়া করতে। ছেলেকে টাকা পাঠাতে পাঠাতে তিনি একরকম নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। ওদিকে ছেলে এক সাদা মেয়েকে বিয়ে করে মৌজ মাস্তিতে ব্যাস্ত। বাবা ছেলের দুঃখে কাদতে কাদতে মারা গেছেন। বাবাকে দেখতেও আসেনি সে। অনেক দিন পর তার অ্যামেরিকান বৌ নিয়ে বেড়াতে এসেছিলো মাকে দেখতে। ঘন্টা দুয়েক গ্রামের বাড়িতে থেকে তার সাদা বৌ ক্লান্ত। স্বামীকে ধমক দিয়ে বলেছিলো, ‘ইট ইজ ঠু লেইট, লেটস গো…’

আপনি আপনার সন্তানকে ডাক্তার বানান, ইঞ্জিনিয়ার বানান, প্রফেসর বানান, বিজ্ঞানী বানান—কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সবার আগে যদি ভালো মুসলিম না বানান তাহলে প্রস্তুত থাকুন সে দিনের জন্য যেদিনের কান্নার কোনো শেষ নেই। এ কান্না অনেকের এই চাচার মতো, এই উকিল সাহেবের মতো দুনিয়াতেই শুরু হয়ে যায়। কারো ভাগ্যক্রমে দুনিয়াতে শুরু নাও হতে পারে। কারণ দুনিয়া মুলত সাধারণভাবে শাস্তির জায়গা নয়। শাস্তির জায়গা হলো আখিরাত। দুনিয়াতে কাউকে কাউকে আল্লাহ শাস্তি দিয়ে দেখান, যাতে অন্যরা শিক্ষা গ্রহণ করে। আল্লাহ তা ‘আলা বলেন,

জলেস্থলে যতো বিপর্যয়/অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে তা মানুষেরই হাতের কামাই। এর উদ্দেশ্য হলো তাদেরকে তাদের কৃতকর্মের কিছু ফল ভোগ করানো, যাতে তারা ফিরে আসে। [সুরা আর রূম, আয়াত ৪১]

দুনিয়াতে বেচে গেলেও আপনার এই প্রানপ্রিয় সন্তানেরা কিন্তু আখিরাতে আপনারই বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করবে আল্লাহর দরবারে। কেন আপনি তাদেরকে দ্বীন শিখাননি!

আপনার সন্তান, আপনারই সিদ্ধান্ত। তাদেরকে কি আপনি আপনার দুনিয়ার শান্তি ও জান্নাতের উসিলা বানাবেন, নাকি দুনিয়ার লাঞ্ছনা আর আখিরাতের শাস্তির কারণ বানাবেন। সেটা একান্তই আপনার সিদ্ধান্ত! হ্যা একান্তই আপনার!!!

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা

$
0
0

কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা

লেখকঃ মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

بسم الله الرحمن الرحيم

এক লোক বউ পেটায়। মেয়ের বাবা কিছু বলতে ভয় পায়। পাছে তালাক হয়ে মেয়ের দায়িত্ব না ঘাড়ে চলে আসে।

বহু পরিবারে দাম্পত্য অশান্তি। কিন্তু মেয়ের পরিবার হস্তক্ষেপ বা আলোচনায় প্রস্তুত নয়।

অনেক মুসলিম বাবাই মেয়েকে বোঝা মনে করে। তারা চায়, তাদের মেয়েরা যেকোন যুলুম-নির্যাতন মাথায় করে যে কোন মূল্যে স্বামীর ঘরে পড়ে থাকুক।

নির্যাতিত মেয়েরা আলেমগণের পরামর্শে আইনের সহায়তায় বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটালেও তারা বাবাদের দ্বারা পরিত্যক্ত হয় – দোষ যেন তাদেরই। এই বাবারা তাদের মেয়েদের পুনরায় বিয়ের চেষ্টা করেন না।

মেয়েদের বিয়ে দেয়া প্রাথমিকভাবে বাবার দায়িত্ব। মুসলিম বাবার অনুমোদন ছাড়া মেয়ের বিয়ে বিশুদ্ধ নয়। অবশ্য তিনি উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিয়ে দিতে অস্বীকার করলে সেক্ষেত্রে ভিন্ন পন্থা আছে। যাহোক, এই বিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে বাবারা তাদের দায়িত্ব পালন করেন না। বাবারা মেয়ের বিয়ের পরিবর্তে বেশি আগ্রহী নিজের স্ট্যাটাস ঠিক রাখতে। ফলে ডাক্তার মেয়ের সাথে ডাক্তার ছেলে ছাড়া তিনি বিয়ে দেবেন না, যদিও বা মেয়ে রাজি। সুন্দর মেয়ের সাথে ততোধিক সুন্দর ছেলে ছাড়া বিয়ে হবে না, যদিও মেয়ের আপত্তি নেই। নিজ অঞ্চলের ছেলে ছাড়া বিয়ে হবে না, যদিও বা মেয়ে দু-পায়ে খাড়া। মেয়ের বিয়ের বয়স হলেও পড়া শেষ হওয়ার আগে বিয়ে দেবেন না, যদিও মেয়ে বিয়ের জন্য ব্যাকুল।

এই বাবাদেরকে অনুরোধ, মেয়ের প্রতি দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করুন।কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার ধ্যান-ধারণা থেকে বেরিয়ে আসুন। আপনার মেয়ে আপনার কাছে আল্লাহ তাআলার দেয়া আমানত, তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত দায়-দায়িত্ব জেনে নিন, শিখে নিন। তাকে কাজ করতে পাঠাবেন না। সে আপনার পাতে ভাগ বসাবে, এই ভয়ে তাকে যুলুমের মুখে ঠেলবেন না। নিজের স্বার্থে তার বিয়েকে বিলম্বিত করবেন না, কিংবা তার অপছন্দনীয় বা অপাত্রে বিয়ে দেবেন না। একদিন আপনাকে আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে হবে, সেদিনের জবাবদিহিতা অত্যন্ত কঠিন, আজই সাবধান হোন।

একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করি। এক বিবাহযোগ্য মেয়ের বিয়ে তার বাবার গড়িমসিতে বিলম্বিত হতে থাকে। একের পর এক উপযুক্ত পাত্র প্রত্যাখ্যাত হতে থাকে বাবার লোভের কারণে। শেষ পর্যন্ত মেয়ে কোন এক রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। মৃত্যুকালে সে বাবার বিরুদ্ধে দোয়া করেছিল: যেমনিভাবে তিনি আমাকে দাম্পত্য সম্পর্কের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করেছেন, সেভাবে আপনি তাকে জান্নাতের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করুন হে আল্লাহ! কেমন কেটেছে এই বাবার বাকি জীবন? সবাই ভেবে দেখি।

যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম

$
0
0

ideal-muslimলেখকঃ মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

بسم الله الرحمن الرحيم

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

الْمُسْلِمُ مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ وَالْمُهَاجِرُ مَنْ هَجَرَ مَا نَهَى اللَّهُ عَنْهُ

যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ, সে-ই প্রকৃত মুসলিম৷ আর যে আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো পরিত্যাগ করে, সে-ই প্রকৃত হিজরতকারী৷ হাদীসটি ইমাম বুখারী বর্ণনা করেছেন৷

ইমাম মুসলিম এর প্রথম অংশ বর্ণনা করেছেন৷

অর্থাৎ একজন মুসলিম তার কথা কিংবা কাজের দ্বারা অপর মুসলিমকে কষ্ট দেয় না৷ যে নিন্দা করা, গালমন্দ করা, দোষ বর্ণনা করা, অপবাদ দেয়া, আক্রমণ করা কিংবা উপহাস করার মাধ্যমে মানুষকে কষ্ট দেয়, তার জিহ্বা থেকে মানুষ নিরাপদ নয়৷ তেমনি যে কাউকে আঘাত করা, হত্যা করা, কারও সম্পদ হরণ করা ইত্যাদির মাধ্যমে কাউকে কষ্ট দেয়, তার হাত থেকে মানুষ নিরাপদ নয়৷ অবশ্য জিহ্বা বা হাতের দ্বারা কষ্ট দেয়ার বিষয়টি আরও ব্যাপক হতে পারে, যেমন কাউকে জিহ্বা কিংবা হাতের অঙ্গভঙ্গির দ্বারা কষ্ট দেয়া৷ আবার কখনও মানুষ পরোক্ষভাবে অন্যের কষ্টের কারণ হয় – তারাও এই হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হবে৷ যেমন কোন মজলিসে কেউ একজন ব্যক্তিকে উল্লেখ করে যেন অন্যরা তার দোষ আলোচনা করতে পারে৷ কেউ লোক ভাড়া করে কাউকে হত্যা করায়, কারও জমি দখল করে নেয়, কারও সম্পদের ক্ষতি করে ইত্যাদি৷

এই হাদীসে মানুষকে কষ্ট না দেয়ার বৈশিষ্ট্যকে সরাসরি ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে: এই বৈশিষ্ট্য যার নেই, তার যেন ইসলামই নেই! যদিও এখানে ইসলাম সম্পূর্ণ না থাকা উদ্দেশ্য নয়, বরং উদ্দেশ্য ইসলামের পূর্ণতা না থাকা তথা ঘাটতি থাকা৷ অর্থাৎ ইসলামের অন্যান্য বিধান পালনের পাশাপাশি যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিমরা নিরাপদ হবে, তার ইসলাম পরিপূর্ণ হবে, নতুবা তার ইসলামে অপূর্ণতা থেকে যাবে৷ এজন্য হাদীসের কোন কোন ভাষ্যে এসেছে, নবীকে প্রশ্ন করা হল:

أَيُّ الْإِسْلَامِ أَفْضَلُ
কোন ইসলাম সর্বোত্তম?

অথবা

أَىُّ الْمُسْلِمِينَ خَيْرٌ

মুসলিমদের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ? 

এর জবাবে তিনি এই কথাটি বলেছিলেন৷

এই হাদীস থেকে বোঝা যায় যে একজন মুসলিমের জান, মাল ও সম্মান অলংঘনীয়। এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিদায় হজ্জ্বের ভাষণে বলেছিলেন:

إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ وَأَعْرَاضَكُمْ بَيْنَكُمْ حَرَامٌ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِكُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا

নিশ্চয়ই তোমাদের পরস্পরের জান, মাল ও সম্মান ঠিক তেমনি অলংঘনীয় যেমনিভাবে তোমাদের এই নগরীতে [অর্থাৎ মক্কা নগরী] এই মাসের এই দিনটি [অর্থাৎ যিলহজ্জের ১০ তারিখ] পবিত্র৷

অপর হাদীসে তিনি বলেন:

كُلُّ الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ

প্রত্যেক মুসলিমের ওপর অপর মুসলিমের জীবন, সম্পদ ও সম্মান অলংঘনীয়৷

আজ মুসলিমদের মধ্যে সালাত, সাওম, যাকাত, হজ্জ্ব জাতীয় অনুষ্ঠানগুলো পালনের গুরুত্ব যতটা আলোচিত ও উপলুব্ধ হয়; মানুষের জান, মাল ও সম্মানের নিরাপত্তার গুরুত্ব ততটা আলোচিত কিংবা উপলুব্ধ হয় না৷ এজন্য মানুষ অপরের গীবত বা পরচর্চা, অন্যকে নিয়ে ঠাট্টা-উপহাস করে কার্টুন আঁকা, পত্র-পত্রিকায় কিংবা বক্তৃতার মঞ্চে কাউকে প্রকাশ্যে নিন্দা, গালমন্দ করা – এগুলোকে কোন অপরাধই মনে করে না। অন্যের জান-মাল হরণ করে, অন্যের ক্ষতি করেও একজন মানুষ নামায-রোযা-হজ্জ্ব পালন করে তসবী হাতে নিয়ে সমাজে ভাল মানুষ সাজতে পারে৷ ঘুষ খেয়ে, দুর্নীতি করে, জনগণের সম্পদ হরণ কিংবা ধ্বংস করেও মানুষ ভাল মুসলিম থাকতে পারে!

উপরোক্ত হাদীসটি তাই আমাদের অনেকের জন্যই ইসলামের মহান শিক্ষার এক নতুন দুয়ার ও অদেখা দিগন্তকে খুলে দেয়৷ ইসলামের শিক্ষা ব্যাপক, আর এর ব্যাপক শিক্ষার একটা বড় দিক জুড়ে রয়েছে মানুষের অধিকার, তাদের জান-মাল ও সম্মানের নিরাপত্তার বিষয়টি৷ এর সাথে সংশ্লিষ্ট বহু আয়াত ও হাদীস মানুষকে কষ্ট দেয়ার ফলে দুনিয়া ও আখিরাতের শাস্তি ও পরিণতি বর্ণনা করেছে এবং যারা তা থেকে বিরত থাকে, তাদের প্রতিদান বর্ণনা করেছে৷

কারও দোষত্রুটি তালাশ করা, আক্রমণ করা, গালমন্দ করা, কিংবা আঘাত করা, নির্যাতন করা, সম্পদ হরণ করা থেকে যারা সতর্ক – এটি তাদের অন্তরের পরিচ্ছন্নতার প্রমাণ৷ যারা আল্লাহর ভয়ে মানুষকে তাদের জিহ্বা ও হাতের আঘাত থেকে রেহাই দেয়, তারা ইসলামের অন্যান্য অনুষ্ঠানগুলোও যথাযথভাবে পালন করবে – এটাই অধিক সম্ভাব্য৷ এর বিপরীতে, ইসলামের বাহ্যিক অনুষ্ঠানগুলো পালন করাই অন্তরের পরিচ্ছন্নতার প্রমাণ নয়৷

এই হাদীসটিতে আরও রয়েছে প্রকৃত হিজরতের পরিচয়৷ হিজরত বলতে সাধারণভাবে আল্লাহর রাস্তায় দেশত্যাগ করাকে বোঝায়৷ অর্থাৎ হিজরত হল দ্বীনকে রক্ষা করার জন্য অবিশ্বাসীদের ভূমি ত্যাগ করে মুসলিমদের ভূমিতে বসতি-স্থাপন৷ যে হিজরত করে, তাকে মুহাজির বলা হয়৷ এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নতুন এক প্রকার হিজরতের পরিচয় তুলে ধরেছেন, যা আরও ব্যাপক – যা প্রতিনিয়ত সকলকেই করতে হয় – আর তা হল আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ বিষয়গুলোকে ত্যাগ করা৷ যে আল্লাহর অবাধ্যতাকে ত্যাগ করে তাঁর আনুগত্যের গণ্ডীতে প্রবেশ করে – সে-ই প্রকৃত মুহাজির৷ পাপ পরিত্যাগ করা হল সেই হিজরত যা সবাই সবসময় করতে পারে, বরং তা করতে তারা আদিষ্ট৷

এই হাদীস থেকে আমরা যে শিক্ষাগুলো পাই তা সংক্ষেপে এই:

১. ইসলাম ও ঈমানের স্তরের তারতম্য হয়৷ কারও ইসলাম পূর্ণ, কারও অপূর্ণ৷ কারও ইসলাম অপরের থেকে উত্তম৷

২. ভাল কাজের তারতম্য অনুসারে ইসলামের স্তরের তারতম্য হয়৷

৩. ইসলাম শুধু বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং ইসলামের শিক্ষা মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও লেনদেনের গভীরতম বিষয়গুলোকে স্পর্শ করেছে৷

৪. কথা কিংবা কাজের দ্বারা মুসলিমদেরকে কষ্ট দেয়া থেকে বিরত থাকা ইসলামের একটি অন্যতম শিক্ষা৷ যার মধ্যে এই বৈশিষ্ট্য নেই, তার ইসলাম অপূর্ণ৷

৫. কথার ব্যাপারে খুব সতর্ক ও সচেতন হওয়া উচিৎ৷

৬. পাপকাজ পরিত্যাগ করাই প্রকৃত হিজরত৷

৭. দ্বীনের বাহ্যিক আচার-অনুষ্ঠানকে যথার্থভাবে আদায়ের চেষ্টার পাশাপাশি অন্তরের অবস্থার দিকেও আমাদের মনোযোগী হওয়া উচিৎ৷

………………………

১ বুখারী হাদিস নং – ৬৭, মুসলিম হাদিস নং – ১৬৭৯, মুসনাদে আহমাদ হাদিস নং – ২০৪০৮ ৷
২ রিয়াযুস স্বা-লিহীন – ২৪০, সহীহুল বুখারী ৫১৪৪, ৬০৬৬, মুসলিম ২৫৬৩, ২৫৬৪, তিরমিযী ১১৩৪, ১৯৮৮, নাসায়ী ৩২৩৯, ৪৪৯৬, ৪৫০৬, ৪৫০৭, ৪৫০৮, আবূ দাউদ ৩৪৩৮, ৩৪৪৩, ৪৯১৭, ইবনু মাজাহ ১৮৬৭, ২১৭২, ২১৭৪, আহমাদ ৭৬৭০, ৭৮১৫, ৮০৩৯, ২৭৩৩৪, ১০৫৬৬, মুওয়াত্তা মালিক ১৩৯১, ১৬৮৪৷

পরিবার বিষয়ক প্রবন্ধ –স্বামী-স্ত্রীর দ্বন্দ্ব

$
0
0

4cbc5d5286d9b76a3e020000

লেখকঃ ড. সালেহ ইবন আবদিল্লাহ ইবন হুমাইদ | অনুবাদ : মোঃ আমিনুল ইসলাম |  সম্পাদনা : ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া

পর্ব – ১ | পর্ব – ২

بسم الله الرحمن الرحيم

ভূমিকা

সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সৃষ্টি করেন, অতঃপর সুঠাম করেন, যিনি নির্ধারণ করেন, অতঃপর পথনির্দেশ করেন; আমি তার প্রশংসা ও পবিত্রতা বর্ণনা করছি। তিনি শেষে ও প্রথমে সকল প্রশংসার প্রাপ্য মালিক। আর আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কোনো সত্য ইলাহ নেই, যাঁর কোনো শরীক নেই; আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আমাদের নেতা ও নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল, যিনি নির্বাচিত নবী ও বান্দা; আল্লাহ তাঁর উপর এবং তাঁর পরিবার-পরিজন, সাহাবীগণ এবং যে ব্যক্তি তাঁর দা‘ওয়াতের মাধ্যমে দা‘ওয়াত দান করে ও যে ব্যক্তি তাঁর পদ্ধতির অনুসরণে জীবনযাপন করে, সে ব্যক্তিসহ উল্লেখিত সকলের উপর রহমত, শান্তি ও বরকত বর্ষণ করুন।

অতঃপর:

জেনে রাখুন, আল্লাহ আপনাকে তাওফীক দিন— আল্লাহ তা‘আলার অন্যতম মহান নিয়ামত ও নিদর্শন হল ঘর-সংসার, যা আশ্রয়স্থল ও শান্তি নিকেতন; তার ছায়াতলে মানবগোষ্ঠী ভালবাসা ও অনুকম্পা, নিরাপত্তা ও পবিত্রতা এবং মহৎ জীবন ও শালীনতা লাভ করবে … তার কোলে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজ বেড়ে উঠবে, আত্মীয়তার সম্পর্ক বিস্তার লাভ করবে এবং পারস্পরিক দায়বদ্ধতা শক্তিশালী হবে। অন্তরের সাথে অন্তর যুক্ত হবে … এবং মনের সাথে মনের আলিঙ্গন হবে; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ هُنَّ لِبَاسٞ لَّكُمۡ وَأَنتُمۡ لِبَاسٞ لَّهُنَّۗ ﴾ [البقرة: ١٨٧]

“তারা তোমাদের পোষাকস্বরূপ এবং তোমরাও তাদের পোষাকস্বরূপ।” – ( সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৮৭ )।

এই মজবুত সম্পর্ক ও উন্নত সংসারের মধ্যে উত্তম বৈশিষ্ট্যের বিকাশ ঘটবে এবং ঐসব পুরুষ ব্যক্তিগণ বেড়ে উঠবে, যাদেরকে আমানতস্বরূপ মহান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে; আর ঐসব নারীদেরকে শিক্ষা দেওয়া হবে, যারা বংশমূল তথা জাতির ভবিষ্যতকে দেখাশুনার দায়িত্ব পালন করে।

স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্বের কতিপয় কারণ

জীবনের বাস্তবতা এবং মানুষ (যেমনটি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; আর যা তিনি সৃষ্টি করেছেন, সে সম্পর্কে তিনি সবচেয়ে বেশি ভাল জানেন) সে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে কখনও কখনও (জীবনের বাস্তবতায়) এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যাতে দিক-নির্দেশনা কাজ করে না এবং ভালবাসা ও প্রশান্তি সুদৃঢ় হয় না; যার কারণে কখনও কখনও দাম্পত্য সম্পর্ক অটুট রাখা কষ্টকর ও কঠিন হয়ে যায়। ফলে তাতে দাম্পত্য জীবনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয় না এবং তার দ্বারা নবীন সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে সমর্থ হয় না। আর এ বিশৃঙ্ল ও অনৈক্যের অবস্থা বা পরিস্থিতিসমূহের কারণসমূহ কখনও কখনও হয়ে থাকে আভ্যন্তরীণ আবার কখনও কখনও হয় বহিরাগত।

যেমন কখনও কখনও এ সমস্যার উত্থান হয়: স্বামী-স্ত্রীর অভিভাবক অথবা তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্য অনভিজ্ঞ ব্যক্তির হস্তক্ষেপ, অথবা স্বামী-স্ত্রীর সকল ছোট বড় কর্মকাণ্ডের পশ্চাদ্ধাবন; আবার কখনও কখনও পরিবারের কোনো কোনো অভিভাবক এবং পরিবারের বড়দের পক্ষ থেকে তাদের অধিনস্থদের উপর এত বেশি নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হয় যে, তা কখনও কখনও বিচারকের নিকট বিচার নিয়ে যাওয়ার পর্যন্ত গড়ায়; ফলে আড়ালে ঢাকা রহস্যসমূহ প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং গোপন বিষয়সমূহ উম্মোচন হয়ে যায়, আর এগুলো হয় নিছক ছোট-খাট বিষয় অথবা তুচ্ছ কিছু কারণে; যার উৎপত্তি হয়ত অনুপযুক্ত অথবা প্রজ্ঞাশূন্য হস্তক্ষেপ অথবা তাড়াহুড়া ও দ্রুততা অবলম্বন বা গুজব ও আজে-বাজে কথায় কান দেওয়া ও সেটাকে সত্য বলে বিশ্বাস করা।

আর কখনও কখনও সমস্যার উৎসস্থল হয়: দীনের ব্যাপারে দূরদর্শিতার স্বল্পতা ও মহানুভব শরী‘য়তের বিধিবিধানসমূহের ব্যাপারে অজ্ঞতা এবং পুঞ্জীভূত কুঅভ্যাস ও দুর্বল চিন্তাধারা লালন করা।

ফলে কোনো কোন স্বামী বিশ্বাস করে বসে যে, তালাকের দ্বারা হুমকি দেওয়া অথবা তা উচ্চারণ করা হল দাম্পত্য বিরোধ ও পারিবারিক সমস্যার একটি সঠিক সমাধান; সুতরাং সে তার প্রবেশ ও বের হওয়ার সময় এবং তার নির্দেশ প্রদান ও নিষেধাজ্ঞার সময়ে, এমনকি তার সকল অবস্থায় (স্ত্রীর সাথে) কথাবার্তার ক্ষেত্রে তালাকের শব্দগুলো ব্যতীত অন্য কিছু জানে না বা বুঝে না; আর সে এও জানে না যে, এর দ্বারা সে প্রকারান্তরে আল্লাহর আয়াতসমূহকে উপহাস হিসেবে গ্রহণ করেছে; সে তার কর্মকাণ্ডে অপরাধী বা পাপী হচ্ছে, তার সংসার ধ্বংস করছে এবং তার পরিবার-পরিজন হারাচ্ছে।

হে মুসলিমগণ! এটাই কি দীনের ফিকহ তথা সুক্ষ্ম জ্ঞান হতে পারে?!

নিশ্চয়ই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতি যে তালাকের বিধান রয়েছে তার উদ্দেশ্য দাম্পত্য সম্পর্কের বন্ধন বা রশি কর্তন করা নয়, বরং বলা যায় যে, এ পদ্ধতির তালাক হচ্ছে এই সম্পর্ক সাময়িকভাবে আটকে রাখা এবং প্রতীক্ষা, চিন্তাভাবনা ও সংশোধনের একটি পর্যায়; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ … لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ وَلَا يَخۡرُجۡنَ إِلَّآ أَن يَأۡتِينَ بِفَٰحِشَةٖ مُّبَيِّنَةٖۚ وَتِلۡكَ حُدُودُ ٱللَّهِۚ وَمَن يَتَعَدَّ حُدُودَ ٱللَّهِ فَقَدۡ ظَلَمَ نَفۡسَهُۥۚ لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ فَإِذَا بَلَغۡنَ أَجَلَهُنَّ فَأَمۡسِكُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٍ أَوۡ فَارِقُوهُنَّ بِمَعۡرُوفٖ … ﴾ [الطلاق: ١،  ٢]

“ … তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না এবং তারাও বের হবে না, যদি না তারা লিপ্ত হয় স্পষ্ট অশ্লীলতায়। আর এগুলো আল্লাহর নির্ধারিত সীমা; যে আল্লাহর সীমা লঙ্ঘন করে, সে নিজেরই উপর অত্যাচার করে। আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন। অতঃপর তাদের ইদ্দত পূরণের কাল আসন্ন হলে তোমরা হয় যথাবিধি তাদেরকে রেখে দেবে, না হয় তাদেরকে যথাবিধি পরিত্যাগ করবে। …” – (সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১-২)।

এটাই হচ্ছে শরী‘য়ত। বরং বিষয়টি এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; নিশ্চয়ই সুন্নাত পদ্ধতিতে তালাক প্রদানের বিধানটি প্রতিকারের সর্বশেষ অস্ত্র এবং এর পূর্বে অনেকগুলো উপায় রয়েছে।

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের কতিপয় উপায়

আমার মুসলিম ভাই ও বোন:

যখন বিরোধের আলামত, অবাধ্যতা, মতানৈক্যের লক্ষণ প্রকাশ পাবে, তখন তালাক বা তালাকের হুমকি প্রদান করা তার প্রতিকার নয়।

প্রতিকারের জন্য যা দাবি করা হয়, তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল: ধৈর্য, সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বুদ্ধির ক্ষেত্রে বিভিন্নতা এবং স্বভাব-প্রকৃতির ক্ষেত্রে ভিন্নতার বিষয়টি অনুধাবন করা; সাথে আরও জরুরি হল অনেক বিষয়ে উদারতার পরিচয় দেওয়া এবং দেখেও না দেখার ভান করা; কারণ সব সময় সে যা পছন্দ ও কামনা করে, তার মধ্যে মঙ্গল ও কল্যাণ হয় না, বরং কখনও কখনও সে যা পছন্দ ও কামনা করে না, তার মধ্যেই কল্যাণ হয়; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ … وَعَاشِرُوهُنَّ بِٱلۡمَعۡرُوفِۚ فَإِن كَرِهۡتُمُوهُنَّ فَعَسَىٰٓ أَن تَكۡرَهُواْ شَيۡ‍ٔٗا وَيَجۡعَلَ ٱللَّهُ فِيهِ خَيۡرٗا كَثِيرٗا ١٩ ﴾ [النساء: ١٩] 

“আর তোমরা তাদের সাথে সৎভাবে জীবন যাপন করবে; তোমরা যদি তাদেরকে অপছন্দ কর, তবে এমন হতে পারে যে, আল্লাহ যাতে প্রভূত কল্যাণ রেখেছেন, তোমরা তাকেই অপছন্দ করছ।” – (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৯ )।

কিন্তু যখন সমস্যা প্রকাশ পাবে, পারস্পরিক দায়বদ্ধতার বন্ধনে শিথিলতা দেখা দিবে এবং স্ত্রীর পক্ষ থেকে অবাধ্যতা, তার স্বভাব চরিত্রে অহমিকা এবং তার দায়িত্ব থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রকাশ পাবে; যেমন- ঘৃণার প্রকাশ পাওয়া, স্বামীর অধিকারের ব্যাপারে কমতি করার বিষয় এবং স্বামীর মর্যাদাকে অবজ্ঞা করার বিষয় প্রকাশ করা, তখন ইসলামে এর চিকিৎসা বা প্রতিকার সুস্পষ্ট; তাতে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনোভাবেই তালাক প্রসঙ্গ আসবে না। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা সুস্পষ্ট কিতাবে বলেন:

﴿ …  وَٱلَّٰتِي تَخَافُونَ نُشُوزَهُنَّ فَعِظُوهُنَّ وَٱهۡجُرُوهُنَّ فِي ٱلۡمَضَاجِعِ وَٱضۡرِبُوهُنَّۖ فَإِنۡ أَطَعۡنَكُمۡ فَلَا تَبۡغُواْ عَلَيۡهِنَّ سَبِيلًاۗ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ عَلِيّٗا كَبِيرٗا ٣٤ ﴾ [النساء: ٣٤]

“ … আর স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও, তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাদেরকে প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না। নিশ্চয় আল্লাহ শ্রেষ্ঠ, মহান।” – (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৪ )।

তাই বুঝা গেল যে, উক্ত অবস্থার প্রতিকার হবে উপদেশ ও দিক-নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে, ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, অধিকারসমূহ স্মরণ করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এবং আল্লাহর গজব ও ঘৃণা থেকে ভয় প্রদর্শন করার মাধ্যমে; সাথে আরও প্রয়োজন বুদ্ধিমত্তা ও ধৈর্যের পথে চলার জন্য উৎসাহ প্রদান ও ভয় প্রদর্শন করা।

আর কখনও কখনও অহমিকা ও অবাধ্যতার মোকাবিলায় শয্যা বর্জন ও বয়কট করা হচ্ছে এর প্রতিকার; আপনারা লক্ষ্য করুন যে, শয্যা বর্জন করার অর্থ শয়নকক্ষ বর্জন করা নয়; … তা হল শয্যা বর্জন করা, ঘর বয়কট করা নয় … পরিবার বা সন্তান বা অপরিচিত লোকজনের সামনে নয়।

উদ্দেশ্য হল প্রতিকার করা, ঘোষণা করা অথবা অপমান করা অথবা গোপন বিষয় প্রকাশ করা নয়; বরং উদ্দেশ্য হল বর্জন ও বয়কটের মাধ্যমে অবাধ্যতা ও অহংকারের মোকাবিলা করা, যা পারস্পরিক ঐক্য, সংহতি ও সমতার দিকে পরিচালিত করে।

আর কখনও কখনও কিছু কঠোর ও রূঢ় মনোভাবের মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে; কারণ, কিছু মানুষ এমনও রয়েছে, যাদেরকে সোজা করার ক্ষেত্রে উত্তম ব্যবহার ও ভদ্র কথায় কোনো কাজ হয় না; বরং তারা এমন শ্রেণীর মানুষ যাদেরকে অধিকাংশ সময় নম্র ব্যবহার ও সহিষ্ণুতা অবাধ্য করে তোলে … সুতরাং যখন কঠোরতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যাবে, তখন অবাধ্য ব্যক্তি থেমে যাবে এবং বিক্ষুব্ধ ব্যক্তি শান্ত হয়ে যাবে।

হ্যাঁ, কখনও কখনও কিছু চাপ প্রয়োগের আশ্রয় নেয়াটাও কার্যকর প্রতিষেধক হতে পারে; আর কেনই বা সে তার আশ্রয় নিবে না, অথচ দায়িত্বের প্রতি বৈরী ভাব ও স্বভাব-প্রকৃতি থেকে বের হওয়ার মত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে যাচ্ছে?

আর সকল বিবেকবান ব্যক্তির নিকট বিদিত যে, কঠোরতা যখন সংসারের জন্য তার শৃঙ্খলা ও মজবুত বন্ধনকে ফিরিয়ে দিবে এবং পরিবারকে ফিরিয়ে দিবে ভালবাসা ও হৃদ্যতা, তখন তা নিঃসন্দেহে তালাক ও বিচ্ছেদের চেয়ে উত্তম; তা হবে ইতিবাচক, শিক্ষামূলক ও অর্থবহ সমাধান; ঘায়েল করা ও প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়; বরং তার দ্বারা অবাধ্যতাকে দমন করা হয় এবং বিশৃঙ্খলাকে সংযত করা করা হয়।

আর যখন স্ত্রী তার স্বামীর পক্ষ থেকে দুর্ব্যবহার ও উপেক্ষার আশঙ্কা করবে, তখন আল-কুরআনুল কারীম তার প্রতিকারের দিক নির্দেশনা প্রদান করে তাঁর বাণীর মাধ্যমে, আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ وَإِنِ ٱمۡرَأَةٌ خَافَتۡ مِنۢ بَعۡلِهَا نُشُوزًا أَوۡ إِعۡرَاضٗا فَلَا جُنَاحَ عَلَيۡهِمَآ أَن يُصۡلِحَا بَيۡنَهُمَا صُلۡحٗاۚ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ … ﴾ [النساء: ١٢٨]

“আর কোনো স্ত্রী যদি তার স্বামীর দুর্ব্যবহার কিংবা উপেক্ষার আশংকা করে, তবে তারা আপোস-নিষ্পত্তি করতে চাইলে তাদের কোনো গোনাহ নেই এবং আপোস-নিষ্পত্তিই শ্রেয়।” – (সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১২৮ );

প্রতিকার হবে আপোস-নিষ্পত্তি ও শান্তি স্থাপনের মাধ্যমে, তালাক ও সম্পর্ক বাতিলের মাধ্যমে নয়। আবার কখনও কখনও বিবাহ বন্ধনকে সুরক্ষার জন্য আর্থিক অথবা ব্যক্তিগত অধিকারের কিছু কিছু বিষয় ছাড় দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিকার হতে পারে।

﴿ وَٱلصُّلۡحُ خَيۡرٞۗ  ﴾ [আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম]। অবাধ্যতা, দুর্ব্যবহার, বিদ্বেষ ও তালাকের চেয়ে আপোস-নিষ্পত্তি উত্তম।

আমার মুসলিম ভাই ও বোন:

এটা একটা গতিশীল আবেদন এবং আল্লাহর দীনের ফিকহের দিক থেকে ও তাঁর বিধিবিধানের উপর ভিত্তি করে আচার-আচরণের একটি সংক্ষিপ্ত স্মারক; সুতরাং তার থেকে মুসলিমগণ কোথায় যাচ্ছে?

স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার বিরোধের ব্যাপারে কেন সালিস নিয়োগ করা হয় না?  এ সমাধান থেকে কেন সংস্কারকগণ বিরত থাকে? সে কি প্রকৃত সংশোধনের ব্যাপারে অমনোযোগী, নাকি পরিবার ভাঙ্গন ও সন্তানদেরকে বিভক্ত করার ব্যাপারে উৎসাহী?

নিশ্চয়ই আপনি তাকে নির্বুদ্ধিতা, বাড়াবাড়ি, আল্লাহর ভয় ও তাঁর নজরদারী থেকে দূরুত্বে অবস্থান, তাঁর বিধিবিধানের অধিকাংশকে প্রত্যাখ্যান এবং তাঁর নির্ধারিত সীমা রেখার ব্যাপারে ছিনিমিনি খেলা ছাড়া অন্য কিছু মনে করবেন না।

ইমাম ইবনু মাজাহ ও ইবনু হিব্বান প্রমূখ গ্রন্থকারগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন:

« ما بال أقوام يلعبون بحدود الله . يقول أحدهم : قد طلقتك . قد راجعتك . قد طلقتك ؟ أيلعب بحدود الله و أنا بين أظهركم » . ( رواه ابن ماجه و ابن حبان  ) .

“কিছু লোকের কি হল যে তারা আল্লাহর নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে; তাদের কেউ কেউ বলে: আমি তোমাকে তালাক দিলাম, আমি তোমাকে ফিরিয়ে আনলাম, আমি তোমাকে তালাক দিলাম? সে কি আল্লার নির্ধারিত সীমানা নিয়ে ছিনিমিনি খেলে, অথচ আমি তোমাদের মাঝেই রয়েছি?”[1]

দ্বন্দ্ব নিরসনের সর্বশেষ উপায়

দ্বন্দ্ব নিরসনের ব্যাপারে যখন সকল উপায় ব্যর্থ হবে এবং দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখা যখন কঠিন ও কষ্টকর হয়ে যাবে, এমনকি যখন তার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত অভিষ্ট লক্ষ্য ও মহান তাৎপর্য বাস্তবায়ন করা না যায়, তখন শরী‘য়তের উদারতা ও তার বিধানসমূহের পরিপূর্ণতার প্রমাণ হচ্ছে যে, এ সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য উপায় রাখা হয়েছে। তবে মুসলিমগণের অনেকেই শরী‘য়ত কর্তৃক অনুমোদিত সুন্নাত পদ্ধতির তালাকের সম্পর্কে অজ্ঞ এবং আল্লাহর সীমারেখা ও তাঁর শরী‘য়তের প্রতি লক্ষ্য রাখা ছাড়াই তালাক শব্দটি উচ্চারণ করে থাকে।

ঋতুবর্তীকালীন সময়ে তালাক দেয়া হারাম, (একসাথে) তিন তালাক প্রদান করা হারাম এবং এমন ঋতুমুক্তকালীন সময়ে তালাক প্রদান করাও হারাম, যাতে উভয়ের মাঝে মিলন (সহবাস) হয়েছে; সুতরাং এ ধরনের সকল তালাক বিদ‘আত ও হারাম (নিষিদ্ধ)। এ ধরনের তালাকদাতার পাপ হবে; কিন্তু আলেমগণের বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী তালাক সংঘটিত হয়ে যাবে।

যে সুন্নাত পদ্ধতির তালাক সম্পর্কে অবহিত হওয়া মুসলিমগণের উপর ওয়াজিব, তা হলো:  ঋতুমুক্তকালীন সময়ে মাত্র এক তালাক প্রদান করা যাতে উভয়ের মিলন (সহবাস) হয়নি, অথবা গর্ভকালীন সময়ের মাঝে তালাক প্রদান করা।

এ পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদান করা নিঃসন্দেহে একটি প্রতিকার হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এতে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই বেশ কিছু সময় পায়, সে সময়ে তারা চিন্তা-ভাবনা কিংবা পর্যালোচনা করতে পারে।

আর এই পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে তালাক প্রদানকারীকে ঋতুমুক্তকালীন সময়ের আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছে; আর হতে পারে যে, তখন তার মন পরিবর্তন হবে, হৃদয় জগ্রত হবে এবং আল্লাহ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাদের জন্য নতুন কোনো উপায় করে দেবেন, ফলে তাদের সম্পর্ক তালাক পর্যন্ত গড়াবে না।

আর ইদ্দতের সময়কাল, — চাই তা মাসিক জনিত ইদ্দত হউক, অথবা নির্দিষ্ট মাসসমূহের ইদ্দত হউক, অথবা গর্ভস্থ সন্তানের প্রসব সংশ্লিষ্ট ইদ্দত হউক— এ সময়ের মধ্যে স্ত্রীকে পুনরায় ফিরিয়ে আনা ও আত্মপর্যালোচনার যথেষ্ট সুযোগ থাকে; যা কখনও কখনও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভালবাসার বন্ধন ও দাম্পত্য সম্পর্ককে মিলিয়ে দিতে পারে।

আর মুসলিমগণ যা জানে না তন্মধ্যে অন্যতম হল: স্ত্রীকে যখন রেজ‘য়ী (প্রত্যাবর্তনযোগ্য) তালাক দেওয়া হবে, তখন তার উপর আবশ্যকীয় কর্তব্য হল স্বামীর ঘরে অবস্থান করা; সে বের হবে না এবং তাকে বের করে দেওয়া হবে না।

বরং আল্লাহ তা‘আলা তাকে (স্বামীর ঘরকে) তার (স্ত্রীর) জন্য ঘর হিসেবে বরাদ্দ দিয়ে দিলেন; আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ لَا تُخۡرِجُوهُنَّ مِنۢ بُيُوتِهِنَّ ﴾ [الطلاق: ١]

“তোমরা তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে বহিষ্কার করো না” – (সূরা আত-তালাক, আয়াত:১);

এই আয়াতটি (ঘরে) অবস্থান করার বিষয়টিকে দৃঢ়তার সাথে তাদের অধিকার বলে ঘোষণা করেছে। সুতরাং তার স্বামীর ঘরে তার অবস্থান করার মানে তার পুনরায় প্রত্যাবর্তনের একটা পথ, ভালবাসার সহনুভূতি উত্থাপন করার ক্ষেত্রে আশার সূচনা এবং সম্মিলিত জীবনযাপনের বিষয়টি স্মরণ করানো। ফলে এই অবস্থায় তালাকের হুকুমের ক্ষেত্রে স্ত্রীর অবস্থান দূরে প্রতীয়মান হলেও চোখের দৃশ্যপট থেকে তার অবস্থান স্বামীর নিকটে।

আর এর দ্বারা মূলত উদ্দেশ্য হল তাদের মধ্যে ঘটে যাওয়া অশান্ত ঝড়কে শান্ত করা, হৃদয়ে নাড়া দেওয়া, অবস্থানসমূহ পুণ পর্যালোচনা এবং ধীরে-সুস্থে নিজ সংসার, শিশু ও পরিবারের সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার সুযোগ লাভ। আল-কুরআনের ভাষায়:

﴿ … لَا تَدۡرِي لَعَلَّ ٱللَّهَ يُحۡدِثُ بَعۡدَ ذَٰلِكَ أَمۡرٗا ١ ﴾ [الطلاق: ١ ]

“ … আপনি জানেন না, হয়ত আল্লাহ এর পর কোনো উপায় করে দেবেন।” – ( সূরা আত-তালাক, আয়াত: ১ )।

সুতরাং হে মুসলিমগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর … এবং তোমাদের ঘর-সংসারসমূহকে হেফাযত কর; আর তোমাদের দীনের বিধানসমূহ জানতে ও বুঝতে শিখ … আর আল্লাহর সীমারেখা যথাযথভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখ এবং তা লঙ্ঘন করো না; আর তোমারা তোমাদের নিজেদের মাঝে (সম্পর্কের) সংশোধন ও সংস্কার করে নাও।

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে দীনের ব্যাপারে সঠিক বুঝ এবং শরী‘য়তের ব্যাপারে দূরদর্শিতা দান করুন; হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার কিতাবের হিদায়াতের মাধ্যমে উপকৃত করুন; আর আপনার নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাতের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আচার-আচরণ আমাদেরকে দান করুন।


[1] সুনানু ইবনে মাজাহ: ২০১৮; সহীহু ইবনে হিব্বান: ৪২৬৫

মা-বাবার মৃত্যুর পর তাদের জন্য করণীয় আমলসূমহ

$
0
0
লেখকঃ হাবিবুল্লাহ মুহাম্মাদ ইকবাল | অনুবাদক : আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া | প্রকাশনায় : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

إن الحمد لله والصلاة والسلام على رسول الله وعلى آله وصحبه أجمعين، أما بعد

মা-বাবা ছোট শব্দ, কিন্তু এ দুটি শব্দের সাথে কত যে আদর, স্নেহ, ভালবাসা রয়েছে  তা পৃথিবীর কোন মাপযন্ত্র দিয়ে নির্ণয় করা যাবে না। মা-বাবা কত না কষ্ট করেছেন, না খেয়ে থেকেছেন, অনেক সময় ভাল পোষাকও পরিধান করতে পারেন নি, কত না সময় বসে থাকতেন সন্তানের অপেক্ষায়। সেই মা বাবা যাদের চলে গিয়েছেন, তারাই বুঝেন মা বাবা কত বড় সম্পদ। যেদিন থেকে মা বাবা দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলেন সেদিন থেকে মনে হয় কী যেন হারিয়ে গেল,তখন বুক কেঁপে উঠে, চোখ থেকে বৃষ্টির মত পানি ঝরে, কী শান্তনাই বা তাদেরকে দেয়া যায়!  সেই মা বাবা যাদের চলে গিয়েছে তারা কি মা-বাবার জন্য কিছুই করবে না?। এত কষ্ট করে আমাদের কে যে মা-বাবা লালন পালন করেছেন তাদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই? অবশ্যই আছে। আলোচ্য প্রবন্ধে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মৃত মা-বাবা জন্য কী ধরনের আমল করা যাবে এবং যে আমলের সওয়াব তাদের নিকট পৌছবে তা উল্লেখ করা হলো:

১. বেশী বেশী দু‘আ করা 

মা-বাবা দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পর সন্তান মা-বাবার জন্য বেশী বেশী দু‘আ করবে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে দু‘আ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং কী দু‘আ করবো তাও শিক্ষা দিয়েছেন । আল-কুরআনে এসেছে,

 رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [الاسراء: ٢٤]

‘‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’’ [সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৪]

رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ ٤١﴾ [ابراهيم: ٤١]

‘‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’’ [সুরা ইবরাহীমঃ৪১]

এছাড়া আলস্নাহ রাববুল আলামীন পিতা-মাতার জন্য দূ‘আ করার বিশেষ নিয়ম শিক্ষা দিতে গিয়ে বলেনঃ

 رَّبِّ ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيۡتِيَ مُؤۡمِنٗا وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِۖ وَلَا تَزِدِ ٱلظَّٰلِمِينَ إِلَّا تَبَارَۢا ٢٨ ﴾ [نوح: ٢٨

‘হে আমার রব! আমাকে, আমার পিতা-মাতাকে, যে আমার ঘরে ঈমানদার হয়ে প্রবেশ করবে তাকে এবং মুমিন নারী-পুরুষকে ক্ষমা করুন এবং ধ্বংস ছাড়া আপনি যালিমদের আর কিছুই বাড়িয়ে দেবেন না ’[সূরা নুহ: ২৮] ।

 

মা-বাবা এমন সন্তান রেখে যাবেন যারা তাদের জন্য দোয়া করবে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

« إِذَا مَاتَ الإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلاَّ مِنْ ثَلاَثَةٍ إِلاَّ مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ ».

অর্থ: মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া  ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দু‘আ করে [সহিহ মুসলিম: ৪৩১০]

মূলত: জানাযার নামায প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মৃত ব্যক্তির জন্য দু‘আ স্বরূপ।

 ২. দান-ছাদকাহ করা, বিশেষ করে সাদাকায়ে জারিয়াহ প্রদান করাঃ

মা-বাবা বেচে থাকতে দান-সাদকাহ করে যেতে পারেন নি বা বেচে থাকলে আরো দান-সদকাহ করতেন, সেজন্য তাদের পক্ষ থেকে  সন্তান দান-সদকাহ করতে পারে। হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَجُلاً أَتَى النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّىَ افْتُلِتَتْ نَفْسَهَا وَلَمْ تُوصِ وَأَظُنُّهَا لَوْ تَكَلَّمَتْ تَصَدَّقَتْ أَفَلَهَا أَجْرٌ إِنْ تَصَدَّقْتُ عَنْهَا قَالَ « نَعَمْ »

অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেনঃ ‘‘জনৈক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল আমার মা হঠাৎ মৃতু বরণ করেছেন। তাই কোন অছিয়ত করতে পারেন নি। আমার ধারণা তিনি যদি কথা বলার সুযোগ পেতেন তাহলে দান-ছাদকা করতেন। আমি তাঁর পক্ষ থেকে ছাদকা করলে তিনি কি এর ছাওয়াব পাবেন ? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন হ্যাঁ, অবশ্যই পাবেন।’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৭৩]

তবে সবচেয়ে উত্তম হচ্ছে সাদাকায়ে জারিয়া বা প্রবাহমান ও চলমান সাদাকা প্রদান করা। যেমন পানির কুপ খনন করা, (নলকুপ বসানো, দ্বীনী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা, কুরআন শিক্ষার জন্য মক্তব ও প্রতিষ্ঠান তৈরী করা, স্থায়ী জনকল্যাণমূলক কাজ করা। ইত্যাদি।

 ৩. মা-বাবার পক্ষ থেকে সিয়াম  পালনঃ

মা-বাবা জীবিত থাকা অবস্থায় যদি তাদের কোন মানতের সিয়াম কাযা থাকে, সন্তান তাদের পক্ষ থেকে সিয়াম পালন করলে তাদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ

«مَنْ مَاتَ  وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ وَلِيُّهُ»

অর্থ: ‘‘যে ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করল এমতাবস্থায় যে তার উপর রোজা ওয়াজিব ছিল। তবে তার পক্ষ থেকে তার ওয়ারিসগণ রোজা রাখবে’’ [সহীহ বুখারী:১৯৫২]।

অধিকাংশ আলেমগণ এ হাদীসটি শুধুমাত্র ওয়াজিব রোযা বা মানতের রোযার বিধান হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের পক্ষ থেকে নফল সিয়াম রাখার পক্ষে দলীল নাই।

 ৪. হজ্জ বা উমরাহ করাঃ

মা-বাবার পক্ষ থেকে হজ্জ বা উমরাহ করলে তা আদায় হবে এবং তারা  উপকৃত হবে। ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«أَنَّ امْرَأَةً مِنْ جُهَيْنَةَ جَاءَتْ إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَتْ إِنَّ أُمِّي نَذَرَتْ أَنْ تَحُجَّ فَلَمْ تَحُجَّ حَتَّى مَاتَتْ أَفَأَحُجُّ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ حُجِّي عَنْهَا أَرَأَيْتِ لَوْ كَانَ عَلَى أُمِّكِ دَيْنٌ أَكُنْتِ قَاضِيَةً اقْضُوا اللَّهَ فَاللَّهُ أَحَقُّ بِالْوَفَاءِ»

অর্থ: ‘‘ জুহাইনা গোত্রের একজন মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আগমণ করে বলল, হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা হজ্জ করার মানত করেছিলেন কিন্তু তিনি হজ্জ সম্পাদন না করেই মারা গেছেন। এখন আমি কি তার পক্ষ থেকে হজ্জ আদায় করতে পারি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তুমি তোমার মায়ের পক্ষ থেকে হজ্জ কর। তোমার কি ধারণা যদি তোমার মার উপর ঋণ থাকতো তবে কি তুমি তা পরিশোধ করতে না ? সুতরাং আল্লাহর জন্য তা আদায় কর। কেননা আল্লাহর দাবী পরিশোধ করার অধিক উপযোগী’’ [সহীহ বুখারী: ১৮৫২]

তবে মা-বাবার পক্ষ থেকে যে লোক হজ্জ বা ওমরাহ করতে চায় তার জন্য শর্ত হলো সে আগে নিজের হজ্জ-ওমরাহ করতে হবে।

 ৫. মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করাঃ

মা-বাবার পক্ষ থেকে কুরবানী করলে তার ছাওয়াব দ্বারা তারা উপকৃত হবে। এ বিষয়ে হাদীসে এসেছে,

عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَمَرَ بِكَبْشٍ أَقْرَنَ يَطَأُ فِى سَوَادٍ وَيَبْرُكُ فِى سَوَادٍ وَيَنْظُرُ فِى سَوَادٍ فَأُتِىَ بِهِ لِيُضَحِّىَ بِهِ فَقَالَ لَهَا « يَا عَائِشَةُ هَلُمِّى الْمُدْيَةَ » ثُمَّ قَالَ « اشْحَذِيهَا بِحَجَرٍ ». فَفَعَلَتْ ثُمَّ أَخَذَهَا وَأَخَذَ الْكَبْشَ فَأَضْجَعَهُ ثُمَّ ذَبَحَهُ ثُمَّ قَالَ « بِاسْمِ اللَّهِ اللَّهُمَّ تَقَبَّلْ مِنْ مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةِ مُحَمَّدٍ ». ثُمَّ ضَحَّى بِهِ.

অর্থ: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন একটি শিংযুক্ত দুম্বা উপস্থিত করতে নির্দেশ দিলেন, যার পা কালো, চোখের চতুর্দিক কালো এবং পেট কালো। অতঃপর তা কুরবানীর জন্য আনা হলো। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহাকে বললেন, হে আয়েশা! ছুরি নিয়ে আস, তারপর বললেন, তুমি একটি পাথর নিয়ে তা দ্বারা এটাকে ধারালো কর। তিনি তাই করলেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছুরি হাতে নিয়ে দুম্বাটিকে শুইয়ে দিলেন। পশুটি যবেহ্ করার সময় বললেন, বিসমিল্লাহ, হে আল্লাহ তুমি এটি মুহাম্মাদ, তাঁর বংশধর এবং সকল উম্মাতে মুহাম্মাদীর পক্ষ থেকে কবুল কর”। এভাবে তিনি তা দ্বারা কুরবানী করলেন। [ সহীহ মুসলিম:৫২০৩]

 ৬. মা-বাবার ওসিয়ত পূর্ণ করা

মা-বাবা শরীয়াহ সম্মত কোন ওসিয়ত করে গেলে তা পূর্ণ করা সন্তানদের উপর দায়িত্ব। রাশীদ ইবন সুয়াইদ আসসাকাফী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,

«قُلْتُ : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، إِنَّ أُمِّي أَوْصَتْ أَنْ نُعْتِقُ عَنْهَا رَقَبَةً ، وَعِنْدِي جَارِيَةٌ سَوْدَاءُ ، قَالَ : ادْعُ بِهَا ، فَجَاءَتْ ، فَقَالَ : مَنْ رَبُّكِ ؟ قَالَتِ : اللَّهُ ، قَالَ : مَنْ أَنَا ؟ قَالَتْ : رَسُولُ اللَّهِ ، قَالَ : أَعْتِقْهَا ، فَإِنَّهَا مُؤْمِنَةٌ».

অর্থ: আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম হে আল্লাহর রাসুল, আমার মা একজন দাসমুক্ত করার জন্য ওসিয়ত করে গেছেন। আর আমার নিকট কালো একজন দাসী আছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে ডাকো, সে আসল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার রব কে ? উত্তরে সে বলল, আমার রব আল্লাহ। আবার প্রশ্ন করলেন আমি কে ? উত্তরে সে বলল, আপনি আল্লাহর রাসুল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে মুক্ত করে দাও; কেন না সে মু’মিনা । [সহীহ ইবন হিববান :১৮৯]

 ৭. মা-বাবার বন্ধুদের সম্মান করা 

মা-বাবার বন্ধুদের সাথে ভাল ব্যবহার করা, সম্মান করা, তাদেরকে দেখতে যাওয়া,তাদেরকে হাদিয়া দেয়া। এ বিষয়ে হাদীসে উল্লেখ আছে,

عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ دِينَارٍ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عُمَرَ أَنَّ رَجُلاً مِنَ الأَعْرَابِ لَقِيَهُ بِطَرِيقِ مَكَّةَ فَسَلَّمَ عَلَيْهِ عَبْدُ اللَّهِ وَحَمَلَهُ عَلَى حِمَارٍ كَانَ يَرْكَبُهُ وَأَعْطَاهُ عِمَامَةً كَانَتْ عَلَى رَأْسِهِ فَقَالَ ابْنُ دِينَارٍ فَقُلْنَا لَهُ أَصْلَحَكَ اللَّهُ إِنَّهُمُ الأَعْرَابُ وَإِنَّهُمْ يَرْضَوْنَ بِالْيَسِيرِ. فَقَالَ عَبْدُ اللَّهِ إِنَّ أَبَا هَذَا كَانَ وُدًّا لِعُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ وَإِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « إِنَّ أَبَرَّ الْبِرِّ صِلَةُ الْوَلَدِ أَهْلَ وُدِّ أَبِيهِ ».

অর্থ: আব্দুল্লাহ ইবনে দীনার রাদিয়াল্লাহু আনহু আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, একবার মক্কার পথে চলার সময় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর এক বেদুঈন এর সাথে দেখা হলে তিনি তাকে সালাম দিলেন এবং তাকে সে গাধায় চড়ালেন যে গাধায় আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা উপবিষ্ট ছিলেন এবং তাঁর (আব্দুল্লাহ) মাথায় যে পাগড়িটি পরা ছিলো তা তাকে প্রদান করলেন। আব্দুল্লাহ ইবান দীনার রাহেমাহুল্লাহ বললেন, তখন আমরা আব্দুল্লাহকে বললাম: আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক! এরা গ্রাম্য মানুষ: সামান্য কিছু পেলেই এরা সন্তুষ্ট হয়ে যায়-(এতসব করার কি প্রয়োজন ছিলো?) উত্তরে আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, তার পিতা, (আমার পিতা) উমার ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বন্ধু ছিলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি “পুত্রের জন্য পিতার বন্ধু-বান্ধবের সাথে ভাল ব্যবহার করা সবচেয়ে বড় সওয়াবের কাজ’’ [সহীহ মুসলিম:৬৬৭৭]।

মৃতদের বন্ধুদের সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আমলও আমাদেরকে উৎসাহিত করে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«إِذَا ذَبَحَ الشَّاةَ فَيَقُولُ « أَرْسِلُوا بِهَا إِلَى أَصْدِقَاءِ خَدِيجَةَ »

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখনই কোন বকরী যবেহ করতেন, তখনই তিনি বলতেন, এর কিছু অংশ খাদীজার বান্ধবীদের নিকট পাঠিয়ে দাও [সহীহ মুসলিম: ৬৪৩১]

 ৮. মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক রাখা

সন্তান তার মা-বাবার আত্নীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَنْ أَحَبَّ أَنْ يَصِلَ أَبَاهُ فِي قَبْرِهِ ، فَلْيَصِلْ إِخْوَانَ أَبِيهِ بَعْدَهُ»

‘যে ব্যক্তি তার পিতার সাথে কবরে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে ভালবাসে, সে যেন পিতার মৃত্যুর পর তার ভাইদের সাথে সু-সম্পর্ক রাখে’ [সহীহ ইবন হিববান:৪৩২]

 ৯. ঋণ পরিশোধ করা

মা-বাবার কোন ঋণ থাকলে তা দ্রুত পরিশোধ করা সন্তানদের উপর বিশেষভাবে কর্তব্য। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণের পরিশোধ করার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«نَفْسُ الْمُؤْمِنِ مُعَلَّقَةٌ بِدَيْنِهً حَتَّى يُقْضَى عَنْهُ».

অর্থ: ‘‘মুমিন ব্যক্তির আত্মা তার ঋণের সাথে সম্পৃক্ত থেকে যায়; যতক্ষণ তা তা তার পক্ষ থেকে পরিশোধ করা হয়”। [সুনান ইবন মাজাহ:২৪১৩]

ঋণ পরিশোধ না করার কারণে জান্নাতের যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়; এমনকি যদি আল্লাহর রাস্তায় শহীদও হয় । হাদীসে  আরো এসেছে,

«مَا دَخَلَ الْجَنَّةَ حَتَّى يُقْضَى دَيْنُهُ»

অর্থ: যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দার ঋণ পরিশোধ না করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। [নাসায়ী ৭/৩১৪; তাবরানী ফিল কাবীর ১৯/২৪৮; মুস্তাদরাকে হাকিম ২/২৯]

 ১০. কাফফারা আদায় করা   

মা-বাবার কোন শপথের কাফফারা,ভুলকৃত হত্যাসহ কোন কাফফারা বাকী থাকলে সন্তান তা পূরণ করবে। আল-কুরআনে বলা হয়েছে,

﴿وَمَن قَتَلَ مُؤۡمِنًا خَطَ‍ٔٗا فَتَحۡرِيرُ رَقَبَةٖ مُّؤۡمِنَةٖ وَدِيَةٞ مُّسَلَّمَةٌ إِلَىٰٓ أَهۡلِهِۦٓ إِلَّآ أَن يَصَّدَّقُواْۚ ﴾ [النساء: ٩٢] 

অর্থ: যে ব্যক্তি ভুলক্রমে কোন মুমিনকে হত্যা করবে, তাহলে একজন মুমিন দাসকে মুক্ত করতে হবে এবং দিয়াত (রক্ত পণ দিতে হবে) যা হস্তান্তর করা হবে তার পরিজনদের কাছে। তবে তারা যদি সদাকা (ক্ষমা) করে দেয় (তাহলে সেটা ভিন্ন কথা) [ সূরা আন-নিসা:৯২]

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

« مَنْ حَلَفَ عَلَى يَمِينٍ فَرَأَى غَيْرَهَا خَيْرًا مِنْهَا فَلْيَأْتِهَا وَلْيُكَفِّرْ عَنْ يَمِينِهِ ».

অর্থ: ‘‘ যে ব্যক্তি কসম খেয়ে শপথ করার পর তার থেকে উত্তম কিছু করলেও তার কাফফারা অদায় করবে’’ [সহীহ মুসলিম: ৪৩৬০] ।

এ বিধান জীবিত ও মৃত সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য। দুনিয়ার বুকে কেউ অন্যায় করলে তার কাফফারা দিতে হবে। অনুরূপভাবে কেউ অন্যায় করে মারা গেলে তার পরিবার-পরিজন মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কাফফারা প্রদান করবেন।

 ১১. ক্ষমা প্রার্থনা করাঃ

মা-বাবার জন্য আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করা গুরুত্বপূর্ণ আমল। সন্তান মা-বাবার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় আল্লাহ তা‘আলা তাদের মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন। হাদীসে বলা হয়েছে,

«عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : تُرْفَعُ لِلْمَيِّتِ بَعْدَ مَوْتِهِ دَرَجَتُهُ . فَيَقُولُ : أَيْ رَبِّ ، أَيُّ شَيْءٍ هَذِهِ ؟ فَيُقَالُ : وَلَدُكَ اسْتَغْفَرَ لَكَ»

অর্থ: আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু  হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, মৃত্যুর পর কোন বান্দাহর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়। তখন সে বলে হে আমার রব, আমি তো এতো মর্যাদার আমল করিনি, কীভাবে এ আমল আসলো ? তখন বলা হবে, তোমার সন্তান তোমার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করায় এ মর্যাদা তুমি পেয়েছো’’ [আল-আদাবুল মুফরাদ:৩৬]।

মা-বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়ার পর তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার বিষয়ে উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«عَنْ عُثْمَانَ ، قَالَ : وَقَفَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى قَبْرِ رَجُلٍ وَهُوَ يُدْفَنُ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهُ قَالَ : اسْتَغْفِرُوا لأَخِيكُمْ وَسَلُوا اللَّهَ لَهُ بالثَّبَاتِ ؛ فَإِنَّهُ يُسْأَلُ الآنَ».

অর্থ: উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন এক মৃত ব্যক্তিকে দাফন করার পর তার কবরের পার্শ্বে দাঁড়ালেন এবং বললেন ‘‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর এবং তার জন্য ঈমানের উপর অবিচলতা ও দৃঢ়তা কামনা কর, কেননা এখনই তাকে প্রশ্ন করা হবে’’ [মুসনাদুল বাজ্জার :৪৪৫]।

তাই সুন্নাত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তিকে কবরে দেয়ার পর তার কবরের পার্শ্বে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার জন্য প্রশ্নোত্তর সহজ করে দেয়া, প্রশ্নোত্তর দিতে সমর্থ হওয়ার জন্য দো‘আ করা।

 ১২. মান্নত পূরণ করা 

মা-বাবা কোন মান্নত করে গেলে সন্তান তার পক্ষ থেকে পূরণ করবে। ইবন আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হাদীসে এসেছে,

«أَنَّ امْرَأَةً نَذَرَتْ أَنْ تَصُومَ شَهْرًا فَمَاتَتْ فَأَتَى أَخُوهَا النَّبِىَّ -صلى الله عليه وسلم- فَقَالَ :« صُمْ عَنْهَا ».

অর্থ: কোন মহিলা রোজা রাখার মান্নত করেছিল, কিন্তু সে তা পূরণ করার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করল। এরপর তার ভাই এ বিষয়ে  রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট আসলে তিনি বলরেন, তার পক্ষ থেকে সিয়াম পালন কর। [সহীহ ইবন হিববান:২৮০]

 ১৩. মা-বাবার ভাল কাজসমূহ জারী রাখা 

মা-বাবা যেসব ভাল কাজ অর্থাৎ মসজিদ তৈরী করা, মাদরাসা তৈরী করা, দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরীসহ যে কাজগুলো করে গিয়েছেন সন্তান হিসাবে তা যাতে অব্যাহত থাকে তার ব্যবস্থা করা। কেননা এসব ভাল কাজের সওয়াব তাদের আমলনামায় যুক্ত হতে থাকে। হাদীসে এসেছে,

«مَنْ دَلَّ عَلَى خَيْرٍ فَلَهُ مِثْلُ أَجْرِ فَاعِلِهِ »

‘‘ভাল কাজের পথপ্রদর্শনকারী এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে’’। [সুনান আততিরমীযি : ২৬৭০]

«مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ»

যে ব্যক্তির ইসলামের ভাল কাজ শুরু করল, সে এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ সাওয়াব পাবে। অথচ তাদেও সওয়াব থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহীহ মুসলিম:২৩৯৮]।

 ১৪. কবর যিয়ারত করা  

সন্তান তার মা-বাবার কবর যিয়ারত করবে। এর মাধ্যমে সন্তান এবং মা-বাবা উভয়ই উপকৃত হবে। এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«كُنْتُ نَهَيْتُكُمْ عَنْ زِيَارَةِ الْقُبُورِ فَقَدْ أُذِنَ لِمُحَمَّدٍ فِى زِيَارَةِ قَبْرِ أُمِّهِ فَزُورُوهَا فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الآخِرَةَ»

অর্থ: আমি তোমাদেরকে কবর যিয়ারত করতে নিষেধ করেছিলাম,অত:পর মুহাম্মাদের মায়ের কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়েছে। এখন তোমরা কবর যিয়রাত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমীযি :১০৫৪]।

যিয়রাত কর, কেননা তা আখেরাতকে স্মরণ করিয়ে দেয় [সুনান তিরমীযি :১০৫৪]।

কবর যিয়ারত কোন দিনকে নির্দিষ্ট করে করা যাবে না। কবর যিযারত করার সময় বলবে,

«السَّلاَمُ عَلَيْكُمْ أَهْلَ الدِّيَارِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُسْلِمِينَ ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللَّهُ بِكُمْ لاَحِقُونَ ، نَسْأَلُ اللَّهَ لَنَا وَلَكُمُ الْعَافِيَةَ».

অর্থ: কবরবাসী মুমিন-মুসলিম আপনাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক । নিশ্চয় আমরা আপনাদের সাথে মিলিত হবো। আমরা আল্লাহর কাছে আপনাদের এবং আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। [সুনান ইবন মাজাহ :১৫৪৭]

 ১৫. ওয়াদা করে গেলে তা বাস্তবায়ন করা    

মা-বাবা কারো সাথে কোন ভাল কাজের ওয়াদা করে গেলে বা এমন ওয়াদা যা তারা বেচে থাকলে করে যেতেন, সন্তান যথাসম্ভব তা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে,

وَأَوۡفُواْ بِٱلۡعَهۡدِۖ إِنَّ ٱلۡعَهۡدَ كَانَ مَسۡ‍ُٔولٗا ٣٤ ﴾ [الاسراء: ٣٤] 

অর্থ: আর তোমরা অঙ্গীকার পূর্ণ কর, নিশ্চয় অঙ্গীকার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। [ সূরা বনী ইসরাঈল:৩৪]

 ১৬.কোন গুনাহের কাজ করে গেলে তা বন্ধ করা

মা-বাবা বেচে থাকতে কোন গুনাহের কাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকলে তা বন্ধ করবে বা শরীয়াহ সম্মতভাবে সংশোধন করে দিবে। কেননা আবু হুরায়রা  রাদিয়াল্লাহু আনহু  হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«وَمَنْ دَعَا إِلَى ضَلاَلَةٍ كَانَ عَلَيْهِ مِنَ الإِثْمِ مِثْلُ آثَامِ مَنْ تَبِعَهُ لاَ يَنْقُصُ ذَلِكَ مِنْ آثَامِهِمْ شَيْئًا ».

এবং যে মানুষকে গুনাহের দিকে আহবান করবে, এ কাজ সম্পাদনকারীর অনুরূপ গুনাহ তার আমলনামায় যুক্ত হতে থাকবে। অথচ তাদের গুনাহ থেকে কোন কমতি হবে না’’ [সহীহ মুসলিম:৬৯৮০]।

 ১৭.মা-বাবার পক্ষ থেকে মাফ চাওয়া 

মা-বাবা বেচে থাকতে কারো সাথে খারাপ আচরণ করে থাকলে বা কারো উপর যুলুম করে থাকলে বা কাওকে কষ্ট দিয়ে থাকলে মা-বাবার পক্ষ থেকে তার কাছ থেকে মাফ মাফ চেয়ে নিবে অথবা ক্ষতি পূরণ দিয়ে দিবে।  কেননা হাদীসে এসেছে,

«عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ : أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ : أَتَدْرُونَ مَنِ الْمُفْلِسُ ؟ قَالُوا : الْمُفْلِسُ فِينَا يَا رَسُولَ اللَّهِ مَنْ لاَ دِرْهَمَ لَهُ ، وَلاَ مَتَاعَ لَهُ ، فَقَالَ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : الْمُفْلِسُ مِنْ أُمَّتِي يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ وَصِيَامِهِ وَزَكَاتِهِ ، فَيَأْتِي وَقَدْ شَتَمَ هَذَا ، وَأَكَلَ مَالَ هَذَا ، وَسَفَكَ دَمَ هَذَا وَضَرَبَ هَذَا ، فَيَقْعُدُ ، فَيُعْطَى هَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، وَهَذَا مِنْ حَسَنَاتِهِ ، فَإِنْ فَنِيَتْ حَسَنَاتُهُ قَبْلَ أَنْ يُعْطِيَ مَا عَلَيْهِ أُخِذَ مِنْ خَطَايَاهُمْ ، فَطُرِحَ عَلَيْهِ ثُمَّ طُرِحَ فِي النَّارِ».

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমরা কি জান নিঃস্ব ব্যক্তি কে? সাহাবীগণ বললেন, আমাদের মধ্যে যার সম্পদ নাই সে হলো গরীব লোক। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সে হলো গরীব যে, কিয়ামতের দিন নামায, রোযা ও যাকাত নিয়ে আসবে অথচ সে অমুককে গালি দিয়েছে, অমুককে অপবাদ দিয়েছে, অন্যায়ভাবে লোকের মাল খেয়েছে, সে লোকের রক্ত প্রবাহিত করেছে এবং কাউকে প্রহার করেছে। কাজেই এসব নির্যাতিত ব্যক্তিদেরকে সেদিন তার নেক আমল নামা দিয়ে দেয়া হবে। এবং তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। [সুনান আততিরমিযি :২৪২৮]

সুতরাং এ ধরনের নিঃস্ব ব্যক্তিকে মুক্ত করার জন্য তার হকদারদের কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নেয়া সন্তানের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।

অল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মা বাবার জন্য আমলগুলো করার তাওফীক দিন। আমীন!

وصلى الله على نبينا محمد وعلي اله وأصحابه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين- وأخر دعوانا أن الحمد لله رب العالمين

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা

$
0
0

লেখক: আলী হাসান তৈয়ব | সম্পাদনা: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী

keeping ties

আত্মীয়তা-সম্পর্ক ও এর মাহাত্ম্য

এটি এমন এক বিষয় যার দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা মানুষের রিজিক বাড়িয়ে দেন, হায়াত দীর্ঘ করেন, এবং মানুষের ধন-সম্পদে বরকত দেন। এটি হলো আত্মীয়তা-সম্পর্ক। আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলতে বুঝানো হয়, পিতা-মাতা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে এবং এসবের উর্ধ্বতন ও নিম্নতন আত্মীয়।

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা যে জরুরী, আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্ন করা যে হারাম আর আত্মীয়দের ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদাপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের সার্বিক কল্যাণ কামনা করার ফযীলত সম্পর্কে কুরআনে কারিমে এবং হাদীসে অনেক বাণী উল্লিখিত হয়েছে। আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে তাদের প্রশংসায় তিনি ইরশাদ করেন,

﴿وَالَّذِينَ يَصِلُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ وَيَخَافُونَ سُوءَ الْحِسَابِ (21) ﴾

‘আর আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, যারা তা অটুট রাখে এবং তাদের রবকে ভয় করে, আর মন্দ হিসাবের আশঙ্কা করে।’[সূরা আর-রা‘দ : ২১]

পক্ষান্তরে যারা এ সম্পর্ক অটুট রাখে না তীব্র ভাষায় তাদের ভৎর্সনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]

যারা পৃথিবীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে এবং আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে না তাদের ধমক দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদেরকে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]

রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচারের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتَّقُوا اللَّهَ الَّذِي تَسَاءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللَّهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا﴾

‘আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার মাধ্যমে তোমরা একে অপরের কাছে চাও। আর ভয় কর রক্ত-সম্পর্কিত আত্মীয়ের ব্যাপারে। নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর পর্যবেক।’[সূরা আন-নিসা : ০১]

এসব আয়াত থেকে আমরা সুস্পষ্ট বুঝতে পারি আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে আত্মীয়তা-সম্পর্ক অক্ষুণ্ন  রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং এ সম্পর্ক ক্ষুণ্ন করতে নিষেধ করেছেন।

প্রিয় পাঠক, আমরা কি আল্লাহর বাণীর মর্ম অনুধাবন করেছি? আমরা কি রাব্বুল আলামিনের ডাকেন সাড়া দেব না? নাকি এরপরও আমরা আত্মীয়-পরিজনদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবো? নিজেদের গোমরাহিতে ডুবে থাকবো? আল্লাহ তা‘আলার অবাধ্যতার পুনরাবৃত্তি করতে থাকবো? আর রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ পালনে উদাসীন থাকবো?

আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ عَنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ إِنَّ اللهَ خَلَقَ الْخَلْقَ حَتَّى إِذَا فَرَغَ مِنْ خَلْقِهِ قَالَتِ الرَّحِمُ هَذَا مَقَامُ الْعَائِذِ بِكَ مِنَ الْقَطِيعَةِ قَالَ نَعَمْ أَمَا تَرْضَيْنَ أَنْ أَصِلَ مَنْ وَصَلَكِ وَأَقْطَعَ مَنْ قَطَعَكِ قَالَتْ بَلَى يَا رَبِّ قَالَ فَهُوَ لَكِ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاقْرَءُوا إِنْ شِئْتُمْ ﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টি জীবের সৃজন কাজ শুরু করেন। যখন তিনি এ কাজ সমাপ্ত করেন, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলে উঠল, ‘এটি আপনার কাছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক ছিন্নকারীর আশ্রয়স্থান’। আল্লাহ তা‘আলা বললেন, ‘হ্যা, তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও, যে তোমাকে জুড়ে রাখবে আমিও তার সঙ্গে জুড়ে থাকবো আর যে তোমাকে ছিন্ন করবে আমিও তাকে ছিন্ন করবো?’ আত্মীয়তা-সম্পর্ক বলল, ‘জি হ্যা, হে আমার রব’। তিনি বললেন, ‘এটা শুধু তোমার জন্য’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা চাইলে এ আয়াত পড়ে দেখ :

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে?’[{আয়াত সূরা মুহাম্মদ : ২২} বুখারী : ৫৯৮৭]

আনাস বিন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

. إنَّ الرَّحِمَ مُعَلَّقَةٌ بِالْعَرْشِ تُنَادِي بِلِسَانٍ لَهَا ذُلَقٍ : اللَّهُمَّ صِلْ مَنْ وَصَلَنِي ، وَاقْطَعْ مَنْ قَطَعَنِي.

‘নিশ্চয় আত্মীয়তা-সম্পর্ক আরশকে আকঁড়ে ধরা একটি কাণ্ড, যা জিহ্বার ডগা দিয়ে বলে, ‘হে আল্লাহ, তুমি তার সাথে জুড়ো যে আমার সাথে জুড়ে আর তুমি তাকে ছিন্ন করো যে আমাকে ছিন্ন করে।’ তখন আল্লাহ তাবারাকা ওয়াতা‘আলা বলেন, ‘রহীম রহমান (আমি দয়ালু, পরম করুণাময়) আর ‘রাহীম’ (الرحم)  তথা আত্মীয়তা-সম্পর্ক শব্দটিকে আমার নাম থেকে বের করেছি। সুতরাং যে এর সাথে সুসম্পর্ক রাখবে আমি তার সাথে সুম্পর্ক রাখবো আর যে এ সম্পর্ক ভঙ্গ করবে আমি তার সাথে সম্পর্ক ভঙ্গ করবো।’[ইবন আব্দির রাজজাক, মুসান্নফ : ২৫৯০১]

আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু ইসলাম গ্রহণের আগে বাণিজ্য সফরে শাম দেশে গেলে বাদশা হেরাকল তাঁর কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিবরণ জানতে চান। জবাবে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বিবরণ তুলে ধরেন এভাবে :

يَأْمُرُنَا بِالصَّلاَةِ وَالصَّدَقَةِ وَالْعَفَافِ وَالصِّلَةِ.

‘তিনি আমাদের আল্লাহর ইবাদত, সালাত, সত্যবাদিতা, চারিত্রিত শুভ্রতা ও আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখার আদেশ করেন।’[বুখারী : ৫৯৮০]

আমরা এ থেকে জানতে পারি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের সূচনাকালে যেসব বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক তার মধ্যে অন্যতম। আমরা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারি দু‌ভাবে। এক. কিছু কাজ করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের সঙ্গে সদ্ব্যবহার এবং তাদের সঙ্গে সদাচার অব্যাহত রাখা। দুই. কিছু কাজ না করার মাধ্যমে। যেমন : আত্মীয়দের কষ্ট না দেয়া এবং তাদের অনিষ্ট না করা। প্রথমটি আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার সর্বোচ্চ স্তর আর দ্বিতীয়টি সর্বনিম্ন স্তর।

উল্লেখ করা দরকার, আত্মীয়তা-সম্পর্ক আবার কয়েক ধরনের। প্রথম. সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে সম্পর্ক। এটি আসলে দীনদারির ভিত্তিতে সম্পর্ক, যা তাকওয়ার একটি শাখাও বটে। এটি অর্জিত হয় নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে :

একে অন্যের শুভ কামনা করা, পরামর্শ নেয়া, পরস্পরকে ভালোবাসা, ন্যায়-ইনসাফ রক্ষা করা, ওয়াজিব বা জরুরী হক এবং যথাসাধ্য নফল বা ঐচ্ছিক হকসমূহ আদায় করা, মানুষকে সুশিক্ষা দেয়া, সুপথ দেখানো, দিক-নির্দেশনা দেয়া, সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল ও অন্যের দুখে সমব্যথী হওয়া এবং মানুষের জন্য কষ্ট দূর করা। আর আমরা তো জানিই যে, মুসলিম ভাইয়ের পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা।

 

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার ফযীলত

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার দ্বারা মানুষের হায়াত লম্বা হয় এবং ধন-সম্পদ বৃদ্ধি পায়। এটি কিন্তু যার তার কথা নয়; মহা সত্যবাদী, চরম শত্রু  কাফেরদের পক্ষ থেকে আল-আমীন বা বিশ্বস্ত উপাধী লাভকারী আল্লাহর নবীর ওয়াদা, যার সম্পর্কে কুরআনে সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এভাবে,

﴿وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى (3) إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوحَى (4) ﴾

‘তিনি আর মনগড়া কথা বলেন না। তাতো কেবল ওহী, যা তার প্রতি ওহীরূপে প্রেরণ করা হয়।’[সূরা আন-নাজম : ৩-৪]

তিনি ইরশাদ করেন,

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ مَنْ سَرَّهُ أَنْ يُبْسَطَ لَهُ فِي رِزْقِهِ أَوْ يُنْسَأَ لَهُ فِي أَثَرِهِ فَلْيَصِلْ رَحِمَهُ

‘যে ব্যক্তি কামনা করে তার রিজিক প্রশস্ত হোক এবং তার আয়ু দীর্ঘ হোক সে যেন আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখে।’[বুখারী : ৫৯৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৯]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কথাও বলে গেছেন যে, প্রকৃতপক্ষে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার কৃতিত্ব তারই প্রাপ্য যে অন্য পক্ষ থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও নিজের পক্ষ থেকে তা জোড়া লাগায়। পক্ষান্তরে যার সাথে সম্পর্ক বহাল রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করলে ব্যাস তা হবে সর্বোচ্চ ভালো সম্পর্কের প্রতিদানে ভালো সম্পর্ক। এটি যদিও আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যেই পড়ে কিন্তু যে ব্যক্তি সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে এমন আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক জুড়বে তার সওয়াব অনেক বেশি এবং তার প্রতিদান অনেক বড়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَيْسَ الْوَاصِلُ بِالْمُكَافِئِ وَلَكِنْ الْوَاصِلُ الَّذِي إِذَا قُطِعَتْ رَحِمُهُ وَصَلَهَا

‘সে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে সম্পর্ক রক্ষার বিনিময়ে সম্পর্ক রক্ষা করে। বরং প্রকৃত আত্মীয়তা-সম্পর্ক রাকারী সেই, যার সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরলে সে তা জোড়া দেয়।’[বুখারী : ৫৯৯১]

মহান এই দীনে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার প্রতি এত বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, কাফেরদের সাথেও সম্পর্ক রাখতে আত্মীয় অমুসলিম হলেও তার সাথে সম্পর্ক অমলিন রাখতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আসমা বিনতে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

قَدِمَتْ عَلَيَّ أُمِّي وَهِيَ مُشْرِكَةٌ فِي عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَاسْتَفْتَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قُلْتُ وَهِيَ رَاغِبَةٌ أَفَأَصِلُ أُمِّي قَالَ نَعَمْ صِلِي أُمَّكِ

‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় আমার আম্মা মুশরিক থাকতে একবার আমার কাছে আগমন করলেন। আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী, আমি কি আমার আম্মার সাথে সম্পর্ক রাখবো? তিনি উত্তর দিলেন, হ্যা, তুমি স্বীয় মাতার সাথে সম্পর্ক ঠিক রাখো।’[বুখারী : ২৬২০; মুসলিম : ২৩৭২]

প্রিয় পাঠক, আমাদের প্রিয় ধর্মে আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মর্যাদা এমনই। আমরা কি আল্লাহর নির্দেশ সম্পর্কে অবগত? আমরা পালন করি তাঁর নির্দেশ? বর্জন করি তার নিষেধকৃত বিষয়গুলো? ভেবে দেখুন, আমরা কি আত্মীয়তা-সম্পর্কই ঠিক রাখি? তাদের সাথে সাক্ষাৎ করি? তাদের খোঁজ-খবর নেই? আমরা তাদের সাথে যোগাযোগহীনতা, তাদের ব্যাপারে অন্তরের অনুদারতাকে ক্ষমার যোগ্য ভাবছি?

হে দুনিয়া-আখিরাতের সাফল্য প্রত্যাশী ভাই, আত্মীয়তা-সম্পর্ক বজায় রাখুন। আত্মীয়দের সাথে সম্পর্কোচ্ছেদ করবেন না কখনো। তাদের সাথে সুসম্পর্ক রাখলে, তাদের সাথে যোগাযোগ ঠিক রাখলে কত বেশি সওয়াব আর কত লাভ তা সবসময় মনে রাখবেন।

জানেন কি আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখলে কত লাভ?এর লাভ দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতে। সংক্ষেপে সেদিকে ইশারা করছি :

ক.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা ঈমানের পূর্ণতা ও ইসলামের সৌন্দর্যের প্রকাশ।

খ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করা রিজিক ও হায়াত বৃদ্ধির কারণ।

গ.  আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করার মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন হয়।

 

আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে পূর্বসূরী বুযুর্গদের উক্তি  

উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘তোমরা তোমাদের বংশগতি বিদ্যা শিক্ষা করো অতপর আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করো। আল্লাহর কসম! নিশ্চয় তোমাদের একজনের সাথে তার ভাইয়ের বিবাদ হবে, যদি সে জানতো তার ও এর মাঝে আত্মীয়তা-সম্পর্কের কী গুরুত্ব রয়েছে তাহলে তা তাদের এই সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে বিরত রাখতো।’ (তাফসিরে তাবারী : ১/১৪৪)

আতা বিন আবি রাবাহ রহ. বলেন, ‘আমি আমার আত্মীয়র জন্য এক টাকা খরচ করাকে দরিদ্র ব্যক্তির জন্য এক হাজার টাকা খরচ করার চেয়ে উত্তম মনে করি। একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলো, হে আবু মুহাম্মদ, যদি আত্মীয়টি ধনাঢ্যতায় আমার মতো হয় তবুও? তিনি বললেন, যদি সে তোমার চেয়েও বড় বিত্তশালী হয় তবুও।’ (ইবনে আবিদ্দুনিয়া, মাকারিমুল আখলাক : ৬২ পৃ.)

সাঈদ বিন মুসায়্যাব রহ. কিছু অর্থ রেখে গিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি জানেন আমি টাকা কেবল নিজের দীন ও বংশকে নিরাপদ রাখার জন্য সঞ্চয় করেছি। যে ব্যক্তি অর্থ সঞ্চয় করল না আর তা দিয়ে অন্যের পাওনা পরিশোধ করল না এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করতে পারল আর নিজেকে বাঁচাতে পারল না, তাতে কোনো কল্যাণ নেই।’ (ইবনে মুফলিহ, আদাবে শরইয়্যা : ৩/২৬২।)

আমর বিন দিনার রহ. বলেন, ‘নিশ্চিত জেনো, ফরজ আদায়ের জন্য কদম ফেলার সর্বোত্তম পদক্ষেপ সেটি, যা আত্মীয়তা-সম্পর্ক রার জন্য ফেলা হয়।’

সুলাইমান বিন মুসা রহ. বলেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন মুহাইরিসকে জিজ্ঞেস করা হলো, আত্মীয়তা-সম্পর্কের হক কী? তিনি বললেন, যখন সে এগিয়ে আসে তখন তাকে স্বাগত জানানো আর যখন সে পিছিয়ে যায় তখন তার পেছনে যাওয়া।’ (প্রাগুক্ত)

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা থেকে সতর্কিকরণ

এ আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষার মধ্যে যেমন অনেক সওয়াব ও বড় নেকি রয়েছে, তেমনি তা নষ্ট করার মধ্যে রয়েছে অনেক গুনাহ ও ক্ষতিকারিতা। যেমন : বলা হয়েছে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারী জান্নাতে যাবে না। জুবাইর বিন মুতয়িম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

لَا يَدْخُلُ الْجَنَّةَ قَاطِعُ رَحِمٍ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিচ্ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’[বুখারী : ৬৬৮৫; মুসলিম : ৪৬৩৭]

অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে এ সম্পর্ক ছিন্নকারী যেন উত্তপ্ত বালি ভক্ষণ করে। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,

عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ لِي قَرَابَةً أَصِلُهُمْ وَيَقْطَعُونِي وَأُحْسِنُ إِلَيْهِمْ وَيُسِيئُونَ إِلَيَّ وَأَحْلُمُ عَنْهُمْ وَيَجْهَلُونَ عَلَيَّ فَقَالَ لَئِنْ كُنْتَ كَمَا قُلْتَ فَكَأَنَّمَا تُسِفُّهُمْ الْمَلَّ وَلَا يَزَالُ مَعَكَ مِنْ اللَّهِ ظَهِيرٌ عَلَيْهِمْ مَا دُمْتَ عَلَى ذَلِكَ

এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, হে আল্লাহর রাসূল, আমার কিছু আত্মীয় রয়েছে- আমি তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করি আর তারা তা নষ্ট করে, আমি তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করি আর তারা আমার সাথে মন্দ ব্যবহার করে এবং তারা আমার সাথে মূর্খতাসূলভ আচরণ করে আর আমি তাদের আচরণে ধৈর্য্য ধরি। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ঘটনা যদি তেমনই হয় যেমন তুমি বলছো, তাহলে তুমি যেন তাদেরকে উত্তপ্ত বালু খাওয়াচ্ছো আর যতক্ষণ তুমি তোমার এ অবস্থানে থাকবে, তোমার সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাহায্যকারী থাকবে।’[বুখারী : ৬৬৮৯; মুসলিম : ৪৬৪০]

তাছাড়া আগেই যেমন উল্লেখ করা হয়েছে যে আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকারীর জন্য রয়েছে আল্লাহর লানত ও শাস্তি। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿فَهَلْ عَسَيْتُمْ إِنْ تَوَلَّيْتُمْ أَنْ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَتُقَطِّعُوا أَرْحَامَكُمْ (22) أُولَئِكَ الَّذِينَ لَعَنَهُمُ اللَّهُ فَأَصَمَّهُمْ وَأَعْمَى أَبْصَارَهُمْ (23) ﴾

‘তবে কি তোমরা প্রত্যাশা করছ যে, যদি তোমরা শাসন কর্তৃত্ব পাও, তবে তোমরা যমীনে বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং তোমাদের আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করবে? এরাই যাদেরকে আল্লাহ লানত করেন, তাদে কে বধির করেন এবং তাদের দৃষ্টিসমূহকে অন্ধ করেন।’[সূরা মুহাম্মদ : ২২-২৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَالَّذِينَ يَنْقُضُونَ عَهْدَ اللَّهِ مِنْ بَعْدِ مِيثَاقِهِ وَيَقْطَعُونَ مَا أَمَرَ اللَّهُ بِهِ أَنْ يُوصَلَ وَيُفْسِدُونَ فِي الْأَرْضِ أُولَئِكَ لَهُمُ اللَّعْنَةُ وَلَهُمْ سُوءُ الدَّارِ (25) ﴾

‘আর যারা আল্লাহর সাথে দৃঢ়ভাবে অঙ্গীকার করার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যে সম্পর্ক অটুট রাখার নির্দেশ দিয়েছেন তা ছিন্ন করে এবং যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করে, তাদের জন্যই লা‘নত আর তাদের জন্যই রয়েছ আখিরাতের মন্দ আবাস।’[সূরা আর-রা‘দ : ২৫]

আর আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্টকরার সবচেয়ে বড় নমুনা হলো পিতা-মাতার সাথে সম্পর্ক নষ্ট করা। তারপর যে সবচেয়ে কাছের তার সাথে, তারপর যে সবচেয়ে নিকটতর তার সাথে। এজন্যই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

أَلَا أُنَبِّئُكُمْ بِأَكْبَرِ الْكَبَائِرِ ثَلَاثًا قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ الْإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ

‘আমি কি তোমাদের সবচেয়ে বড় কবীরা গুনাহ সম্পর্কে সতর্ক করবো না? কথাটি তিনি তিনবার বললেন। আমরা বললাম, অবশ্যই, হে আল্লাহর রাসূল। তিনি বললেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা এবং পিতামাতার অবাধ্য হওয়া।’[বুখারী : ২৬৫৪; মুসলিম : ২৭০]

হায় আল্লাহ! পিতামাতার অবাধ্য হওয়া কত বড় অপরাধ যে আল্লাহর সাথে শিরকের সাথে সাথেই এর কথা বলা হয়েছে!

আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করার আরেকটি হলো, আখিরাতের আগেই দুনিয়াতে এর শাস্তি প্রদান করা হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,

مَا مِنْ ذَنْبٍ أَحْرَى أَنْ يُعَجِّلَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى الْعُقُوبَةَ لِصَاحِبِهِ فِي الدُّنْيَا مَعَ مَا يَدَّخِرُ لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ الْبَغْيِ وَقَطِيعَةِ الرَّحِمِ

‘আত্মীয়তা-সম্পর্ক বিনষ্ট করা ও জুলুমের চেয়ে অধিক উপয্ক্তু কোনো অপরাধ নেই যার শাস্তি সত্বরই দুনিয়াতে দেয়া হয়। অথচ আখিরাতের শাস্তি তার জন্য বরাদ্দই থাকে।’[মুসনাদে আহমদ : ২০৪১৪]

আল্লাহকে ভয় করার আহ্বান  

অতএব হে আল্লাহর বান্দাগণ, আল্লাহকে ভয় করুন এবং আত্মীয়তা-সম্পর্ক ঠিক রাখুন। আত্মীয়তা-সম্পর্ক রক্ষা করুন তাদের সাথে সাক্ষাৎ করা, তাদেরকে উপহার দেয়া, তাদের পেছনে অর্থ ব্যয় করার মাধ্যমে। তাদের সাথে সম্পর্ক রাখুন ভালোবাসা, আন্তরিকতা, নম্র কথা, হাসিমুখ, সম্মান, শ্রদ্ধা এবং সমাজে প্রচলিত সব ধরনের আত্মীয়তা রক্ষার উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে। কামিয়াব হোন এর দ্বারা দুনিয়াতে ও আখিরাতে।  আর অবশ্যই আপনারা এ সম্পর্ক নষ্ট করবেন না। কারণ তা দুনিয়া-আখিরাত উভয় জগতের ক্ষতি ও বিপদ ডেকে আনে। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের তাওফিক দিন। আমীন।

 



প্রতিবেশীর অধিকার ও তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার গুরুত্ব

$
0
0

আমরা আজ যে সমাজ ব্যবস্থায় অভ্যস্ত তাতে আমাদের অনুভূতিগুলোও দিন দিন যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষকে অবিশ্বাস আর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখাই যেন আজকালকার যুগের সবার চিন্তাধারার একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইট পাথরের দালানে থাকা আমরাও যেন অনুভূতিহীন কলের পুতুল। পাশের দরজার প্রতিবেশীর বিপদে আপদে, তাদের সুখ দুঃখের সঙ্গী হওয়া তো আজকাল দুরের কথা, কেউ কাউকে চিনিই না অনেক সময়। এরপরও কি আমরা দাবী করতে পারি আমরা সত্যিকারের মুসলমান? আসুন দেখি প্রতিবেশীদের অধিকার সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা ও তাঁর রাসুল আমাদেরকে কি বলেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ۖ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَبِذِي الْقُرْبَىٰ وَالْيَتَامَىٰ وَالْمَسَاكِينِ وَالْجَارِ ذِي الْقُرْبَىٰ وَالْجَارِ الْجُنُبِ وَالصَّاحِبِ بِالْجَنبِ وَابْنِ السَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ۗ إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخْتَالًا فَخُورًا

অর্থাৎ, তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর ও কোন কিছুকে তাঁর অংশী করো না, এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন, অভাবগ্রস্ত, আত্মীয় ও অনাত্মীয় প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, পথচারী এবং তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসীদের প্রতি সদ্ব্যবহার কর। ( সূরা নিসা: ৩৬)

এই সম্পর্কিত হাদিস সমূহ-

১) ইবনে উমার ও আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “জিব্রাইল আমাকে সব সময় প্রতিবেশী সম্পর্কে অসিয়ত করে থাকেন। এমনকি আমার মনে হল যে, তিনি প্রতিবেশীকে ওয়ারেস বানিয়ে দেবেন।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৪ ও মুসলিম ২৬২৪)

২) আবূ যার (রাঃ) বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “হে আবূ যার! যখন তুমি ঝোল (ওয়ালা তরকারি) রান্না করবে, তখন তাতে পানির পরিমান বেশী কর। অতঃপর তোমার প্রতিবেশীর বাড়িতে রীতিমত পৌছে দাও। (মুসলিম ২৬২৫)

৩) আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বলেন, নবী (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি মু’মিন নয়।” জিজ্ঞেস করা হল, ‘কোন ব্যক্তি? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন, “যে লোকের প্রতিবেশী তার অনিষ্ট থেকে নিরাপদ থাকে না।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৬)

৪) মুসলিমের এক বর্ণনায় আছে, ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদে  থাকে না। উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, হে মুসলিম মহিলাগণ! কোন প্রতিবেশিনী যেন তার অপর প্রতিবেশিনীর উপঢৌকনকে তুচ্ছ মনে না করে; যদিও তা ছাগলের পায়ের ক্ষুর হক না কেন। (সহীহুল বুখারী ২৫৬৬ ও মুসলিম ১০৩০)

৫) উক্ত সাহাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, কোন প্রতিবেশী যেন তার প্রতিবেশীকে তার দেওয়ালে কাঠ (বাঁশ ইত্যাদি) গাড়তে নিষেধ না করে। অতঃপর আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) বললেন, কী ব্যাপার আমি তোমাদেরকে রসূল (সাঃ)-এর সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরাতে দেখছি! আল্লাহর কসম! নিশ্চয় আমি এ (সুন্নাহ)কে তোমাদের ঘাড়ে নিক্ষেপ করব (অর্থাৎ এ কথা বলতে থাকব)। (সহীহুল বুখারী ২৪৬৩,৫৬২৭ ও মুসলিম ১৬০৯)

৬) উক্ত রাবী (রাঃ) থেকেই বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহেমানের খাতির করে। এবং যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, নচেৎ চুপ থাকে।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৮,৩৩৩১, মুসলিম ৪৭, ১৪৬৮)

৭) আবূ শুরায়হ খু্যায়ী (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদ্ব্যবহার কর। যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও শেষ দিনের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন তার মেহেমানের খাতির করে। এবং যে ব্যাক্তি আল্লাহ ও পরকালের প্রতি বিশ্বাস রাখে, সে যেন ভাল কথা বলে, অথবা নীরব থাকে।” (সহীহুল বুখারী ৬০১৯,৬১৩৫, মুসলিম ৪৮)

৮) আয়েশা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, “হে আল্লাহর রসূল! আমার দু’জন প্রতিবেশী আছে।(যদি দু’জনকেই দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে) আমি তাঁদের মধ্যে কার নিকট হাদিয়া (উপঢৌকন) পাঠাব?’ তিনি বললেন, “যার দরজা তোমার বেশী নিকটবর্তী, তার কাছে (পাঠাও)।” (সহীহুল বুখারী ৬০২০,২২৫৯, আবূ দাউদ ৫১৫৫)

৯) আব্দুল্লাহ ইবনে উমার(রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, “আল্লাহর নিকট সর্ব উওম সঙ্গী সে, যে তার সঙ্গীর কাছে উওম। আল্লাহর নিকট সেই প্রতিবেশী সর্ব উওম, যে তার প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে সর্বাধিক উওম।” (তিরমিযী ১৯৪৪, আহমাদ ৬৫৩০, দারেমী ২৪৩৭)

এখনো কি আমরা আমাদের প্রতিবেশীর ভালমন্দের খবর নেব না?

শুধু তোমাকে বলছি… (আর কাউকে বোলো না, প্লীজ!)

$
0
0

sealed letterরচনাঃ নায়লা নুজহাত

ঘটনা ১

“আপা, নামেন।”
চমকে রিকশাওয়ালার দিকে তাকালো মিলা। চলে এসেছে? এতো তাড়াতাড়ি? হবেও বা। বাসা থেকে বেরিয়েছে কেমন একটা ঘোরের মাঝে, রিকশাও ঠিক করেছে কিছু না বুঝেই।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পুরনো রঙ উঠে যাওয়া লোহার গেট ঠেলে বাসার উঠোনে এসে দাঁড়ালো মিলা। রোজিনা খালা কি আছেন বাসায়? একটা ফোন করে আসতেও মনে নেই। বহুদিন ধরে স্বামীর সাথে সমস্যা চলছে, কাউকে বলেনি, নিজের মাকেও না। কেই বা বুঝবে তাকে? আজ যখন অসহ্য হয়ে বেরিয়ে এসেছে বাসা থেকে, তখন এই সহজ সরল মহিলার কথাই মনে এসেছে।

“এসো মা, এসো। তোমার চেহারা অমন হয়ে আছে কেন?”

“খালা, আমি কি আপনাকে কিছু কথা বলতে পারি? কিন্তু কথা দিতে হবে আপনি কাউকে বলবেন না, প্লীজ?”

চোখের পানি আর বাঁধ মানেনি। খালাকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ ধরে কাঁদল মিলা। বলে ফেলল সব কথা। অনেকক্ষণ ধরে বুঝালেন মহিলা মিলাকে। বহুদিন পর যেন কেউ মিলাকে ভালবাসল

কবে এই মহিলার সাথে পরিচয় হয়েছিলো যেন? মিলার মনে নেই। তার বাবা মায়ের পরিচিত, খুব ঘনিষ্ঠ। বিশ্বস্ত। তাই তো উনার কাছেই ও ছুটে এসেছে। ছোট্ট করে একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিলা।

হাল্কা মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিল সেদিন মিলা। রোজিনা খালার দেয়া উপদেশগুলোও ভুলেনি। সত্যি বলতে তার সংসারটাও টিকে গিয়েছে।

একদিন সে আর তার স্বামী রাত করে বাসায় ফিরছিল। পথে স্বামীর এক বন্ধুর সাথে দেখা। বন্ধুটি খুব অবাক চোখে তাদের দিকে এগিয়ে এলো। কুশল পর্বের আগেই বলে বসলো, “যাক বাবা, তোরা একত্রে আছিস তাহলে এখনো?” অবাক হয়ে মিলার স্বামী প্রশ্ন করলেন “মানে?”

“না মানে ইয়ে ওই রোজিনা অ্যান্টি আছেন না? আরে ওই যে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন? তিনি বলছিলেন যে মিলার স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যাচ্ছে।”

স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে মিলা। শুনতে পায় না স্বামী প্রশ্ন করছেন রোজিনা অ্যান্টি ব্যাপারটা কিভাবে জানলো। শুনতে পায়না স্বামীর বন্ধু সেই মহিলার থেকে শোনা পুরো ঘটনাটি বর্ণনা করছেন।

এক মূক অভিমানে স্তব্ধ হয়ে থাকে সাংসারিক বুদ্ধিতে কাঁচা মিলা। অতি বোকা মিলা।

ঘটনা ২

মেয়েটি কাঁদছিল। পাশে এসে বসলো তার বান্ধবী সোহানা।

“এই লাবনী, এই। কাঁদছিস কেন?”

আচ্ছা মেয়ে তো! কাঁদছে, অথচ বলবে না কী হয়েছে! “চল আমার বাসায় যাবি। অ্যান্টিকে কল করে বলে দে। বিকেলে পৌঁছে দিয়ে আসবো চল! একসাথে দুপুরে খাব, গল্প করব, দেখবি মন ভাল হয়ে গিয়েছে।”

সোহানাদের বাড়িটা খুব সুন্দর। ওর মা খুব আদর করেন লাবনীকে। সেই ছোটবেলা থেকেই পরিচয়, কত এসেছে! দুপুরে খাওয়ার পর একথা সেকথা বলতে বলতে একসময় বলেই ফেলল লাবনী তার সমস্যার কথা। একজনকে ভালবাসে। তার সাথে বাবা মা বিয়ে দিবেন না। সোহানার জন্য এসব কোনও ব্যাপার না– ও কোনদিনও সিরিয়াস না এসব নিয়ে। আর কি অদ্ভুত মেয়েটা, হাসি ঠাট্টা করে লাবনীরও মনের দুঃখ কখন কাটিয়ে দিল লাবনী টেরও পায়নি।

বাসায় ফেরার সময় সোহানার হাত ধরে বলল, “কাউকে বলিস না রে। আমাদের ফ্রেন্ডদেরও না”

……………………………………..

আজ লাবনীর বিয়ে। না, বাবা মা কে কষ্ট দিতে পারেনি সে। চুপচাপ বসেছিল। বান্ধবীরাও এসেছে সবাই। তাদের হৈ চৈ ওর কানে যেন প্রবেশ করতে পারছে না। এমন সময় কে যেন ওর হাত চেপে ধরল। চমকে তাকিয়ে দেখে রিতার আম্মা। রিতাও সোহানির মতই ওর বাল্য বান্ধবী। মহিলা ফিস ফিস করে বললেন, “মা, এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত বুঝে শুনে নিয়েছ তো?”

অ্যান্টি ভুল কিছুই বলেননি। তবু লাবনীর মনেহল কে যেন তার অন্তরে ছুরি চালিয়ে দিল। সোহানা? হ্যাঁ, সোহানাই। তাকে ছাড়া তো আর কাউকে বলেনি সে?

“এই কি করছিস সব মেক আপ নষ্ট হয়ে যাবে যে!” আরেকবার চমকে ওঠে লাবনী। এবার তার প্রানপ্রিয় বান্ধবী সোহানার স্পষ্ট কথায়। তাই তো, সে নিজেই বুঝতে পারেনি এতক্ষন ধরে যে সে কাঁদছে!

বিশ্বাস ভেঙ্গে যাওয়ার যন্ত্রণায় কাঁদছে!

ঘটনা ৩

অফিস থেকে এসে ফ্রেস হয়ে মাত্র রুমা ল্যাপটপটা অন করে বসেছে। এমন সময় ফোন। “আপা, আমি ঊর্মি।” কে? ও আচ্ছা, ওই যে সেদিন রুমাদের অফিসে এসেছিলো, তার এক জুনিয়রের বউ।

“আপা শুনছেন? আমি একটু বিপদে পড়েছি, আপনাকে সেদিন দেখেই বড় ভাল লেগেছিল, বড় আপন মনে হয়েছিল, তাই আপনাকেই বলছি। কাউকে বলবেন না প্লীজ। আপা জানেন, আমার স্বামী…”

মেয়েটির সাথে কথা বলে ফোনটা রেখে একটু চা করতে রান্না ঘরে গেল রুমা। মাথাটা ধরে গিয়েছে। না, মেয়েটার কথায় না। এমন করে মনের কথা অনেকেই বলে থাকে তাকে। কেন টা সে নিজেও জানেনা। মাথা ধরেছে একথা ভেবে যে আজকাল মেয়েগুলো এত বোকা হয় কেন? চিনে না, জানে না এমন মানুষকেও আপন ভেবে মনের কথা সব বলে দেয়। রুমা জানে রুমা আর কাউকে বলবে না। কিন্তু তার জায়গায় অন্য কেউ হলে?

চা খেতে খেতে আবার একই প্রশ্ন করলো নিজেকে রুমা। মেয়েগুলো এত বোকা কেন?

———————————————————————————————————-

উপরের ঘটনা গুলো গল্পাকারে লিখলেও এসবই বাস্তব ঘটনা, বিভিন্ন সময়ে এমনটা হয়ে থাকে, হতে দেখেছি অথবা এমনটা হওয়ার দরুন কাউকে কষ্ট পেতে দেখেছি। সাধারণত যারা নিজেরা ভালো, তারাই এসমস্ত কষ্ট গুলো পায়। কারণ তারা নিজেরাও অপরের মাঝে ভালটাই দেখতে পায়। তারা জানে বিশ্বাস মানুষই মানুষকে করে, আর মানুষই মানুষের বিশ্বাস রাখে। তারা জানে কেউ কাউকে কথা দিলে সে কথা ভাঙ্গা যায়না। নিজেরা প্রাণ দিয়ে হলেও নিজেদের দেয়া কথা রাখে বলেই অন্যের দেয়া কথাকেও প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করে। এমন ভালো মানুষ হয়ে জন্মানোটা বর্তমান জগতে আসলে ভালোত্ব না, রীতিমত পাপ। আর হ্যাঁ, সেই পাপের মাসুল তাদের দিতে হয় নিজেদের অন্তরের রক্তক্ষরন দিয়ে।

আমার সেই সব পাপী বোনদের বলছি। যারা মানুষকে বিশ্বাস করে কিছু বলার মত পাপটা করেছ অথবা করতে চলেছ। একটা কথা কি জানো আপু, সব মানুষই মানুষ। মানবিক দুর্বলতা সবারই থাকে। এই যে গল্পে যাদের কথা লিখেছি, এরাও কিন্তু কেউই পুরোপুরি খারাপ না। কিন্তু তাদের এমন কিছু দুর্বলতা আছে যা অপরের জন্য ক্ষতিকর। হয়ত তারা নিজেরাও তা জানেনা। তাই আমি বলি কি, এই পৃথিবীতে মানুষকে ভালবাসবে। তাদের সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখবে। বিশ্বাসও করবে। শুধু নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিশ্বাস করে বসবে না। কারণ হয়ত কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে তারা ভুলে যাবে তোমাকে দেয়া কথা। ভুলে যাবে কথাটি ছড়ালে তোমার ক্ষতি হতে পারে। হয়ত সবাই তারা খুব ভালো। তবু শয়তান হয়ত তাদেরকে ভুলিয়ে দিবে। তুমি তো জানো, বোন, যে শয়তান আমাদের প্রকাশ্য শত্রু, জানো না? একজন মানুষ যত ভালই হোক, মনে রাখবে যে সে তারপরও একজন মানুষই। মানুষটা খুব ধার্মিক হতে পারে, খুব পরিচিত বান্ধবী হতে পারে— তবুও সেও মানুষ। তাই এমন কথা কাউকে বলবে না যা কোনও কারণে পাঁচ কান হলে তুমি সহ্য করতে পারবে না। আর যদি খুব বলতে ইচ্ছা করে, নিজের মা কে বলবে, বোন কে বলবে। তাঁরা যদি বকেনও, তবু তাঁদের কাছেই তুমি সবচেয়ে নিরাপদ। তাঁরা যে তোমাকে “তুমি” হিসেবে দেখেন না। তাঁরা তোমাকে দেখেন তাঁদেরই এক অবিচ্ছেদ্দ্য অংশ হিসেবে!

আর হ্যাঁ। সবচেয়ে মজার কথাটা তো বলিইনি। তুমি কি জান, এমন একজন বন্ধু আছেন যাকে কিছু বলতে তোমার তাঁকে খুঁজতে হবে না, তুমি বললেই তিনি শুনবেন? তুমি কি জানো, তোমার বলতেও হবে না, তোমার চোখের প্রতিটা পানির হিসেব তিনি নিজেই রাখেন? তুমি কি জানো, এমন একজন আছেন যিনি তোমার দোষ অপরকে বলে বেড়াবেন না? তিনি যে তোমার প্রতিটা কথা শোনার জন্য সদা প্রস্তুত, তা কি তুমি জানো?

এত বিশ্বস্ত, এত আপন, এত কাছের তোমার সেই রব কে ফেলে আর কার কাছে যাবে তুমি ভালবাসা খুঁজতে, খুঁজতে আশ্রয়? আর কেনই বা যাবে বোন?

বোনেরা আমার, আমাদের জন্য আমাদের রব আছেন। তিনিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। আমরা যেন তাঁর কাছেই আমাদের অন্তরের প্রশান্তি খুঁজি। তাঁর সৃষ্টির কাছে না, যারা নিজেরাই তাঁর অনুগ্রহ প্রার্থী। নিজেদের ভুলে নিজেদের যেন আমরা অসম্মান করে না বসি। আমাদের সম্মানটা যে আমাদের কাছে আমাদের জীবনের চেয়েও দামী!

আমীন!

স্থায়ী দাম্পত্যের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন

$
0
0

মূল : আমাল কিল্লাওয়ি | ভাষান্তর ও সম্পাদনা : আব্‌দ আল-আহাদ

প্রকাশনায় : PureMatrimony Bangladesh

muslim-man-putting-shoes-on-woman

সম্প্রতি এক বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে মানুষের দাম্পত্য নিয়ে নানা সমস্যার কথা শুনলাম। অতিথিরা যখন নেচে গেয়ে অনুষ্ঠান মাত করছিল, হলের একদম পেছনের দিকে বসে বসে ভেঙ্গে যাওয়া স্বপ্ন আর অপূর্ণ প্রত্যাশা নিয়ে আমাদের কথা হচ্ছিল। গানবাজনার উচ্চ শব্দের কারণে পরস্পরের কথা শোনার জন্য মাঝে মাঝে আমাদেরকে চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছিল। একজন কমবয়সী নারী বললেন, তার স্বামী তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেবেন না। উপস্থিত আরেক বান্ধবী শশুরবাড়ির লোকজনের সাথে কীভাবে চলতে হবে সেই বিষয়ে পরামর্শ চাইলেন। এক মা কাঁদতে কাঁদতে তার মেয়ের সম্ভব্য বিবাহ বিচ্ছেদের কথা বললেন। তালাকপ্রাপ্তা মেয়ে ঘরে তুলতে কেমন লাগবে সেই অনুভূতির কথাও বললেন।

অন্যরকম একটা রাত! নবদম্পতির জন্য অনেক অনেক দো‘আ আর শুভকামনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের ইতি হলো। মনে আছে, বর-কনে, উভয়ের জন্য আমি আরও বেশি দো‘আ করেছিলাম : ‘হে আল্লাহ! ওদের তুমি একটা স্থায়ী এবং সুস্থ-সুন্দর সম্পর্ক দিয়ে ধন্য করো। আমীন।’ অনুষ্ঠান থেকে গভীর চিন্তা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ফলে ঘুমিয়ে পড়তে বেশ সমস্যা হলো। ওইরাতে অভিজ্ঞতার পরিহাস আমাকে ভালো মতোই নাড়া দিল।

গত কয়েকমাসের মধ্যেই আমার আশেপাশের অনেক কয়টা সংসার ভেঙ্গে গেছে। আমার জানা মতে, এমন আরও অনেক দম্পতি চূড়ান্ত বিচ্ছদের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, বিবাহ বিচ্ছেদ একটি সঠিক এবং অনেক ক্ষেত্রে একটা অপরিহার্য পছন্দ। কিন্তু কী কারনে এত বিপুল সংখ্যক দাম্পত্য জীবনের এত দ্রুত অবসান ঘটছে? প্রতিশ্রুতি এবং দায়িত্ববোধের একটি সংস্কৃতিকে লালন করার জন্য কী ধরণের পরিবর্তন দরকার?

সেদিন রাতে যতগুলো ঘটনা আমি শুনেছিলাম, তার সবগুলোর সারকথা ছিল একটাই : বিয়ের আগে ওইসব দম্পতির কেউই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করেননি। তাদের কেউই বিয়ের মতো জীবন সংগ্রামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেনি এবং তাদের অধিকাংশ সমস্যাগুলো এমন সব বিষয় থেকে সৃষ্টি হয়েছিল, বিয়ের পূর্বে যেগুলো নিয়ে কোনো আলোচনাই হয়নি। মুসলিম সমাজগুলোতে বিবাহ বিচ্ছেদের উপর একটি সাম্প্রতিক গবেষনায় দেখা গেছে, গবেষণায় অংশ নেওয়া তালাকপ্রাপ্ত নারী-পুরুষদের কেউই মসজিদের ইমামের সাথে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ছাড়া, অন্যকোনো বিবাহপূর্ব পরামর্শই গ্রহন করেননি। তাদের অনেকেই বলেছেন, আরও ব্যাপক বিবাহপূর্ব পরামর্শ পেলে এবং বিয়ের পরে সমস্যায় পড়ার সাথে সাথে এধরনের সহজ পরামর্শ পেলে তারা অনেক উপকৃত হতেন। আমাদের সমাজগুলোতে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের অভাব একটি দুঃখজনক বাস্তবতা।

যখনই কোনো দম্পতির বাগদানের খবর শুনি, আমরা অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের জন্য দৌড়ে যায়। কখনও কি আমরা সময় করে ভেবেছি, সারাজীবনের জন্য একটি সিদ্ধান্ত নিতে ওই নবদম্পতির কী পরিমাণ প্রস্তুতি এবং সহযোগিতার প্রয়োজন? বিয়ের অনুষ্ঠানে হাসিখুশি চেহারায় ছবি তুলতে ব্যস্ত কয়জন নবদম্পতি আসলেই জানে, তারা কোন পথে পা বাড়াচ্ছে? নতুন সম্পর্কের প্রেমোত্তেজনা তাদেরকে প্রায়ই এই বাস্তবতা উপলব্ধিতে অন্ধ করে দেয় যে, তাদের বিয়ে হলো স্রষ্টার সাথে একটি পবিত্র অঙ্গীকার। এই আত্মিক সম্পর্কের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা কি তাৎপর্যপূর্ণ নয়?

বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য আমরা কত সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করি! অথচ খোদ বিয়ের জন্যই কিছু করি না। এমন কেন হয়? বিয়ে অনুষ্ঠানের সামান্য বিষয়টা নিয়েও আমাদের জল্পনা-কল্পনার কমতি থাকে না। অথচ সেই অনুষ্ঠান উদ্‌যাপনের অপরিহার্য উদ্দেশ্য, অন্য একজন মানুষের সাথে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়ার “অঙ্গীকার”কে আমরা উপেক্ষা করে যায়। একজন মহিলা আমাকে বলেছিলেন, ‘বিয়ে নিয়ে ভাবার জন্য দু’মাস মাত্র সময় পেয়েছিলাম। প্রেমে মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম, তাই অন্যকিছু নিয়ে ভাববার সময় পায়নি।’

অনেক যুগল ভূলবশত মনে করেন, বিয়ের আগে তাদের কোন পরামর্শ গ্রহনের প্রয়োজন নেই, দ্বন্দ্ব এড়িয়ে চলতে পারলেই সব ঠিক থাকবে। তবে কথা হলো, একটা নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত দ্বন্দ্ব থাকা সুস্থ দাম্পত্যের জন্য জরুরি এবং বিবাহপূর্ব পরামর্শ সম্ভব্য সমস্যা সৃষ্টিকারী বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ করে দেয়।

বিয়ের ব্যাপারে পাকাকথা দেওয়ার আগেই বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করুন।

পরিবার ও বিবাহ বিষয়ক গবেষক, লিসা কিফ্‌ট এর মতে, বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ আপনাকে নিন্মোক্ত ক্ষেত্রে সাহায্য করবে:

১) পারস্পরিক ভূমিকার ব্যাপারে প্রত্যাশাগুলো কেমন, তা আলোচনা করা। একটি দাম্পত্য সম্পর্কে প্রত্যেকের নিজনিজ দায়িত্ব এবং কর্তব্যগুলো নিয়ে কথা বলা জরুরি। যেমন : কে আর্থিক দিকটা সামলাবেন আবার কে বাড়ির কাজগুলো দেখাশোনা করবেন ইত্যাদি। আগেভাগেই প্রত্যেকের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে আলোচনা হলে, পরস্পরের কাছে ভবিষ্যত প্রত্যাশাগুলো সচ্ছ এবং পরিষ্কার হয়ে যায়।

২) পরস্পরের ব্যক্তিগত এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া। গানবাজনা, হিজাব, জবাই করা পশুর গোশত খাওয়া, কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের অনুসরণ করা ইত্যাদি বিষয়ে দুজনের কার দৃষ্টিভঙ্গি কেমন, তা জেনে নিন। সময় থাকতেই এসব বিষয়ে আলোচনা করলে আপনারা পরস্পরের জন্য কতটুকু মানানসই, তা বুঝতে পারবেন। এতে করে কীভাবে ভিন্ন মতের মানুষের সাথে মানিয়ে চলতে হবে তা জানা যাবে।

৩) পরস্পরের বংশ এবং পরিবার সম্পর্কে কথা বলা। একটি সম্পর্কের সাথে যতগুলো বিষয় জড়িত থাকে, তার অধিকাংশ সম্পর্কে আমরা আমাদের বাবা-মা এবং পরিবারের সদস্যদের থেকে শিখে থাকি। জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের প্রভাবগুলো চিহ্নিত করলে এবং সেসব থেকে অর্জিত আচার-ব্যবহার নিয়ে আলোচনা করলে বুঝা যায়, দাম্পত্য জীবনে সেগুলো কোন ধরণের ভূমিকা রাখতে পারে।

৪) পারস্পরিক যোগাযোগ ও সমস্যা সমাধানের দক্ষতা বাড়ান। যে দম্পতির মাঝে যত উন্নতমানের বোঝাপড়া বিদ্যমান, তারা তত কার্যকরভাবে নিজেদের সমস্যার নিরসন করতে পারেন। এতে করে খুব সামান্য সময়ই আপনি তর্কে জড়াবেন এবং অধিকাংশ সময় পরস্পরকে বুঝতে পারবেন।

৫) ব্যাক্তি জীনবের জন্য, দাম্পত্য জীবনের জন্য এবং পারিবারিক জীবনের জন্য লক্ষ্য স্থির করুন। মনে রাখবেন, আপনি অন্য একটা মানুষের সাথে নিজের জীবনটাকে ভাগাভাগি করার অঙ্গীকার করতে যাচ্ছেন। একসাথে থাকা অবস্থায় নিজেদের ভবিষ্যতটা কেমন দেখতে চান, তা আলোচনা করা কি জরুরি নয়? বিয়ে পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? কয়টি সন্তান প্রত্যাশা করেন? ভবিষ্যত জীবনের একটা রূপরেখা তৈরি করা পরস্পরকে বুঝার একটা অসাধারণ উপায়। এতে পারস্পরিক অঙ্গীকারগুলো আরও দৃঢ় হয়ে যায়।

বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণের মাধ্যমে দম্পতিরা অনেক মানসিক যন্ত্রণা এবং দ্বন্দ্ব সংঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারেন। সমস্যার সমাধান খোঁজার চেয়ে সমস্যা যেন তৈরিই না হয়, তা নিশ্চিত করা ইসলামের অন্যতম মূল বিষয়। কাজেই আমাদের ইমামগণ এবং সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের বিবাহপূর্ব পরামর্শ এবং শিক্ষা দানের জন্য প্রশিক্ষন গ্রহণ করা দরকার। এটি হবে সুখী দম্পতি এবং সুস্থ দাম্পত্যের ক্ষেত্রে একটি নিশ্চিত লাভজনক বিনিয়োগ।

আপনার অভিমত জানান :

১) আপনি কি সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদের জন্য বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণ করাকে উপকারী বলে মনে করেন?

২) বিবাহপূর্ব পরামর্শ দানের ক্ষেত্রে আর কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত বলে আপনার মনে হয়?

৩) কীভাবে সম্ভব্য পাত্র-পাত্রীদেরকে বিবাহপূর্ব পরামর্শ গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা যায়?

আপনার গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানিয়ে মন্তব্য করুন।

 

Join Pure Matrimony!

শুধুমাত্র বাস্তব জীবনে ইসলাম চর্চাকারী অবিবাহিত মুসলিম ছেলেমেয়েদেরকে আল্লাহ্‌ভীরু জীবন সঙ্গী/সঙ্গিনী খুঁজে পেতে সহায়তা করাই “পিওর ম্যাট্রিমনি” ওয়েবসাইটের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য। বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন  – http://www.quraneralo.com/purematrimony/

Facebook: http://www.facebook.com/purematrimonybd

একজন মুসলিমের প্রাত্যহিক জীবন যেমন হওয়া উচিৎ

$
0
0

colorful_poppy_flowers-wide

লেখকঃ উস্তাদ মুহাম্মাদ নাসীল শাহরুখ

بسم الله الرحمن الرحيم

আল্লাহ তাআলার আদেশ মেনে চলা ও তাঁর নিষিদ্ধ বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাকতে চাইলে একজন মুসলিমকে যে বিষয়ে বিশেষভাবে মনোযোগী হওয়া উচিৎ, তা হল তার প্রাত্যহিক রুটিন৷ একজন মুসলিম কখন ঘুম থেকে উঠবে, রাতে কখন বিছানায় যাবে – এ সকল বিষয়ে ইসলামের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে৷

হাদীসে বর্ণিত:

عَنْ صَخْرٍ الْغَامِدِىِّ عَنِ النَّبِىِّ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ « اللَّهُمَّ بَارِكْ لأُمَّتِى فِى بُكُورِهَا ». وَكَانَ إِذَا بَعَثَ سَرِيَّةً أَوْ جَيْشًا بَعَثَهُمْ فِى أَوَّلِ النَّهَارِ. وَكَانَ صَخْرٌ رَجُلاً تَاجِرًا وَكَانَ يَبْعَثُ تِجَارَتَهُ مِنْ أَوَّلِ النَّهَارِ فَأَثْرَى وَكَثُرَ مَالُهُ. قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَهُوَ صَخْرُ بْنُ وَدَاعَةَ

সাখর আল গামিদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে তিনি বলেছেন: হে আল্লাহ আপনি দিনের অগ্রভাগে আমার উম্মাতের জন্য বরকত দিন৷ এবং তিনি যখন কোন ছোট বাহিনী কিংবা বড় দলকে অভিযানে পাঠাতেন, তাদের দিনের অগ্রভাগে পাঠাতেন৷ আর সাখর একজন ব্যবসায়ী ব্যক্তি ছিলেন৷ তিনি দিনের প্রথমভাগ থেকেই ব্যবসা পরিচালনা করতেন, ফলে তিনি ধনাঢ্য হয়ে ওঠেন এবং তার সম্পদ বৃদ্ধি পায়৷১

এই হাদীস থেকে জানা যায় যে এই উম্মাতের মধ্যে কল্যাণ রয়েছে দিনের অগ্রভাগে৷ অতএব ফজরের সালাতের পর না ঘুমিয়ে যিকরে মশগুল থাকা এবং সূর্যোদয়ের কিছুক্ষণ পর দুই রাকাত নফল সালাত আদায় করে এরপর কাজে নেমে পড়া মুসলিমদের জন্য বরকত তথা কল্যাণ বৃদ্ধি ও স্থায়ীত্বের কারণ হবে৷ আর যে ফজরের সালাতের সাথে সাথেই দিনের শুরু করতে চায়, তাকে রাতে আগেভাগেই বিছানায় যেতে হবে৷ এজন্য আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এশার সালাতের পর কথাবার্তা বলা পছন্দ করতেন না৷ তিনি ও তাঁর সাহাবীগণ এশার পরপর রাত্রির অগ্রভাগেই বিছানায় যেতেন, যেন শেষরাত্রিতে জেগে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করতে পারেন; অথবা অন্ততপক্ষে যেন ফজরের সালাতের সময় সতেজ দেহমন নিয়ে জেগে উঠতে পারেন৷ হাদীসে বর্ণিত:

وَكَانَ يَسْتَحِبُّ أَنْ يُؤَخِّرَ الْعِشَاءَ… وَكَانَ يَكْرَهُ النَّوْمَ قَبْلَهَا وَالْحَدِيثَ بَعْدَهَا

আর তিনি [রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম] এশা বিলম্বিত করাকে পছন্দ করতেন,…আর তিনি এর পূর্বে ঘুমকে এবং এর পরে কথাবার্তাকে অপছন্দ করতেন৷২

আজ বহু মুসলিম পরিবারেই এর বিপরীত অভ্যাস দেখতে পাওয়া যায়৷ অনেকেই গভীর রাত পর্যন্ত রাত্রিজাগরণে অভ্যস্ত। তাদের অনেকেই ফজরের সালাত ঘুমিয়ে পার করে দেন৷ অনেকে রাত জেগে টেলিভিশন দেখে, ইন্টারনেটে ব্রাউজ করে কিংবা গল্পগুজব করে সময় কাটান, আর এগুলোর মাধ্যমে তারা বিভিন্ন ধরনের গুনাহে লিপ্ত হন৷

অনেক ছাত্রদের ধারণা যে রাত জেগে লেখাপড়া করলে ভাল ফল পাওয়া যায়৷ কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ বিপরীত৷ কেউ রাত্রিতে যথেষ্ট ঘুমিয়ে ভোরে উঠে সতেজ দেহ-মন নিয়ে দু-ঘন্টায় যতটুকু পড়া করতে পারবে, তা হয়ত রাত জেগে চার ঘন্টা লেখাপড়ার সমান৷

অনেকে অভিযোগ করেন যে রাত্রি জাগরণ অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, আর এ অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে না৷ এই অভ্যাস পরিবর্তনের সহজ উপায় আছে৷ কষ্ট করে কয়েকদিন ফজরের সময় ঘুম থেকে জেগে ওঠা এবং ফজরের সালাতের পর আর বিছানায় না যাওয়ার অনুশীলন করলে প্রথমে কষ্ট হলেও শীঘ্রই এটা অভ্যাসে পরিণত হবে৷ ফজরের পর ঘুম তাড়িয়ে রাখার জন্য প্রথমদিকে কিছু খেলাধূলা বা শারীরিক পরিশ্রম করা যেতে পারে৷ প্রয়োজনে অভ্যাস পরিবর্তনের জন্য ছুটির সময়কে বেছে নেয়া যেতে পারে, যেন তা করতে গিয়ে কাজের ক্ষতি না হয়৷ মোটকথা ঘুমের অভ্যাস পরিবর্তন করা সম্ভব – এটি পরীক্ষিত৷

দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকতে পারে দিনের শেষভাগে খেলাধূলা ও শরীরচর্চা৷ সাহাবীগণ দিনের শেষভাগে, এমনকি মাগরিবের সালাত আদায় করেও তীর-নিক্ষেপ চর্চা করতেন৷ দিনের শেষভাগে কিছুটা শরীরচর্চা, হাঁটা বা খেলাধূলা করা রাত্রিতে ঘুমকে গভীর করতে সহায়ক হবে৷ এছাড়া দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত তো আছেই – যার প্রতি বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য-কর্তব্য৷

দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে আরও থাকা দরকার নিয়মিত দ্বীন-শিক্ষা ও কুরআন চর্চা৷ হঠাৎ বেশি পরিমাণে কোন আমল করার চেয়ে অল্প হলেও নিয়মিত আমল করাটা অধিক উপকারী এবং আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়৷ আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:

« أَحَبُّ الأَعْمَالِ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى أَدْوَمُهَا وَإِنْ قَلَّ »

আল্লাহর কাছে সবচেয়ে পছন্দনীয় সে সমস্ত আমল, যা অল্প হলেও নিয়মিত করা হয়৷৩

তেমনি দৈনন্দিন রুটিনের মধ্যে থাকা উচিৎ নিকটাত্মীয়, বিশেষভাবে মা-বাবার খোঁজখবর নেয়া, তাঁদের প্রয়োজন পূরণ করা৷ এছাড়া স্ত্রী এবং সন্তানদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে সময় বরাদ্দ থাকা দরকার৷

এই সমস্ত দিকনির্দেশনা মেনে প্রাত্যহিক রুটিন ঠিক করে নিয়ে তা অনুসরণ করলে একজন মুসলিম সহজেই যাবতীয় পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে পারবে এবং আল্লাহ তাআলার আনুগত্য করা তার জন্য সহজতর হবে ইনশা আল্লাহ৷


১ আহমদ ও সুনান গ্রন্থসমূহের প্রণেতাগণ কর্তৃক বর্ণিত৷
২ বুখারী, মুসলিম৷
৩ বুখারী, মুসলিম৷

আমাদের ঘরের মাঝের আগন্তুক

$
0
0

(ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ এনামুল হকের আইসিডিতে পরিচালিত হালাকার একটি আলোচনার লিখিত রূপ এই লেখাটি। লেখাটিতে আলোচনাকে পাঠযোগ্য করার জন্য কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করা হয়েছে।)

agontuk

আজ আমি আপনাদের প্রথমে এক পৃষ্ঠার একটা ছোট লেখা পড়ে শোনাব। লেখাটা নাম না জানা কোন বিদেশী লেখকের। অনুবাদ আমার। এই প্রবন্ধটার নাম হচ্ছে ‘আগন্তুক’। এটা থেকেই আমরা আজকের মূল আলোচনায় যাব। এখানে লেখক বলছেন:

“আমার জন্মের কয়েক মাস আগে, আমার বাবার সাথে একজন আগন্তুকের দেখা হয়েছিল – যে আমাদের ছোট্ট শহরে তখন নতুন এসেছিল। শুরু থেকেই আমাদের বাবা ওই মুখর আগন্তুকের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট বোধ করেন এবং শীঘ্রই তাকে আমাদের সাথে এসে বসবাস করতে আমন্ত্রণ জানান। তার চেহারা বাহির থেকে দেখতে খুব আকর্ষণীয় মনে না হলেও সবাই তাকে খুব তাড়াতাড়ি আপন করে নিল এবং কয়েক মাস পর যখন পৃথিবীতে আমার আগমন ঘটল (অর্থাৎ ঐ লেখকের জন্ম হোল) তখন আর সবার সাথে, সেও আমাকে স্বাগত জানাল। আমি যখন বড় হচ্ছিলাম তখন বাড়িতে এই আগন্তুকের অবস্থান নিয়ে মনে কোন প্রশ্ন আসেনি। আমার কচি মনে পরিবারের সকল সদস্যের জন্য একেকটা আসন ছিল। আমার পাঁচ বছরের ছোট ভাই ইউসুফ ছিল আমার জন্য অনুসরণীয় উদাহরণ।” ..

এখানে একটা মুসলিম পরিবারের কথা বলা হচ্ছে।

.. “আমার ছোট বোন সাদিয়া আমার খেলার সাথী ছিল। সে আমাকে, নিজেকে বড় ভাই ভাবার যোগ্যতা দান করে ও মানুষকে ক্ষ্যাপানোর বিদ্যা অর্জনে সহায়তা করে। আমার বাবা-মা ছিলেন সম্পূরক, পরিপূরক শিক্ষক। মা আমাকে আল্লাহকে ভালোবাসতে শেখান আর বাবা শেখান কী করে আল্লাহর আনুগত্য করতে হয়। কিন্তু ওই আগন্তুক আমাদের গল্প শোনাত। সে অদ্ভুত সুন্দর সব হৃদয়গ্রাহী গল্প বানাতে ও শোনাতে পারত – অ্যাডভেঞ্চার, রহস্য, কমেডি আরও কত কী! এসবই ছিল তার দৈনন্দিন সংলাপ। প্রতিদিন বিকালে সে আমাদের গোটা পরিবারকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তার শ্রোতা হিসাবে ধরে রাখতে পারতো – আর সপ্তাহান্তে আমাদের জেগে থাকা সময়টুকুর প্রায় সবটুকু সে-ই নিয়ে নিতো। আমি যদি রাজনীতি, ইতিহাস বা বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছু জানতে চাইতাম, সে তা জানাত। সে অতীত সম্পর্কে জানাত এবং মনে হতো বর্তমান সম্পর্কেও তার সম্যক জ্ঞান রয়েছে। সে এমন সব জীবন্ত ছবি আঁকতে পারত যে আমি প্রায়ই সেগুলো দেখে কাঁদতাম অথবা হাসতাম। সে আমাদের গোটা পরিবারের একজন বন্ধুর মতো ছিল। সে আমাকে, আমার বাবাকে ও ইউসুফকে আমাদের জীবনে দেখা প্রথম আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট ম্যাচে নিয়ে যায়। সে আমাদের সবসময় সিনেমা দেখতে উৎসাহ দিত। এমনকি বহু নামী-দামী মানুষের সাথে আমরা যেন পরিচিত হতে পারি, সে তারও ব্যবস্থা করে দিত। সে অনর্গল কথা বলতে পারত। আমার বাবা মনে হয় তাতে কিছু মনে করতেন না বা বিরক্ত হতেন না। কিন্তু আমরা বাকিরা যখন হাঁ করে তার বলা কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কথা শুনতাম, মা তখন মাঝে মাঝেই তার সভা থেকে উঠে যেতেন। নিজের ঘরে গিয়ে তিনি কুরআন পড়তেন। কখনো তিনি সন্তর্পণে আমাদের বলতেন, নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: ‘ঈমানের সুন্দর দিক হচ্ছে সকল নিষ্ফল কাজ-কর্ম এড়িয়ে চলা’।”

আমরা হাদিস জানি, হয় উত্তম কথা বল নাহলে চুপ থাক; এর সাথে সকল নিষ্ফল কাজ এড়াতে বলেছেন আল্লাহর রাসূল(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)।

“এখন আমি মাঝে মাঝে ভাবি, মা কী কখনো এমন দু’আ করতেন যে, ওই আগন্তুক যেন চলে যায়? আমার বাবা আমাদের পরিবারকে কিছু নৈতিক নিয়ম-কানুনের ভিত্তিতে পরিচালিত করতেন। কিন্তু এই আগন্তুক সেগুলোকে সম্মান করার কোন প্রয়োজন বোধ করত না। এমনিতে আল্লাহর বিরুদ্ধে কোন আচরণ আমাদের বাড়িতে বরদাস্ত করা হতো না, আমাদের তরফ থেকে তো নয়ই, আমাদের বন্ধুদের বা বড়দের তরফ থেকেও ওই ধরণের কোন আচরণ বরদাস্ত করা হতো না। কিন্তু আমাদের অনেকদিনের অতিথি কখনো এমন চার অক্ষরের শব্দ ব্যবহার করত যাতে আমার কানে শীশা ঢালার অনুভূতি হতো এবং আমার বাবা তখন অস্বস্তিতে গজগজ করতেন। তবে আমার জানামতে এই আগন্তুককে কখনো চ্যালেঞ্জ করা হয়নি।”

চার অক্ষরের শব্দ আমি এখানে বললাম না, ইংরেজীতে যাদের জ্ঞান আছে তারা বুঝতেই পারছেন কোন অশ্লীল শব্দ এটা।

“আমার বাবা কখনোই মদ স্পর্শ করেননি এবং কখনো বাড়িতে অ্যালকোহল অনুমোদন করেননি। এমনকি রান্নার জন্যও নয়।”

আগেই বলেছি এটা একটা বিদেশী লেখা, আমার কাছে এসেছে একজন শ্রীলংকান মুসলিমের তরফ থেকে।

“কিন্তু ওই আগন্তুক যেন মনে করত যে, আমাদের অন্য ধারার জীবন সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা আবশ্যক। সে আমাদের প্রায়ই বিয়ার ও অন্যান্য মদজাতীয় পানীয় সাধত। সে আমাদের বোঝাত সিগারেট বেশ মজার একটা জিনিস, চুরুট বেশ পুরুষালী আর পাইপ হচ্ছে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। সে খোলামেলাভাবে যৌনতা নিয়ে কথা বলত। তার মতামতগুলো ছিল চাঁছাছোলা, কখনো ইঙ্গিতবহ আর প্রায়শই বিব্রতকর। কিভাবে রসিয়ে রসিয়ে মেয়েদের সাথে আলাপ জমান যায় তাও সে আমাদের শিখিয়ে দিত। আমি এখন বুঝতে পারি, নারীপুরুষের সম্পর্কের ব্যপারে আমার মনে প্রোথিত প্রাথমিক ধারণাগুলো তার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এখন যখন আমি পেছনে ফিরে তাকাই, তখন আমার মনে হয় যে, এটা আমাদের জন্য আল্লাহর এক বিশেষ রহমতের ব্যপার ছিল যে ওই আগন্তুক আমাদের আরও বেশি প্রভাবিত করতে পারেনি। বারবার সে আমার বাবা-মার শেখান নৈতিক মূল্যবোধের বিরোধিতা করত। তথাপি তাকে কদাচিৎ শাসন করা হতো বা চলে যেতে বলা হতো।”

অর্থাৎ, তাকে কখনোই শাসন করা হতো না বা চলে যেতে বলা হতো না।

“যখন থেকে সে আমাদের পরিবারের সাথে বসবাস শুরু করেছিল, তারপর প্রায় তিরিশ বছর পেরিয়ে গেছে। এখন অবশ্য আমার বাবার কাছে সে তার আগমনের পরের প্রথম দিককার দিনগুলোর মতো প্রিয় নয়। কিন্তু তবুও এখনো আমি যদি কখনো আমার বাবা-মায়ের শোবার ঘরে প্রবেশ করি, তবে দেখি সে এক কোণায় বসে রয়েছে – কখন কেউ তার কথা শুনবে বা তার আঁকা ছবি দেখবে বা সে তার যাদু দিয়ে শ্রোতাদর্শককে বিমোহিত করবে সে অপেক্ষায়। আপনারা হয়ত তার নাম জানতে চাইবেন, আমরা তাকে টেলিভিশন বলে ডাকি।”

পুরো লেখাটা ছিল এই। আজকে আমাদের আলোচনাটাও আমাদের বাসার টেলিভিশন নিয়ে। যে জিনিসগুলো আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের নিষেধ করি, সে জিনিসগুলো নাটক-সিনেমায় দেখানো হয়। বিয়ার, মদের বিজ্ঞাপন দেখেন নিশ্চয়ই আপনারা? ই.এস.পি.এন.-এ ক্রিকেট দেখার সময় সাথে দেখেন না এগুলো? বাবা-ছেলে-মেয়ে বসে একসাথে দেখেন। আরও ইঙ্গিতপূর্ণ জিনিসও দেখেন। এখানে যা যা বলেছে তার একটা কথাও মিথ্যা না। এবং সে (টিভি) যখন এগুলো বলে, আমরা সবাই পাশাপাশিই বসে থাকি – একটু বিব্রত বোধ করি, কিন্তু হজম করে নেই। সে আমাদের সমস্ত ইসলাম বিরোধী, নৈতিকতা বিরোধী জিনিস বলে যায় এবং আমরা হজম করে নেই। আজকাল পেপারে দেখি: যে সমস্ত খুন হচ্ছে, (আমাদের বাসায় আলহামদুলিল্লাহ্‌ বার বছর টিভি নেই – তাই আমি দেখি না, কিন্তু) এগুলো নাকি সমকালীন সিরিয়ালগুলোর উপজীব্য! বাংলাদেশের পেপার খুললে কে কার স্বামী বা স্ত্রীকে মারলো, পরকীয়া প্রেম এগুলোই দেখা যায় – এটাই বলা হয়েছে এই লেখায়। আসুন, আমরা এখন আমাদের মূল আলোচনায় যাই।

আমরা “STRANGER IN OUR HOMES: TV AND OUR CHILDREN’S MIND” বইটা নিয়ে একটু কথা বলব। বইটার ভূমিকা ও সমাপ্তি লিখেছেন ইসলামের একজন পশ্চিমা ‘আলিম। উনি মালিকি মাযহাবের জোরালো সমর্থক ও সুফীবাদের প্রতি কিছুটা ঝোঁক আছে তার। আমি তার আক্কীদা-মানহায গ্রহণ না করলেও, সামাজিক ব্যপারগুলোতে তার কথাগুলো অত্যন্ত শক্তিশালী বলে মনে করি। তার নাম: হামযা ইউসুফ হ্যানসন। ক্যালিফোর্নিয়াতে “যায়তুনা” বলে একটা মাদ্রাসা আছে তার। এই বইটা যায়তুনা ইন্সটিটিউট থেকে ২০০০ সালে বের করা হয়েছে। বইটার সামনে পিছনে তার লেখা আছে, কিন্তু মূল বক্তব্যটা সুজান আর. জনসন বলে একজন মহিলার। তিনি ডক্টর অফ মেডিসিন(MD), এসিস্ট্যান্ট ক্লিনিক্যাল প্রফেসর অফ পেডিয়্যাট্রিক্স, ডিভিশন অফ বিহেভিয়রাল অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পেডিয়্যাট্রিক্স। আমরা আজকে এই বইয়ে সংযুক্ত তার একটা লেখা নিয়ে কথা বলব, যা ১৯৯৯ সনের জানুয়ারির ৫ তারিখে সানফ্রানসিসকোতে তিনি একটা বক্তৃতার মাধ্যমে উপস্থাপন করেছিলেন।

তিনি শিশুদের মনস্তত্ত্ব নিয়ে, স্কুলের বাচ্চাদের নিয়ে, কেন তাদের পড়াশোনায় মনোযোগ নাই, কেন কিছু জিনিস শিখছে, কিছু জিনিস শিখছে না – এসব বিষয়ে অনেক গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথমে বলছেন যে, মা হওয়ার আগে পর্যন্ত বিষয়টা তিনি সেভাবে বুঝতে পারেন নি। তিনি এক জায়গায় সাত বছর চাকরি করেছেন এবং আট থেকে বার বছর বয়সী যেসব বাচ্চাদের শিখতে অসুবিধা হয়, তাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন – শত শত বাচ্চাদের দেখেছেন, যারা মনোযোগ দেয় না বা পাঠ্য বিষয়গুলো ঠিকমত ধরতে পারে না; কিন্তু যেসব কাজে শারীরিক অঙ্গভঙ্গির প্রয়োজন হয়, যেমন ছবি আঁকা, লেখালেখি বা জ্যামিতিক আকৃতি নিয়ে খেলা – এসবে তারা ভালো করছে। আবার অনেক বাচ্চাই অন্যদের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না।

শিশু চিকিৎসক হিসাবে তিনি সবসময় টেলিভিশন দেখাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, কারণ এটা অনেক সময় হিংস্র জিনিস প্রচার করে। বাচ্চাদের কার্টুনে অনেক সময় নানা ধরনের জোরালো শব্দ থাকে, ‘বুম’, ‘ব্যাঙ’ ইত্যাদি। এমনকি আমরা যখন টম অ্যান্ড জেরি দেখতাম, সেখানেও ‘দুম-দুম-দুম-দুম’ করে পিটানোর শব্দ থাকত। আমরা মনে করি এটা তো বিনোদন, এগুলো তো সত্যি কিছু না – কিন্তু বাচ্চাদের মাথায় এই জিনিসগুলো ঢুকে যায়। এমনকি বিজ্ঞাপনেও যা দেখান হতো, সেগুলো নিয়ে তিনি চিন্তা করতেন যে, ওগুলো ক্ষতিকর, ওগুলো এড়িয়ে চলা উচিৎ। তার নিজের বাচ্চা জন্মানোর আগেও, এসব নিয়ে এধরনের তিনি চিন্তাভাবনা করতেন।

কিন্তু নিজের বাচ্চা হওয়ার পর, আস্তে আস্তে বুঝলেন যে, টিভিতে যা-ই দেখান হোক না কেন তা-ই আসলে বাচ্চাদের জন্য ক্ষতিকর – এমনকি যদি জীব-জন্তু, গাছ-পালা দেখান হয় তাহলেও। আমরা অনেক সময় মনে করি ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেল মনে হয় খুব উন্নতমানের প্রচার মাধ্যম – কিন্তু আসলে ব্যপারটা তা না। তার বাচ্চা হওয়ার পর টিভির আসল ক্ষতিটা কোথায়, সেটা তিনি বুঝতে শুরু করলেন। কী দেখান হচ্ছে সেটা মূল ব্যাপার ছিল না, কারণ, তিনি সচেতনভাবে সমস্ত মারামারি-হানাহানি-অশ্লীলতা বাদ দিতেন! কিন্তু তারপরও দেখলেন যে, তার বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কেন নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সেটা দেখব আমরা।

আমরা অনেকেই এখন বাচ্চাদের “টিভি” ঘুষ দিয়ে থাকি। আজকাল অনেক পরিবারেই স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করেন। বাচ্চাদের জন্য তাদের সময় নাই। বেশী টাকার বা বড় মাইনের চাকরির প্রয়োজন – মৌলিক চাহিদা মেটাতে নয়, বরং মূলত দামী দামী “জিনিস” বা “আসবাবপত্র” সংগ্রহ করতেই দুজনের চাকুরী করা প্রয়োজন। আপনাকে যে সময়টাতে বাচ্চারা “মিস” করছে, ওই সময়টা আপনি ঘরে, টিভির সামনে, বসিয়ে রাখছেন তাদের।

আমাদের দেশ সাদা সাহেবরা শাসন করে গেছে, কিন্তু আমরা অনেক রক্ষণশীল ছিলাম। একটা মুসলিম পরিবারের  শোবার ঘরে কখনো তারা ঢুকতে পারেনি, এমনকি আমাদের বাড়িতেও কখনো ঢুকতে পারেনি। আমরা বলি, মুসলিম পরিবার হচ্ছে আপনার দুর্গ, এটা সবার জন্য উন্মুক্ত না। তারা কখনো আমাদের স্ত্রীদের সামনে আসেনি। আজকে কী হচ্ছে, শোবার ঘরে টেলিভিশনের পর্দায় একজন সাদাচামড়ার সাহেব গান গাচ্ছে – আপনার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতবহ গান – আপনার স্ত্রী দেখছেন না? আমরা কোথায় নিয়ে এসেছি তাদের কথাকে, সংষ্কৃতিকে!

শিশুবিশেষজ্ঞ সুজান বলছেন, কী দেখান হচ্ছে সেটা কোন ব্যাপার না। টিভির মাধ্যমে তার বাচ্চার আচরণ পরিবর্তন হয়ে গেল। আপনারা দেখবেন, বাচ্চারা যখন টিভি দেখে, তখন তারা কিন্তু আপনার সাথে ভালোভাবে কথা বলবে না; অর্ধেক মনোযোগ দিয়ে সে আপনাকে শুনছে, তার চোখ-কানের অর্ধেক ওইদিকে। সে হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছে, দাঁড়িয়েও শুনছে না আপনার কথা। তার আচরণ পাল্টে যাচ্ছে। টিভি দেখার আগে, দেখার সময় ও পরে তার মানসিক ও শারীরিক নড়াচড়া পাল্টে যাচ্ছে। তিনি কিন্তু অমুসলিম মহিলা – সাধারণ পর্যবেক্ষণের কথা বলছেন – সব অবস্থাতেই তার বাচ্চার আচরণ পাল্টে গেছে, যা দেখে আসলে তিনি রীতিমত ‘ভয়’ পেয়েছেন।

তারপর উনি বলছেন, যখন বাচ্চা টিভি দেখত না তখন সে প্রকৃতির মাঝে থাকত, পোকামাকড়ের প্রতি কৌতহল প্রকাশ করত। গ্রামে গেলে দেখবেন আমাদের এদেশীয় বাচ্চারা জোনাকি পোকা নিয়ে কি করে – ধরবে, ধরে গ্লাসের ভেতর ঢুকাবে, দেখবে কতক্ষণ জ্বলে! তো, তার বাচ্চাও প্রকৃতির সাথে বড় হচ্ছিল। আমরাও তো ছোটবেলায় বালু দিয়ে, পানি দিয়ে খেলতাম, দুর্গ বানাতাম। তারপর সুজান বলছেন, তার বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে শান্তিতে ছিল – নিজেকে নিয়ে, নিজের শরীর নিয়ে, তার পারিপার্শ্বিকতাকে নিয়ে। যদি আপনি দেখেন একটা বাচ্চা প্রকৃতির মাঝে খেলছে, দেখবেন সে আনমনে অনেক কিছু করে যাচ্ছে। আমাদের মায়েরা ছয় ছয়টা বাচ্চা প্রতিপালন করেছেন, কোথায় অত সময় দিতে পেরেছেন তারা? এখন তো ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার, ব্লেন্ডার আছে। তখন তো ওসব ছিল না। আমাদের মায়েরা আমাদের প্রতিপালন করেছেন কী করে? আমরা প্রকৃতির মাঝে বড় হয়েছি। কিন্তু আজকে আমাদের বাচ্চারা খোপের ভেতর বড় হচ্ছে এবং তাদের আচরণ পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন চাইলেই শহর ভেঙ্গে গ্রাম বানিয়ে ফেলতে পারব না। কিন্তু আল্লাহ, আল্লাহর রাসূল যেভাবে ছেলেমেয়েদের বড় করতে বলেছেন, তার সাথে কিন্তু সুজানের উৎকন্ঠা ও চাওয়াগুলো মিলে যায় – তিনি খুব ইসলামিক একটা কথা বলেছেন না জেনেই।

তারপর তিনি বলছেন, যখন তার বাচ্চা টিভি দেখতে শুরু করল, সে তার প্রতি খুবই অমনোযোগী হয়ে গেল। উনি ডাকছেন অথচ বাচ্চার কোন সাড়া নই। চোখটা আঠার মতো লেগে আছে টিভিতে। সে তার চারপাশের পরিবেশের প্রতিও অমনোযোগী হয়ে গেল। ঘরে একজন মেহমান এলো – তার কথা বলার সময় নাই, তাকানোরও সময় নাই। আমাদের ছোটবেলায় ঘরে আপন মামা, চাচা আসলে আমরাই চা, শরবত নিয়ে গেছি; কাজের মানুষ না। এগুলোর সময় নেই তার। এখন আমাদের আরও যেটা হয়, ছোট বাচ্চাদের খাওয়ানোর উপায় হচ্ছে টিভি, ওদিকে তাকিয়ে বিজ্ঞাপন দেখছে আর গিলছে। খাবারের দিকে তার কোন মনোযোগ নাই, খাবার সে চাবাচ্ছে না; তার তো পেট খারাপ হবেই! কারণ আমাদের খাওয়াটা গন্ধ, স্পর্শ, রংসহ দেখতে যা লাগে – তা থেকে আমাদের মুখে পানি আসে, লালা আসে, ইচ্ছা জাগে খাওয়ার। আমরা চিবাই আর খাবারটা সহজে হজম হয়। কিন্তু টিভির দিকে তাকিয়ে ওভাবে গিললে, খাবার হজম হয় না। বাচ্চারা অপুষ্টিতে ভোগে; দাঁত ওঠে না, চোখে দেখে না – কতরকম সমস্যা হচ্ছে না এখন? এগুলো কিন্তু অনেক কারণে হয়, এসব চিন্তা করার ব্যপার। মুসলিমরা চিন্তা করবে – আল্লাহ তাদের কেন জন্ম দিলেন, কী কারণে, কোনটা করলে সবচেয়ে ভালো হয় ইত্যাদি।

তারপর উনি বলছেন, আমি যখন টিভি বন্ধ করে দিতাম, সে বিরক্ত হত, ঘ্যানঘ্যান করত, কখনো চিৎকার করত, কখনো কাঁদতো – টিভিটা আবার ছেড়ে দেয়ার জন্য। তার খেলাধুলাগুলো অগোছালো হয়ে যাচ্ছিল, কোন নিয়মের ধার ধারত না সেতার নড়াচড়াও ঠিক ছিল না – বাচ্চাদের যেমন স্বাভাবিক হওয়ার কথা তেমন ছিল না। তার খেলায় নিজস্ব কল্পনা থাকত না। বিদেশীদেরও কিন্তু দেখবেন – আল্লাহ ওদের অনেক জায়গাজমি দিয়েছেন – তারা কল্পনাশক্তি ব্যবহার করত খেলাধুলায়, গাছের ওপর ঘর বানাত ইত্যাদি। এই যে নিজের চিন্তা থেকে কিছু করা – এগুলোর কোন আগ্রহ রইলো না সুজানের বাচ্চার, যখন সে টিভি দেখতে শুরু করল। সে নিজে থেকে কিছু না করে টিভিতে যা দেখছে, ঠিক তার মতো করেই একটা কিছু করার চেষ্টা করছে।

এরপর উনি আট থেকে এগার বছরের ছয়টা বাচ্চাকে নিয়ে গবেষণা করলেন। আমরাও মনে প্রাণে বিশ্বাস করি এক থেকে এগার/বার বছরের মধ্যে বাচ্চাদের মাথায় যেটা ঢুকে, সেটা বের করা যায় না। এই সময়টা আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের বাচ্চাদের যত্ন নিজে নেবেন, তাকে দ্বীন শেখাবেন, আল্লাহর কথা শোনাবেন, নবীর গল্প শোনাবেন, ইসলামের ইতিহাস শোনাবেন – আল্লাহর ওয়াস্তে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসপত্র তাদের কাছে উন্মোচিত করবেন না। কারণ এই সময় যা শিখবে, তা মাথা থেকে বের হবে না। আমার মনে আছে ওই রকম বয়সে আমার স্কুলের টিচার একটা কথা বলেছিলেন যা প্রকারান্তরে বোঝায় বিজ্ঞান ঠিক, কুরআন ভুল। অথচ উনি যা বলেছিলেন, তা কুরআনে কোথাও লেখা নেই। আমার মনে আছে আমার কেমন লেগেছিল তখন, আমার কিশোর মন ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে কী হয়? আল্লাহ, আল্লাহর দ্বীন সম্পর্কে মনে হীনমন্যতা জন্মায়, পরবর্তীতে আমরা কিন্তু আর ইসলামকে শ্রদ্ধা করতে পারব না। আমাদের কাছে কুফফার, নাসারা, ইহুদীদের জিনিসই প্রাধান্য পাবে। এ জন্য এই বয়সটা খুব যত্ন নেবেন বাচ্চাদের, তাদের সময় দেবেন, টিভির মতো আবর্জনা থেকে দূরে রাখবেন – ইসলামের বা সাধারণ সুন্দর সুন্দর গল্প বলবেন, টিভি বা কার্টুনের ঘুষ দিয়ে বসিয়ে রাখবেন না।

যাই হোক, তার গবেষণার বাচ্চাদের ব্যপারে উনি বলছেন, কোন শব্দ বা অক্ষর বলা হলে তারা সেটার মানসিক আকৃতি দিতে পারত না। এই জিনিসটা ব্যখ্যা করি, কল্পনার ভেতর কোন জিনিস দেখা। যেমন, যারা গাড়ি চালায়, যদি একটা ম্যাপ উল্টা থাকে আপনি মনে মনে ম্যাপটাকে সোজা করে পথটা বুঝে নিবেন। একে বলে স্প্যাশিয়াল অ্যাবিলিটি (SPATIAL ABILITY)। এটা মস্তিষ্কে গড়ে তুলতে হয়। মনের এই কল্পনাশক্তিটা জন্ম না নিলে এই দক্ষতাটা আসবে না। আর এটা আসবে না, যদি কেউ হাঁ করে বসে থেকে সারাদিন টিভি দেখে। যার এই দক্ষতা যত বেশি সে তত ভালো ইঞ্জিনিয়ার, ম্যাথমেটিশিয়ান হতে পারবে। এরপর উনি বলছেন, যদি তিনি তাদের কয়েকটা অক্ষর দেখিয়ে একটা বের করতে বলতেন, তাহলে তারা সেটা পারত; কিন্তু না দেখালে তারা আর পারছে না। এই সকল বাচ্চারাই অনেক টিভি, ভিডিও দেখত আর কম্পিউটার গেম খেলত – কেন পারেনি তার মূল কারণ হচ্ছে এসব। আপনি মনে করবেন না কম্পিউটার গেম নিরাপদ, তা না কিন্তু! অনেক ‘ঢিসুম-ঢাসুম’ আছে। তখন উনি চিন্তা করতে শুরু করলেন টিভির সামনে বাচ্চাদের রাখলে কী সমস্যা হয় তাদের? সমস্যাটা হচ্ছে, মস্তিষ্কের জন্য আর করার কিছু থাকে না, এর চিন্তা-ভাবনা করার, কাজ করার কিছু নাই। জানেন তো, মানুষের বাচ্চাকে দশ-বিশ বছর কোন কাজ করতে না দিলে, চেয়ারে বেঁধে রেখে দিলে সে কিন্তু আর দাঁড়াতেও পারবে না, হাঁটতে পারবে না – আল্লাহ মানুষকে এভাবেই বানিয়েছেন। গরু-ছাগলের বাচ্চা জন্মগতভাবেই ডাক দিতে, হাঁটতে, দৌড়াতে পারে কিন্তু মানুষের বাচ্চাকে শেখাতে হয়। এই কারণে বলছেন, মানুষের বাচ্চা যখন টিভি দেখে, তখন সবকিছু তার মাথার ভেতরে ঢুকছে, সে নিজে চিন্তা করে কিছু বের করে না।

এরপর উনি বলছেন, শিশুদের দেখা, শোনা, স্বাদ নেয়া, গন্ধ নেয়া, স্পর্শ করা এই পঞ্চন্দ্রিয়ের প্রত্যেকটা কাজে লাগে এমন ব্যপারে নিয়োজিত করতে হবে। এখানে আমি আমার নিজের জীবনের একটা গল্প বলি: আমার মেয়ে যখন ছোট ছিল, তখন শীতকালে একবার সে আম খেতে চাইল। তার মা বলল এখন তো আম পাওয়া যাবে না। সে বলে উঠল, দোকানে গেলে পাওয়া যাবে না? এখন, এই বিষয়টা আসলে কী? তার মাথায় আছে পয়সা দিলে দোকানে সব পাওয়া যায়। একে আমরা বলি “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, অর্থাৎ আমার এক্ষুণি দরকার, এক্ষুণি চাই, তুমি যেখান থেকে পার এনে দাও। এটা কিন্তু চরিত্রটাকে নষ্ট করে দেয়। সে সবকিছু রেডিমেড পেতে, দেখতে ও কিনতে শেখে। অপরদিকে, সে যদি প্রকৃতির মাঝে থাকত তাহলে কী দেখত? প্রথমে দেখত আমের মুকুল আসছে, তারপর দেখত কিছু ঝরে গেছে আর কিছু রইল, তারপর আমের গুটি আসছে, সেখান থেকেও কিছু ঝরে গেল, এরপর কিছু কাঁচা আম এলো, তারপর বৈশাখের ঝড়ে কিছু ঝরে গেল কিছু রইল, যা টিকল সেটা পাকল, পাকার পর সেটা পাড়া হোল ও সবাই ভাগ করে খেলো। এর মাঝে কী নিহিত আছে? ইসলামের সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয় জিনিসটা – সবর বা ধৈর্য! আজকাল দেখবেন আমাদের সবর নাই কারণ আমরা মনে করি পয়সা দিলেই তো সব পাওয়া যায়। আমরা একটা ধৈর্যহীন প্রজন্ম হয়ে যাচ্ছি। পড়াশোনা করব তারপর ভালো রেজাল্ট হবে, তার চেয়ে নকল করলেই তো হয়ে যায়! এসবই কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” বা “তৎক্ষনাৎ তৃপ্তি” লাভের প্রবণতার ফল। আগে টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন ছিল, “কোকোলা লজেন্স এক্ষুনি আনো”! এই কথাটা কিন্তু খুবই ইসলাম বিরোধী! কেন? আমাদের আল্লাহ কী বলেছেন? এই দুনিয়ায় সবকিছু পাবে না, দুনিয়া থেকে আমরা ততটুকু নিব, যতটুকু বাঁচার জন্য দরকার। সমস্ত প্রতিজ্ঞা আখিরাতের জন্য। এখন ধৈর্য ধরবেন, পরবর্তীতে পাবেন – এটা হচ্ছে ইসলামের শিক্ষা। আল্লাহ আপনাকে যা এখানে নিষেধ করছেন, সেটা কিন্তু বলছেন জান্নাতে পাওয়া যাবে। দুনিয়া হচ্ছে ধৈর্যের ব্যপার, অপেক্ষা করার ব্যপার, “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস এটা।

এরপর লেখিকা বলছেন, বাচ্চাদের ইন্দ্রিয়গুলো স্পঞ্জের মতো হয়; যা দেখবে তাই শুষে নেয় এবং তাদের কোন একটা ইন্দ্রিয়কে বেশি উত্তেজিত করলে, অন্যগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। যদি শুধু চোখ আর কান এক জায়গায় আটকে দেয়া হয় তাহলে বাকিগুলো ব্যবহৃত না হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। সবকয়টা ইন্দ্রিয়ের দরকার আছে; সে প্রকৃতির কাছে যাবে, একটা কিছু ধরবে, একটা পিঁপড়া কামড় দেবে – এর দরকার আছে। একটা ফুলের ঘ্রাণ সুন্দর আরেকটার বাজে, এর দরকার আছে; একটা জিনিসের স্বাদ ভালো আর একটার স্বাদ কষটা, এর দরকার আছে। প্রত্যেকটা অভিজ্ঞতার দরকার আছে। বাচ্চা বড় হবে ও সেই সাথে তার সব ইন্দ্রিয়গুলো গড়ে উঠবে – এটাই বলছেন তিনি। এরপর লেখিকা বলছেন, ছোটবেলায় সবকিছুই সে গ্রহণ করবে, এর মাঝে বাছবিচার করতে শিখবে না সে। শব্দের ব্যপারটাই ধরুন, প্রচন্ড সশব্দ মিউজিকে আপনি পাশের বাসায় বসে টিকতে পারছেন না, কিন্তু একটা বাচ্চা তার মাঝেই বসে আছে! এর মানে কী? সে এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখন আর স্বাভাবিক শব্দের মাত্রা তার ভালো লাগবে না। আর, স্পর্শের ইন্দ্রিয়ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মা ও মাটি এই দুটা ছাড়া কোন বাচ্চা প্রাকৃতিকভাবে বড় হতেই পারে না। এই মহিলা বিধর্মী তাও বলছেন, মানুষ হওয়ার জন্য মায়ের স্পর্শে থাকতে হবে। মাটি ধরবে, মলিন হবে এবং মায়ের কাছে থাকবে – এসবকিছুই খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যপার।

এরপর আমরা লেখা শেষের প্রশ্নোত্তর পর্বটা একটু দেখবো। টিভি দেখার ফলে মনের উপর কি ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে? টিভি দেখার কারণে যখন আপনি মনকে একখানে আটকে ফেলেন, তখন আপনি অন্য অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হন – যা মস্তিষ্কের বেড়ে ওঠাকে বাধাগ্রস্ত করবে। একটা বাচ্চার সাথে যদি কথা বলা না হয়, খেলা না হয়, তাকে স্পর্শ করা না হয় তাহলে তার মস্তিষ্কের আকার ২০-৩০% ছোট হয়ে যায়। ছোঁবেন কখন, আপনি তো অফিসে! আপনার স্ত্রীও অফিসে। কথা বলারও সময় নেই। টেলিভিশনের কথা না, আপনার নিজের কথা বলার কথা বলছি আমরা। প্রাণীর ওপর গবেষণায় দেখা গেছে, একটা প্রাণীকে আটকে রেখে যদি অন্য প্রাণীদের খেলা দেখতে দেয়া হয় – টিভির মতো যেখানে আপনার নিজের নড়াচড়া নাই কিন্তু আপনি নড়াচড়া দেখছেন – তাহলে দেখা গেছে, প্রাণীটা যত বেশি দেখেছে, তত বেশি তার মস্তিষ্কের আকার কমে যাচ্ছে। এরপর ব্যাপারটা টিভির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে দেখা যাবে, টিভি শুধু দুইটা ইন্দ্রিয়কে উদ্দীপ্ত করে – দেখা আর শোনা। এতে করে আপনার চিন্তাশক্তি কমে যাচ্ছে, মস্তিষ্কের আকার ছোট হয়ে যাচ্ছে, কল্পনাশক্তি কমে যাচ্ছে – আপনি লিখতে-পড়তে পারবেন না, আপনার কোন মনোযোগ থাকবে না!

এখানে একজন জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আমরা কী করতে পারি? শিশুচিকিৎসক সুজান পরামর্শ দিলেন,

১। যতটা সম্ভব টিভি বন্ধ করে রাখুন।

এটা খুবই সাধারণ কথা। আমাদের বাসায় বারো বছর টিভি চলে না। বাসায় দুইটা বাচ্চা আছে, একজন এগার বছর অন্যজন আট, জীবনে কোনদিন টিভি দেখেনি তারা। তাদের মস্তিষ্কের গ্রহণক্ষমতা আপনি কল্পনা করতে পারবেন না – বড়টা নিজে নিজে কুরআন দেখতে দেখতে পড়তে শিখেছে। আসহাবে রাসূলের কাহিনী, ইবন কাসীর তার পড়া শেষ। কেন? তার তো “ইনপুট” দরকার! তার মস্তিষ্ক কিন্তু খালি! এবং তার কত প্রশ্ন – জীবন নিয়ে, প্রকৃতি নিয়ে, বিজ্ঞান নিয়ে! টেলিভিশন দেখা বাচ্চারা কিন্তু কোন প্রশ্ন করবে না। তার প্রশ্ন করার কিছু নাই, ওখানেই সে সব দেখছে।

২। বাচ্চাদের বই পড়ে শোনাবেন – যেটা আমাদের মায়েরা, খালারা বা বড় ভাই-বোনেরা করেছে – বিশেষ করে ছবি ছাড়া বই।

আজকাল দেখবেন পুরো বইজুড়ে শুধু ছবি, এক লাইন লেখা। উনি কিন্তু উল্টা বলছেন, পুরোটা লেখা, একটু হয়ত ছবি থাকতে পারে। এতে কী হবে? সে কল্পনা করতে শিখবে। মুসলিম পরিবারে ছবি ছাড়া গল্প বলা নিয়ে কোন সমস্যা নেই। আমরা যখন নবী(সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের) গল্প বলি আমরা কি ছবি দেখাই? আর প্রচুর গল্প বলবেন।  ইনশাল্লাহ আমরা যারা মুসলিম আমরা নবী-রাসূলের গল্প, সাহাবীদের গল্প, কুরআন-হাদীসের গল্প বলব। আজকাল অনেক সাহিত্য আছে যেখান থেকে আমরা পড়তে পারি।

৩। প্রকৃতি! প্রকৃতি! প্রকৃতি!

যার যতটুকু সময় ও সুযোগ আল্লাহ দিয়েছেন, প্রকৃতির কাছে বাচ্চাদের নিয়ে যাবেন। যতবার সম্ভব। প্রতিটি সম্ভাব্য ছুটিতে। এমনকি প্রতি সপ্তাহ শেষে যদি পারেন – ঘাস, মাটি, পোকা, বালু, কাদার ভেতর নিয়ে যাবেন। ধৈর্যের সবচেয়ে বড় শিক্ষক হচ্ছে প্রকৃতি। একটা গাছ পুঁতল, পানি দিল কিন্তু গাছটা মরে গেল। গাছ মরতেই পারে। শিক্ষা না এটা? আমার একটা ছোট ভাই ছিল, আব্বা-আম্মার অনেক আদরের কিন্তু মারা গেছে। মরতে পারে না? প্রকৃতি আপনাকে ধৈর্য শিখাবে। আপনি ধাক্কা খাবেন না। বুঝবেন যে সবকিছু ধীরে ধীরে হয়। “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশনের” উল্টা জিনিস হচ্ছে “ডিলেইড গ্রাটিফিকেশন” (বিলম্বে তৃপ্তি)। এর উদাহরণ কী? রোজা! সারাদিন অপেক্ষার শেষে পানি খেতে পারবেন। প্রকৃতি আপনাকে এই শিক্ষা দিবে। মানুষের চরিত্রে এটা গড়ে তোলা দরকার। “নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূন্য থাক” – এটা কাফেরের দর্শন। আর ইসলামের মূল শিক্ষায় রয়েছে পরীক্ষা শেষের ফলাফল – কষ্ট করে ক্ষেতে বীজ বুনে, ফসলের জন্য যেমন আপেক্ষা করতে হয়। নগদ তেমন কিছুই পাবার নেই যেন, যতটুকু দরকার সেটুকু গ্রহণ করে আল্লাহ-নির্ধারিত নিয়মে ও আল্লাহর আনুগত্যে জীবন কাটাতে পারলে, আপনার জন্য রয়েছে জান্নাত। আল্লাহর রাসূলের ওই হাদীস, সমুদ্রের পানিতে আঙ্গুল ডুবিয়ে নিয়ে আসলে যা আঙ্গুলে লেগে থাকে সেটুকু দুনিয়ার জীবন। আর সমুদ্রে যেটুকু পানি রয়ে গেল, তা হোল আখিরাতের অনন্ত জীবন। তাহলে একজন মুসলিম কোন অবস্থায় এই দুনিয়ার জন্য আখিরাতকে নষ্ট করবে না। বরং, আখিরাতে প্রাপ্তির জন্য সে এখানে ধৈর্যধারণ করবে। সে এখানে ত্যাগ করবে, কষ্ট করবে, চোখমুখ বুঁজে থাকবে, সহ্য করে যাবে অনেক কিছু।

এরপর লেখিকা সুজান বলছেন, প্রকৃতি হচ্ছে পর্যবেক্ষণের বড় শিক্ষক। এর রঙগুলো দেখার মতো – আর তা সবগুলো ইন্দ্রিয়কে উজ্জীবিত করে তোলে। একটা ফুল-ফোটা সর্ষেক্ষেত আর কিছু দিয়ে বর্ণনা করা যায়? এরপর উনি বলছেন, আজ অনেক বাচ্চা আছে যারা প্রকৃতির কাছে যেতে আগ্রহ পায় না, বলে ‘তোমরা যাও আমি এখানে বসে কার্টুন দেখি বা গেম খেলি।’ আছে না এমন? নড়তে চায় না। মুরগী (ফ্রাইড চিকেন) খেতে খেতে এরা মোটা হয়ে গেছে। ফাস্টফুড কিন্তু “ইনস্ট্যান্ট গ্রাটিফিকেশন”, মানে রান্নার জন্য অপেক্ষার প্রয়োজন নেই – সেই ধৈর্যও নেই। এক্ষুণি দরকার আমার – সুতরাং পয়সা দিয়ে ফাস্টফুডের দোকান থেকে মুহূর্তে কিনে নিয়ে আসতে চাই!

যাহোক, উনি বলছেন অনেকসময় যারা টিভি দেখে, প্রকৃতিকে তাদের বোরিং মনে হয় কারণ তারা টিভির দ্রুতলয়ের অ্যাকশনে খুবই অভ্যস্ত হয়ে যায়। ‘টুং-টুং’, ‘ব্যাঙ’, ‘দুম-দুম’ গুলি ইত্যাদি শব্দ আছে না? এর বিপরীতে প্রকৃতিকে তাদের নীরব, অ্যাকশনবিহীন মনে হয়। প্রকৃতিতে যে কোন জিনিস কিন্তু ধীর, শান্ত, শান্তিপূর্ণ। সেখানে একটার পর একটা ঘটনা ধীরে ধীরে ঘটে, প্রকৃতির কর্মকান্ডের প্রত্যাশায় ধৈর্যের ব্যপার রয়েছে।

৪। আপনার নিজের ও বাচ্চার ইন্দ্রিয়ের প্রতি মনোযোগ দিন।

মাঝে মাঝে বাচ্চাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে দেখতে পায় কি না জিজ্ঞেস করবেন। এমন কিন্তু হয় যে একটা বাচ্চা এক চোখে দেখে না অনেকদিন – অথচ বাবা-মা জানেই না, কারণ সে অ্যাডজাস্ট করে নেয়। তাকে জিজ্ঞেস করবেন কোনটা কী রঙ বোঝার জন্য যে সে “কালার ব্লাইন্ড” কি না। সে সবরকম স্বাদ, গন্ধ চিনতে পারে কি না – অনেক মানুষ আছে সব ধরনের স্বাদ, গন্ধ পায় না। এগুলো নিজেরটা ও বাচ্চারটা পরীক্ষা করে দেখবেন।

৫। শিশুদের হাত, পা ও পুরো শরীর ব্যবহার করে অর্থবহ কাজ করতে দিন।

খেয়াল করবেন সে হাত, পা, সম্পূর্ণ শরীর ব্যবহার করছে কি না। তাকে মাঠে ঘাটে ছেড়ে দিন, ও দৌড়াক, আছাড় খাক, হাত-পা ছিলুক – এগুলো সব প্রয়োজনীয়!

এই ছিল শিশু বিশেষজ্ঞ সুজানের ৫টা পরামর্শ।

এরপর আমরা হামযা ইউসুফের লেখার অংশ দেখব। উনি ছয় বছর মৌরিতানিয়ায় থেকে দ্বীন শিক্ষা করেছেন। উনি কিন্তু সাদা চামড়ার মানুষ – দ্বীন শিক্ষা করার জন্য মরুভূমিতে অত্যন্ত কষ্ট করেছেন। তিনি এই বইতে গসম্যান নামে একজন লেফটেন্যান্টের কিছু গবেষণালব্ধ ফলাফল দিয়েছেন যা আমরা দেখব:

১। টিভির ৪০% সহিংসতা করছে এমন চরিত্র, যাদের মানুষ আদর্শ মনে করে – যেমন, শাহরুখ খান।

২। এই সহিংসতাগুলো যারা করে, তাদের তিন ভাগের এক ভাগ খারাপ চরিত্রের কোন শাস্তি হয় না। এতে বাচ্চারা কী শিখে? আপনি খারাপ কাজ করে বেঁচে যেতে পারবেন। আর আমরা যখন বড় হচ্ছি তখন তো খারাপ কাজ করা হিরোই ছিল – টেলিভিশনে রবিনহুড দেখাত তখন, সে তো ডাকাত ছিল!

৩। টিভিতে যেসব সহিংসতা দেখান হয় তার অর্ধেকের বেশিতে মৃত্যুর ঝুঁকি আছে – যদি আসলেই কেউ এগুলো বাস্তবে করতে যায়, তবে সে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। পড়েন নাই পেপারে, এসব করতে গিয়ে বাচ্চারা নিজে মরে গেছে বা অন্যকে মেরে ফেলেছে?

৪। ৪০% সহিংসতার ভেতর আবার হাস্যরস থাকে। অর্থাৎ একজন আরেকজনকে মেরে ফেলছে কিন্তু আপনি হাসছেন।

৫। টিভিতে যা দেখান হয় তার মাঝে ৬০% সহিংসতা থাকে এবং ৬০%র বেশি অংশে আক্রমণাত্মক আচরণ থাকে – তবে এটা কিন্তু ১৯৯৯এর কথা। এখন আরও বেশি হবে। বাচ্চারা যদি দিনে দুই ঘন্টা করে কার্টুন দেখে তাহলে বছরে তারা ৫০০ সহিংস আচরণ দেখবে, যা তাদের ভেতর আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্ম দেবে।

এখানে হামযা ইউসুফ নিজে আরও কিছু ডাটা দিচ্ছেন। আমেরিকায় ১৫-২০ বছর বয়সী যে সব বাচ্চারা মারা যায় তাদের মৃত্যুর কারণের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ‘খুন’। আর আফ্রিকান-আমেরিকানদের মাঝে এটা প্রথম কারণ। আমেরিকায় প্রতি পাঁচ মিনিটে সহিংসতা ঘটানোর জন্য একটা বাচ্চাকে অ্যারেস্ট করা হয় এবং বন্দুকের ব্যবহার থেকে প্রতি তিন ঘণ্টায় একটা বাচ্চা মারা যায়। আমেরিকায় ৪৮৮১টা সন্ত্রাসী দল আছে যাদের সদস্যের সংখ্যা হচ্ছে দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে বড় হওয়া একটা বাচ্চার চেয়ে ওয়াশিংটন ডিসি বা শিকাগোতে বড় হওয়া একটা বাচ্চার খুন হওয়ার সম্ভাবনা ১৫গুণ বেশি। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের কথা কেন বলছেন উনি? কারণ সেখানে সন্ত্রাসবাদী সংস্থা আই.আর.এ. আছে কিন্তু তাদের আক্রমণে বাচ্চারা মরে না, অথচ আমেরিকায় বাচ্চারা মরছে। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে কিশোর বয়সীদের আত্মহত্যা তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন? ৬০এর দশক থেকেই কিন্তু টিভি এসেছে! এরপর হামযা ইউসুফ বলছেন, দুই লক্ষ সত্তুর হাজার বাচ্চা প্রতিদিন স্কুলে বন্দুক নিয়ে আসে। আমাদের দেশে এরকম হয় না, কিন্তু আমাদের দেশেও কিশোর কিশোরকে মোবাইল ফোনের জন্য হত্যা করেছে। এটা পেপারে উঠেছে। “ওর আছে, আমার নাই!” – এ জন্য মেরে ফেলেছে! আমেরিকায় প্রতি ১৫টা বাচ্চার মাঝে একজনের বাবা অথবা মা কেউ একজন জেলে আছে। এই সব কিছুর পেছনে টিভি বিষয়ক ব্যপারকে দায়ী করা হচ্ছে।

এখন হামযা ইউসুফ যেখানে পড়াশোনা করেছেন, মৌরিতানিয়া, সেখানকার কথা বলছেন। আর সব ইসলামী সমাজের মতো এখানেও মৌখিক সংষ্কৃতি বিরাজ করত, অর্থাৎ শোনার মাধ্যমে মুখে মুখে প্রচারের প্রক্রিয়া ছিল; আমাদের কুরআন মুখস্ত করা, হাদীসের বিস্তার এ সবই মৌখিক সংষ্কৃতির মাধ্যমেই হয়েছে। আর মুরব্বীদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। আমরা এখন একটা মুরব্বীহীন সমাজে পরিণত হয়েছি। আগে পাড়ার সবচেয়ে অথর্ব বৃদ্ধকে দেখলেও ছেলেরা সিগারেট ফেলে দিত! আর এখন মুরুব্বীর মুখের ওপর ধোঁয়া ছাড়ছে কিশোরেরা। এরপর উনি বলছেন যে, তার পড়াশোনার সময়কালে সেখানে টিভি ছিল না। দশ বছর পর উনি যখন সেখানে আবার গেলেন, তখন আগের দেশটা আর নেই! সেটা অন্যরকম হয়ে গেছে! কেন? যে আতিথেয়তা, মানুষের সাথে কথা বলা – উনি আগে পেয়েছিলেন – সেটা এখন আর নেই। এখন টিভির কারণে মানুষের আর সময় নেই তো, তাই! সেখানে মানুষের সাথে মেলামেশা, কথা বলা নাটকীয়ভাবে কমে গেছে এবং সবার মাঝে কিভাবে আমেরিকায় যাওয়া যায়, বড়লোক হওয়া যায় ও সেখানে গিয়ে টিভিতে যা কিছু দেখায় সব কিনে ফেলা যায় এই তাড়না প্রবল হয়েছে। আমাদের দেশে একই অবস্থা না এখন? একদম একই অবস্থা! আর একটা বিশাল পার্থক্য তিনি দেখেছেন যা হোল টিভির আবির্ভাবের বদৌলতে মানুষের মাঝে “পশ্চিমা আচরণ” বিরাজ করছে – অন্যের জন্য তাদের কাছে সময় কমে গেছে। বাবা, মা, স্ত্রী, ছেলেমেয়ের জন্য মানুষের কাছে এখন আর সময় নেই।

আমরা আজ এখানেই শেষ করছি। আমরা যেন এখান থেকে বোঝার চেষ্টা করি, চিন্তা করি আমরা কী হারিয়ে ফেলছি এবং আমরা অন্যরকম হয়ে যাচ্ছি। নিঃসন্দেহে টিভি আমাদের মাঝে যা এনে দিচ্ছে তা ইসলামবিরোধী ও অনৈসলামিক জীবনযাত্রা।

প্রতিলিপি লিখেছেন রাবেয়া রাওশিন।

এই লিংক থেকে আপনারা ডাউনলোড করে নিতে পারেন সম্পূর্ণ  অডিও লেকচারটি ।

Viewing all 385 articles
Browse latest View live